লক্ষ্মণ শীল কে রক্ষণশীল কেউ কোনোকালেই বলতে পারবেনা। উদারচেতা বললেও তার পুরোটা বলা হয় না।
তবে তার কিছু কিছু অরক্ষণীয়া চেষ্টাচরিত্তির, আজও স্মৃতির ঘরে বেশ দাপুটে উপস্থিতিতে বিদ্যমান ।
জীবনের শুরুটি আর বাকি পাঁচজনের মতো হলেও, তার প্রতিভার (?)স্ফূরণ দেখা যায় তেরো বছর বয়সে।
পারিবারিক অবস্থা তার খুব একটা ভালো ছিল না। বাবা মা দুজনেই খুব সরল সিধে ছা পোষা মানুষ। তবে লক্ষ্মণ পেয়েছিল তার মামাদের জিনগত ধাঁচ।আড়ে দিঘে তেরো বছরেই সে আর পাঁচটি সমবয়স্ক ছেলের চেয়ে অনেকটাই বড়সড়। সেই দৈর্ঘ্য প্রস্থের সঙ্গে তাল মিলিয়ে তার খোরাকটিও পূর্ণবয়সী যুবাদের লজ্জায় ফেলে দেওয়ার মতই ।
তখন গ্রামে ফলবাগানে এতো বেড়া, পাঁচিলের বহর ছিলনা। গ্রীষ্মে আম, জাম, কাঁঠাল, জামরুল থেকে শুরু করে শীতের মুলো, টমেটো, মটরশুঁটি পর্যন্ত গ্রামের ছেলেছোকরার দল অবাধেই উদরসাৎ করতে পেতো।
কিন্তু ফলফলাদি সব্জিতে সাময়িক পেটের জ্বালা মিটলেও, নিত্তনৈমিত্তিক ক্ষুণ্ণিবৃত্তির জন্য গত্যন্তর খুঁজতে হতো। আর এখানেই ছিল লক্ষ্মণের প্রতিভার স্ফূরণ।! গ্রামের চাষবাসের কথা আর আলাদা করে কিছু বলার নেই। আমাদের বেশ বড়বেলাতেও ষাট সত্তর বিঘা ধানীজমির মালিককেও দেখেছি লুঙ্গি হাঁটুর ওপর তুলে মাথায় টোকা দিয়ে ধান পাট রুইতে। সঙ্গে পরিবারের অন্য পুরুষ সদস্যরাও লেগে পড়তেন বাধ্য হয়ে বা স্বতঃস্ফূর্তভাবেই।
আরও পড়ুন, ছোট গল্প সখিসংবাদ
কিন্তু, পাট রোঁয়ার বা ধানের মাঠে গজিয়ে ওঠা ঘাস আগাছা বাছা, তাও আবার অত বিশাল জমির, শুধুমাত্র পারিবারিক শ্রমের মাধ্যমে সম্ভবপর হয়ে উঠতোনা। অগ্রদ্বীপ, বেলেরহাট, লক্ষ্মীপুর থেকে আসা ঠিকে মুনিষ স্রেফ উবে যেত হামলে পড়া মালিক চাষীদের ব্যাঘ্রঝম্পনে।
অগত্যা ত্রাহি মধুসূদন গ্রামের ছেলেরা।
শিশুশ্রম নিয়ে তখন খুব একটা রচনা প্রবন্ধ দেখিনি। দেখিনি খাদ্যাভাবে শুকিয়ে মারা যাওয়াও। তারাশঙ্কর, শরৎচন্দ্র, বঙ্কিমচন্দ্র, অদ্বৈত মল্লবর্মণের উপন্যাস ছাড়া আমরা দুর্ভিক্ষের কথা জানতামই না।
অন্তত পলাশপুলীতে।
উত্তর পলাশপুলীতে শ্রীধর রাজবংশী বলে এক হাড়কঞ্জুস মালিক চাষী ছিলেন। জমি তাঁর যত না ছিল, কার্পণ্য ছিল দশগুণ। বিলের পাড়ে নীচু এঁটেল জমিতে বিঘা তিনেক ধান তিনি লাগিয়েছিলেন। সংস্কার ও বাছাইয়ের অভাবে এক দেড় বিঘৎ ঘাস গজিয়ে উঠেছিল ধানের ফাঁকে ফাঁকে।
তা তিনি একদিন লক্ষ্মণকে বাগে পেয়ে গেলেন।
-অ লক্ষ্মণ...
-কন জ্যাঠা।
-আমার ধানের ঘাস বাইছ্যা দিবি?
-কি দিবেন?
-দশ টাকা দিমু।
-লাগবো না। এক বেলা প্যাটচুক্তি পান্তা আরেকবার গরম ভাত, ডাল আর আলুসিদ্ধ দিয়েন।
শ্রীধর দেখলেন পাঁচ টাকার মধ্যেই কাজসারা হচ্ছে যখন, দশটাকা খরচ করা বুদ্ধিমানের কাজ হবেনা।
হাঁড়ির পান্তা পলাশপুলীর প্রত্যেক বাড়িতে সকালবেলায় জুঁইফুলের মতো ফুটে থাকতো। পেঁয়াজকুচি, পোড়ালঙ্কা আর কাঁচা তেল দিয়ে মাখা আলুসিদ্ধ। বাবা কাকা দাদা ঠাকুরমা কাকীমাদেরও দেখেছি সকাল দশটার সময় একথালা পান্তা সাপটে নিজের নিজের কাজে চলে যেতে।
দু পক্ষই খুব রাজী।
একচালান ঘাস তুলে এসে পান্তা। দ্বিতীয় চালানে গরম ভাত।
আরও পড়ুন, ছোট গল্প: জাহ্নবী
বিলের নীচু জমিতে ধান আঁচড়ে ঘাস বাছার অভিজ্ঞতা যার আছে, তারই আছে। কেতাবি বিদ্যা খুব একটা কাজে আসেনা। গোড়ালি ডোবানো থকথকে কালো আঠালো কাদা, ভাঙা শামুক ঝিনুকের আঁচড়, গ্রামাঞ্চলের নাছোড়বান্দা আলকেউটের মীদ ...ব্যাপারটা নেপোলিয়নের রাশিয়া আক্রমণের সামিল মনে হতে পারে মাঝপথে গিয়ে।
তা ভোর না হতে কাজ শুরু করে, সকাল সাড়ে সাতটা -আটটা নাগাত প্রথম কিস্তির ঘাস উৎখাত সেরে, লক্ষ্মণ হাজির শ্রীধর রাজবংশীর বাড়ি। হাত -পা -মুখ ধুয়ে একগাল হেসে শ্রীধরকে বললো,
-জ্যাঠা, জেঠিরে কন ভাত দিতে।
শ্রীধরের ছক আগে থেকেই কষা ছিল। তিনি বললেন,
-আরে বোকা, এতো সকালে ভাত খাইসনা। কাম করতে গিয়া ঝিমানি আইবো। চাট্টি চাইলভাজা খা। বেহানবেলায় গরম ভাত দিমুনে। একটুকরো মাছও খাইস।
লক্ষ্মণ এমন কিছু একটা আঁচ আগে থেকেই করছিল। কারণ, শ্রীধর রাজবংশীর হাতভারের খবর অল্পবিস্তর গ্রামের সবারই জানা ছিল।
কথা না বাড়িয়ে, লক্ষ্মণ শুকনো চালভাজা চিবিয়ে, একঘটি জল খেয়ে নিলো পেট ভ'রে। তারপর আবার চলে গেলো কাজে।
শ্রীধর খুব একচোট হাসলেন।
দুপুর নাগাদ ভরপেট খেয়ে পেয়ারাতলার বাঁশের মাচায় চিত হয়ে শুয়ে দিবানিদ্রার চেষ্টা করছেন শ্রীধর। কামরাঙায় গাছ ছেয়ে এসেছে। বিষটক হলেও কাঁচা সোনার মতো রঙ। তেমনই আকার। সেগুলি সদগতি করার কথা ভাবতে ভাবতে একটু চোখ লেগে এসেছে, তখনই কানের কাছে আচমকা ফিসফিসিয়ে ডাক
-ও জ্যাঠা...
ধড়মড় করে উঠে বসে শ্রীধর দেখেন, লক্ষ্মণ।
-কি রে, আইয়া পড়লি?
-সব তুইল্যা দিসি...এক বিঘা পুরা সাফ।
-বা বা ..বাইচ্যা থাকো। খিদা পাইসে?
-হ্যাঁ জ্যাঠা, পাইসে তো..
-যা খাইয়া নে...ও গো শুনসো...
অন্তরালবর্তিনী বৃদ্ধা একটা সানকি ঠক করে রেখে গেলেন দাওয়ায়। শুকনো কড়কড়ে আধসিদ্ধ ভাত। লক্ষ্মণ বুঝলো সে চাল শুধু তারজন্যই রান্না হয়েছে। সে চাল এখন রেশনে দেওয়া হলে, দাঙ্গাহাঙ্গামা বাধতে বাধ্য। তার উপরে হলুদগোলা গরম জল ঢেলে দেওয়া হয়েছে। দুটি গোটা আলুসিদ্ধ একপাশে রাখা আছে। খোসাশুদ্ধ। আর মাছের যে টুকরোটি আহারের শোভাবর্ধন করছে, তার বেধ দেখলে,যে কোনো ক্ষীণকটি রমণীও জিম যাওয়া ছেড়ে মাছ কাটিয়ের কাছে সার্জারি করাতে হত্যে দেবেন।
বিনা বাক্যব্যয়ে সেই খাবারই উদরসাৎ করে লক্ষ্মণ কেটে পড়লো। একটু যেন তাড়াতাড়িই উধাও হয়ে গেলো।
বিকেলের দিকে দিবেনিদ্রাটি সেরে শ্রীধর জমি তদারকিতে রওনা দিলেন। ফুরফুরে ভিজে হাওয়া। আম কাঁঠালে ছায়ায় রোদের তাপও যেন আরামদায়ক বড়। খুশি মনে বিলপাড়ের রাস্তা ধরলেন।
কিন্তু জমির কাছে পৌঁছে তাঁর চক্ষু চড়কগাছ!
কি সর্বনাশ। দুবিঘে জমির সব ধান ওপড়ানো। শুধু কিছু ঠ্যাঙঠেঙে ঘাস দাঁড়িয়ে আছে বেকুবের মতো। তারাও যেন উচ্ছেদ না হয়ে, বড় অপ্রস্তুত। লজ্জিত।
রাগে কাঁপতে কাঁপতে লক্ষ্মণের বাড়ি চললেন শ্রীধর রাজবংশী। লক্ষ্মণের বাবা ভয়ে সামনেই এলেন না। লক্ষ্মণ বোধ করি হন্ডুরাস কি হনলুলু পাড়ি জমিয়েছে।
তার মা ছিলেন সামনে। ঝাড়া আধঘন্টা ছেলের নামে অশ্রাব্য খেউর, অভিশাপ শুনে শেষে নিরীহ মহিলাটি ফুঁসে উঠলেন। চোখ ছলছল করে উঠলো। জ্বলেও উঠলো যেন কিছুটা।
কেটে কেটে বললেন তিনি,
-চুপ করেন এবার। ভাত যদি চালভাজা হইয়া যাইতে পারে, ধান ঘাস হইবো না ক্যান? হেইডা আগে আমারে বুঝান। তারপর প্যাচাল পাইরেন ...
আর একটাও কথা বলেননি শ্রীধর। চুপচাপ বেরিয়ে এলেন উঠোন ছেড়ে। নিজের ভুল বুঝলেন কি না রামই জানেন, তবে ব্যাপারটা নিয়ে আর শোরগোল করলেন না।
সপ্তাহখানেক বাদে, লক্ষ্মণের সাথে একবার দেখা হয়েছিল তাঁর। তিনি একটু রাগত কন্ঠেই বললেন,
-তুই মানুষ?
লক্ষ্মণ হাজির জবাব,
-না না। মানুষ তো মরণ শীল।