ওরা একটা ব্রিজের সামনে এসে থমকে দাঁড়াল। সামনে বোর্ড ঝুলছে- বিপজ্জনক সেতু। অনীশ বাইক থামাল, ওর কোমর জড়িয়ে বসে থাকা তিতি এতক্ষণ আকাশে উড়ছিল। সেও থামল, মানে থামতে হল তাকে।
‘কী হল?’
‘সেতুটা বিপজ্জনক’
বিপজ্জনক শব্দটা শুনে গা শিরশির করে উঠল তিতির, সে আরো বেশি করে অনীশকে জড়িয়ে ধরল, জাপ্টে ধরল বলা যায়। তার বুক দুটো মনে হল অনীশকে ফুঁড়ে চলে যাবে।
হেমন্ত কাল। গরম চলে গেছে, কিন্তু শীত আসেনি, প্রকৃতিতে কেমন একটা আলসেমি। তিতি তার সারা শরীর দিয়ে অনীশের পিঠ জুড়ে ছিল, যেন সে নিজেকে লুকিয়ে ফেলতে চাইছিল বাইরের সমস্ত কলরব থেকে।
সেইসময় তার ফোন বাজল, ভয়ে কাঁটা হয়ে গেল তিতি। ফোনটা এখন সে ধরতে পারবে না, তবু জানে জয়দীপ করেছে ব্যাঙ্গালোর থেকে। জয়দীপ কি কিছু বুঝতে পেরেছে? আজকাল কিছুক্ষণ অন্তর অন্তর ফোন করে সে। খোঁজ নেয় বউ কোথায় গেল। কিন্তু তিতি যখন হাতের কাছে থাকে, তখন কখনও জানতে চায় না সে কেমন আছে। কী করলে সত্যি ভালো থাকতে পারে সে।
অনীশ বলল ‘কি, থামাব? ফোনটা ধরবে?’
কথা না বলে দুদিকে মাথা নাড়ল তিতি আর তার ঠোঁট গভীরভাবে ডুবিয়ে দিল অনীশের পিঠে।
অনীশ থামল না, থামতে পারলই না, তিতির চুমু যেন তার দুই কাঁধে দুটো ডানা জুড়ে দিল।
সে সোজা ব্রিজের ওপর বাইক চালিয়ে দিল।
‘কী করছ কি?’ ভয়ে চিৎকার করে উঠল তিতি। সে ভাবতে পারেনি অনীশ সত্যি সত্যি এই বিপজ্জনক সেতুটার ওপর উঠে যাবে তাকে নিয়ে। এটা তো যেকোন মুহুর্তে ভেঙে পড়তে পারে, আর পড়লেই নিচের ঐ খালটায়!
এক মুহূর্তের জন্যে সে নিচের জলের দিকে তাকাল। জল খুব নোংরা হবে ভেবেছিল, আদৌ তা নয় । বরং কাচের পেপার ওয়েটের মধ্যে যেমন রঙ্গিন নকশা দেখা যায়, তেমনি জলের তলায় লতা গুল্ম সব পরিষ্কার দেখতে পেল সে। এমনকি তার মনে হল জলের নিচে একটা রুপোর চুটকি পড়ে আছে। চুটকি আজকাল বেশি কেউ পরে না। খুব সুন্দর করে পেডিকিওর করা পায়ে চুটকি খুব সুন্দর লাগে দেখতে। প্রেগন্যান্ট হবার পর মা তাকে বলেছিল এসময় চুটকি পরতে হয়, বানিয়েও দিয়েছিল। তিতির পা তেমন সুন্দর নয়, সেভাবে যত্নও করেনা ও। কিন্তু সেসময়, হাঁটুতে মুখ রেখে ও অপলক চোখে চুটকি পরা পায়ের পাতার দিকে চেয়ে থাকত। ও বিশ্বাস করতে শুরু করেছিল এই ছোট্ট পায়ের গয়নাটি ওর সন্তানকে সুরক্ষিত রাখবে। তাই যখন আড়াই মাসের মাথায় মিসক্যারেজ হয়ে গেল, তখন সে কাঁদতে কাঁদতে ও দুটো ছুঁড়ে ফেলেছিল। কোথায় যে তারা পড়েছিল কে জানে। আজ মনে হল, তারা কোথাও হারায়নি, এই ছোট্ট জলধারার নিচে শুয়ে আছে।
সে চাপা গলায় আবার বলল ‘ করছটা কী? এটায় উঠলে কেন?’
অনীশ বলল ‘এই নিষেধ বড় গাড়ির জন্য, বাইক রিক্সা যেতে পারে।’
‘তবু’ তবু বলে আর কথা খুঁজে পেল না তিতি।
তার চোখ তখন রুপোর চুটকিটাকে খুঁজছিল। কিন্তু সে আর দেখতে পেল না। কারণ ততক্ষণে তারা ব্রিজটা পার হয়ে চলে এসেছিল।
২
‘এবার কোন দিকে যাবে?’
‘চেনা গণ্ডির বাইরে।’ বলল বটে, কিন্তু যত ওরা এগোল, লোকবসতি, স্কুল, এমনকি থার্মোকলের গ্লাস-বাটি বানাবার কারখানা। তার ওপর ওরা যখন রাস্তার ধারের একটা ঝুপড়িতে চা খেতে থামল, সেখানেও সেই কারখানার শ্রমিকরা দলে দলে টিফিন খেতে এসেছে। লুচি কিংবা মুড়ি ঘুগনি দেখে তিতির গা গুলিয়ে উঠছিল। ওরা চা খেয়ে তাড়াতাড়ি বেরিয়ে পড়ল। এগোতে এগোতে ওরা একটা দু- মাথার মোড়ে এসে দাঁড়াল। অনীশ বলল ‘মনে আছে রবার্ট ফ্রস্টের কবিতাটা?’
‘আই টুক দা আদার পাথ দ্যাট মেড অল ডিফারেন্স!’
ওরা বাঁদিকের রাস্তা নিল।
৩
রাস্তা যেমন হয়, কখনো লোকের জটলা, দোকানপাট, ইস্কুলবাচ্চা, আবার কখনো একদম নির্জন ফাঁকা তল্লাটে এসে পড়ে। আর সেইসব নির্জনতায় তৈরি হয় চুমুর বাঁক। যদিও দুজনেরই মাথায় হেলমেট, তাই ওদের দাঁড়িয়ে পড়তে হচ্ছিল, হেলমেট খুলে চুমু খেয়ে আবার উঠতে হচ্ছিল বাইকে। তিতি বলল ‘এ রাস্তাটার নাম থাক চুম্বন সরণি’
অনীশ ওর বুক আলতো করে ছুঁয়ে বলল ‘এটা বাদে হুগলী’
‘বাদে হুগলী? কি অদ্ভুত নাম? যেন হুগলী জেলাকে বাদ দেওয়া হয়েছে।‘
‘এটা তো হুগলী জেলা নয়’
‘সেটা কি আমি জানি না?’
অনীশের পিঠে মুঠি পাকিয়ে ঘুঁষি মারে তিতি
‘উঃ’
‘লাগল?’
লাগে তো, পিঠে নয়, বুকে’
‘বাব্বা’ বলতে গিয়েও চুপ করে যায় তিতি। তার কিছু মনে পড়ে যায় যেন।
‘কী হল? চুপ যে?’
‘মনে আছে তোমার?’
মনে পড়ছিল অনীশের, তবু সে তিতির মুখ থেকে শুনতে চাইল। সাধারণ, তুচ্ছ কথাও তিতির মুখ থেকে শুনলে সঙ্গীতের মতো লাগে। অনীশ সেই সঙ্গীত শোনার অপেক্ষা করছিল।
তিতি বলতে গিয়ে একটু ঘেমে উঠল
‘সেই যে কলেজের প্রথম দিন, ফ্রেশার্স ওয়েলকামে ছবি তোলার সময় বলেছিলে হাত কাঁপবে না, অন্য কিছু কাঁপবে!’
সেই কাঁপন এতদিন পরেও ওরা অনুভব করছিল হাওয়ায় হাওয়ায়। এর নামই কি...?
৪
‘এই, একটা খেলা খেলবে?’
‘কী খেলা?’
‘আমরা বারবার এই ব্রিজটার ওপর দিয়ে যাব, ব্রিজটা যদি ভেঙে যায় তবে বুঝবে আমাদের প্রেমও ভেঙে যাবে’
অনীশ অবাক হয়ে বলল ‘এই তো যেতে চাইছিলে না? ভয় পাচ্ছিলে’
‘আরে চলোই না’
‘এখন কী করে যাব? অনেক আগে ফেলে এসেছি তো।’
‘ঠিক আছে, ফেরার সময় যাব’
‘ওদিক দিয়ে ফিরব না সোনা’
এ কথায় রাগ না করে তিতি বলল ‘যে পথ দিয়ে পাঠান এসেছিল, সে পথ দিয়ে ফিরল না কো তারা। তুমি হোরিখেলা পড়েছ?’
অনীশ সে কথার উত্তর না দিয়ে বাইকটা রাস্তার এককোণে দাঁড় করাল।
‘নামো’
তিতি চমকে উঠে বলল ‘এখানে? এখানে কী আছে?’
অনীশ তিতির হেলমেট খুলে ওর মুখ তার দুই হাতের পাতায় নিতে নিতে বলল
‘পৃথিবীর সবচেয়ে দর্শনীয় স্থান’
তিতি অনীশের বুকের মধ্যে ডুবে যাচ্ছিল। কিন্তু এ এমন এক নিসর্গ যে তাকে খেয়াল না করে থাকা যায় না। সে অনীশের বুকের আড়াল থেকে দেখল তারা একটা অদ্ভুত জায়গায় এসে পড়েছে। দুদিকে যতদূর চোখ যায়, ধূ ধূ পেয়ারাবাগান, সেখানে শ্যালো থেকে জল চলে যাচ্ছে এ প্রান্ত থেকে ও প্রান্ত , এছাড়া আর কোন শব্দ নেই চরাচরে। একটিও লোক নেই কোথাও। যদিও পেয়ারাবাগান পাহারা দেবার জন্যে মাঝে মাঝে ঝুপড়ি রয়েছে, সেই ঘরের সামনে এমনকি একটা লাল গামছা। কিন্তু কোন লোক নেই।
আর দুদিকের বাগানের মাঝে রাস্তা এত সংকীর্ণ যে কোনরকমে একটা বাইক বা দুজন লোক যেতে পারে, অবশ্য একটা ভ্যান যেতেও দেখেছিল ওরা। সে যদিও অনেক পরে। সেটা এমন একটা মুহূর্ত যে ওরা কিচ্ছু দেখেনি, এমনকি নিজেদেরও না। কিচ্ছু শোনেনি, শুধু নিজেদের শ্বাসপ্রশ্বাস। ওরা পরস্পরের ঠোঁটের মধ্যে দিয়ে ঢুকে আত্মায় পোঁছতে চাইছিল। তিতির ভেলভেট নরম দুই ঠোঁটের স্পর্শে অনীশের রাজদণ্ড জেগে উঠেছিল, তিতির হাত সেটা ধরতে চাইল। অনীশ আনন্দে মরে যাচ্ছিল, তবু বলল ‘কেউ এসে পড়বে, কোর না’ তিতি যেন বিপজ্জনক সেতুতে উঠছে, এইভাবে টেনে জিপার খুলল। অনীশের মনে হল একরাশ বেলুনের সঙ্গে ও আকাশে উড়ে যাচ্ছে। কোন চার দেওয়াল ঘেরা বিছানায় নয়, খোলা আকাশের নিচে, সবুজের মধ্যে দাঁড়িয়ে তিতি যেন বনদেবীর মতো ওকে জাগিয়ে তুলছিল। সেই মুহূর্তে একটা খচমচ শব্দ হল। কে যেন আসছে। ওরা চমকে সরে দাঁড়াল। তারপর দুজনে হো হো করে হেসে উঠল। একটা ছাগল!
৫
‘এবার কোথায়?’
‘নেতাজীর বাড়ি।’
‘কোথায় সেটা?’
‘কোদালিয়া।’
ওরা লোককে জিগেস করতে করতে চলল।
তিতি বলল ‘ওরা ভাবছে লোকাল কাউন্সিলারের বাড়ি খুঁজছি। কিংবা এই এলাকার মস্তান।’
‘না, না , নেতাজীর অবস্থা অত খারাপ হয়নি। শহর, মফস্বল সব জায়গায় গাদা গাদা নেতাজী সুভাষ রোড।’
রাস্তার কথায় তিতির চুম্বন সরণির কথা মনে পড়ল। ওরা তখন একটা পাড়ার মধ্যে দিয়ে যাচ্ছিল। হঠাৎ একটা জলাজায়গা, তাতে পরিযায়ী পাখির মেলা। তিতি নিজের চোখকে বিশ্বাস করতে পারছিল না।
সে চিৎকার করে উঠল ‘কূট, কূট’
‘সেটা কী?’
‘পাখি। মাইগ্রেটরি বার্ডস। এদের জন্যে কতদূর যাই, আর আজ এখানে পাব ভাবতে পারছি না!’
প্রথমে ওরা বাড়িটা পার হয়ে অনেকটা চলে গেছিল, অনীশ বলেছিল ওইটাই হবে, তিতি বলল, না। আরও দূরে। অনীশ বলল ‘আমার কিন্তু মনে হচ্ছে ওইটাই, কারণ খেয়াল করে দেখো আগেকার বড় বড় মানুষদের বাড়ির চারপাশে অনেকটা জায়গা থাকে, বাকি সব বাড়ি ছাপিয়ে সেটা দাঁড়িয়ে থাকে।’ অনীশের কথাই ঠিক হল। খানিকদূর গিয়ে দুচারজনকে জিগেস করলে সবাই সেই বাড়িটাই দেখিয়ে দিল যেটা ওরা ফেলে এসেছিল। ওদের আবার ফিরতে হল। ফিরতে ফিরতে তিতি কোদালিয়া গ্রামটাকে খেয়াল করছিল। পার্টি অফিস আছে, বাইক যাচ্ছে, মোবাইল কানে কথা বলতে বলতে যাচ্ছে মেয়েরা, তবু তবু এখানে যেন সময় থমকে আছে। ভারতবর্ষের আত্মা কোথাও লুকিয়ে আছে এখানে। সে অনীশের পিঠে একটু আলগা হয়ে বসল। দুটি মন্দির, একটি পুকুর পার হয়ে বাঁদিকে বাঁকতেই বাড়িটা। সারাই চলছে, সেটা লেখাও আছে নোটিশ বর্ডে। একজন মাঝবয়সী লোক বারান্দায় চেয়ার নিয়ে বসে, দেখেই বোঝা যায় সে এসব কাজের তদারকি করছে। বাড়ির ওপরটা তিতিকে টানছিল। লোকটাকে দু একবার বলার পর উদাসীন গলায় বলল ‘ যান, কিন্তু দেখেই নেমে আসবেন।’ সরু সিঁড়ি দিয়ে ওপরে উঠে ওরা চমকে গেল। সিঁড়ির মুখের দরজাটা শোয়ানো, মানে সিঁড়িটা শেষ হয়েছে দোতলার বারান্দার সঙ্গে ৪৫ ডিগ্রি কোণ করে আর তাই দরজাটা মনে হয় যেন শুইয়ে রাখা। অনীশও এমন দরজা আগে দেখেনি। সেই দরজা তিতির তিনতলায় যাবার তৃষ্ণা বাড়িয়ে দিল। উঠতে উঠতে ওরা আবিস্কার করল, চুম্বনের শুধু সরণি নয়, সিঁড়িও হয়। তিতির ব্যাগে ফোন বাজছিল। সেটা সম্পূর্ণ উপেক্ষা করে ও অনীশের ঠোঁটের সিঁড়ি দিয়ে নিচে নামছিল। অনীশ কোনরকমে বলতে পারল ‘সিঁড়িও তো একরকমের সেতু , তাই না? মাটির সঙ্গে আকাশের!’
৬
ওদের গাড়িটা একটা ব্রিজের সামনে এসে দাঁড়াল।
‘মনে পড়ে?’
তিতি অনীশের বাহুতে মুখ ডুবিয়ে প্লুত স্বরে বলল ‘খুব, খুব’
‘এখন এটা পেরোতে ভয় লাগবে ?’
‘একটুও না। এরকম কত সেতু পেরিয়েছি তো আমরা’
অনীশ ‘বিপজ্জনক’ লেখা বোর্ডটা খুঁজছিল, না পেয়ে রাস্তার ধারে একজন ডাব বিক্রি করছে, তাকে জিগেস করল।
‘এই ব্রিজটা সেফ তো? আগে বোর্ড ছিল?’
ডাবওলা খানিক অবাক হয়ে দেখল ওদের। তারপর বলল ‘এত বছর ধরে এখানে ডাব বিক্রি করছি, কোনদিন দেখিনি তো। কত বড় বড় লরি অব্দি যাচ্ছে’
অনীশ উত্তেজিত হয়ে বলে ‘ একটা বোর্ড ছিল না? ‘
‘কোনদিন না। একবার শুধু রঙ হয়েছিল বলে দুদিন বন্ধ ছিল’
ওরা দুজন তবু মরিয়ার মতো সেই বিপজ্জনক সেতুটাকে খুঁজছিল।