Advertisment

পাগলের পাগলামি কিংবা একটি নিখাদ প্রেমের গল্প

পরির গল্প। প্রেমে পড়ার গল্প। ব্যর্থতা আর সাফল্যের বাইরে গিয়ে আকাঙ্ক্ষার গল্প। বাংলার প্রান্তরের গল্প লিখেছেন নীহারুল ইসলাম।

author-image
IE Bangla Web Desk
New Update
niharul storyNIHARUL ISLAM-003

অসেফকে নিয়ে চিন্তা আছে। ছোঁড়া আজ দু’দিন আমাদের ঠেকে আসছে না। (ছবি- চিন্ময় মুখোপাধ্য়ায়)

নীহারুল  ইসলাম

Advertisment

অসেফ কিছুদিন যাবৎ আমাদের পরির গল্প শোনাচ্ছে। ইচ্ছে করলেই নাকি সে আকাশ থেকে পরি নামাতে পারে। এমনকি আমরা চাইলে আমাদের চোখের সামনে নাকি সেই পরিকে সে নাচাতেও পারে।

আমরা জানি যারা প্রেমে পড়ে তারা পরির গল্প করে। অসেফ আমাদের বন্ধু। সে যখন পরির গল্প করছে তখন নিশ্চয় সে প্রেমে পড়েছে। কিন্তু কার প্রেমে পড়ল ছোঁড়া?

আমরা খোঁজ শুরু করি। আর জানতে পারি যে, সে আমাদের গ্রামের সফু চৌধুরির মেয়ে হাজেরার প্রেমে পড়েছে। আরও খোঁজ নিয়ে জানতে পারি যে, সে শুধু প্রেমেই পড়েনি, হাজেরাকে জীবনে পাওয়ার জন্য সে রীতিমতো পাগল উঠেছে। তাই তার মুখে সবসময় পরির গল্প। শুনতে আমাদের ভাল লাগে। কেননা, হাজেরা আর পরি দুটোই আমাদের কাছে সমার্থক।

আসলে হাজেরা খুব বড় ঘরের মেয়ে। হাজেরার বাপ ফসু চৌধুরি খানদানি বড়লোক। তাছাড়া হাজেরা দেখতেও খুব সুন্দরী। তার গায়ের রঙ একেবারে ধবধবে সাদা। তার ওপর যেমন সে লম্বা, তেমনি তার শরীর-স্বাস্থ্য। মাথার চুল কোমর পর্যন্ত ছড়ানো। সেই হাজেরাকেই নাকি আমাদের বন্ধু অসেফ বিয়ে করতে চায়। আর যদি হাজেরার সঙ্গে তার বিয়ে না হয়, খোদার কসম সে মরে যাবে। যেমন লাইলীর জন্য মজনু মরেছিল, তেমনি মরে যাবে। মাঝে কোনও কথা হবে না। অসেফ কিরা কেটে বসে আছে।

আমাদের কাছে অসেফের এই প্রেম যাকে বলে ‘বামুন হয়ে চাঁদে হাত’ দেওয়া গল্পের মতো। তাই সুযোগ পেয়ে আমরাও অসেফকে নিয়ে মজা করছি। আমাদের বেশ কাটছে।

এই বেশ কাটানোর উদ্দেশ্যেই রোজ বিকেলবেলা আমরা এসে বসছি রংসাগর পুকুর পাড়ে। যেমন আজকেও এসে বসেছি। কিন্তু আজ অসেফের কোনও পাত্তা নেই। না- শুধু আজ নয়, মনে পড়ছে গত কালও সে আমাদের আড্ডায় আসেনি। আমরা তার কোনও খবর পাইনি। তার কিছু হল না তো!

আরও পড়ুন, যশোধরা রায়চৌধুরীর ছোট গল্প সখিসংবাদ

হঠাৎ করে আমরা অসেফের জন্য খুব উদ্বিগ্ন হয়ে পড়ি।    

রংসাগর নামের এই পুকুরটা আবার আমাদের গ্রামের একেবারে পশ্চিম দিকে অবস্থিত। তার পাশেই বিশাল মাঠ। নাম আদেড়ার মাঠ। সেই মাঠে সারা বছরে ফসল বলতে একমাত্র আমন ধান ফলে। তাও যে বছর ভাল বর্ষা হয়, সেই বছর। বর্ষার একটু এদিক ওদিক হলেই সেই ধানের রফাদফা। না, এসব নিয়ে আমাদের কোনওদিনই চিন্তা থাকে না, আজকেও নেই। তবে অসেফকে নিয়ে চিন্তা আছে। ছোঁড়া আজ দু’দিন আমাদের ঠেকে আসছে না। তার ওপর সে নাকি হাজেরার প্রেমে পড়েছে। আর হাজেরার সঙ্গে তার বিয়ে না হলে নাকি সে মরে যাবে। যেমন লাইলীর জন্য মজনু মরেছিল, তেমনি মরে যাবে। কিরা কেটে বসে আছে। তাহলে কি হাজেরার সঙ্গে তার বিয়ে কোনও মতেই সম্ভব নয় জেনে সে সত্যি সত্যিই মরেই গেল?

niharul storyNIHARUL ISLAM 2-004 অসেফের ওপর আমাদের এই প্রথম খুব অভিমান হয়। সেই অভিমান থেকে আমরা ভাবি, যা খুশি করুক গে! আমাদের কী? (ছবি- চিন্ময় মুখোপাধ্যায়)

আমাদের আর এক বন্ধু সবুজ বলল, ‘না- মরেনি। মরলে অবশ্যই আমরা জানতে পারতাম। যখন আমরা তার বন্ধু। এবং একই গ্রামে আমরা বসবাস করি।’

যদিও একই গ্রামে বসবাস করা সত্ত্বেও আমরা কেউ কখনই অসেফকে হাজেরার সঙ্গে কথা বলতে দেখিনি। তাছাড়া হাজেরা পর্দানশিন বাড়ির মেয়ে। সচরাচর বাড়ি থেকে বাইরে খুব একটা বের হয় না। স্বভাবতই আমরাও তাকে রাস্তাঘাটে দেখতে পাই না। তার যা কিছু সব নাকি তাদের বাড়ির মধ্যেই। গোসুল থেকে লেখাপড়া সবকিছু। তাদের বাড়ি তো আর আমাদের মতো বাড়ি নয়, তিনতলা মাহাল একখানা। নাম ‘চৌধুরি মঞ্জিল’। সে গোসুল করে সেই চৌধুরি মঞ্জিলের সাদা মার্বেল বসানো গোসুলখানায়। বাড়ির বিশ্বস্ত রাখাল ইদু ইঁদারা থেকে পানি তুলে সেই গোসুলখানার চৌবাচ্চা ভর্তি করে দেয়। আবার গ্রামের আসাদ মৌলবি রোজ জোহর বাদ নিয়ম করে তাকে আরবি পড়া শেখাতে যায়। চৌধুরি মঞ্জিলের অন্দরমহলে রাখাল ইদু আর আসাদ মৌলবি ছাড়া আর কোনও পুরুষের প্রবেশাধিকার নেই। তাহলে আমাদের বন্ধু অসেফ তার প্রেমে পড়ল কীভাবে?

অসেফের  মুখে যখন পরির গল্প শুনি, আমরা এসব কথাও ভাবতে থাকি।

আরও পড়ুন, রুখসানা কাজলের ছোট গল্প রোদের মায়া

কিন্তু আমরা কী ভাবলাম না ভাবলাম, অসেফের তাতে কিচ্ছু এসে যায় না। হাজেরা তার হৃদয়-জুড়ে কীভাবে বিরাজ করছে, সেটা পরির গল্পের আড়ালে সে আমাদের শোনাতে ব্যস্ত থাকে। আর সেই গল্প শুনতে শুনতে আমরা বুঝতে পারি ছোঁড়া সত্যিই প্রেমরোগের খপ্পরে পড়েছে।

আমরা জানি প্রেমরোগের খপ্পরে পড়ে একমাত্র তারাই, একান্তভাবে যারা খুব বেকুব হয়। তাদের পরিণতি কখনই ভাল হয় না। আমাদের গ্রামে সেরকম বহু দৃষ্টান্ত আছে। সর্বশেষ সংযোজন সামাদ বিশ্বাসের ছেলে এহেসান। তাদের বাড়ির কাজের মেয়ে রাহিলার প্রেমে এমনই পাগল হয়ে উঠল যে সে রাহিলাকেই বিয়ে করবে। ওদিকে সামাদ বিশ্বাসের মানসম্মান, গরিমার প্রশ্ন। ঝিয়ের সঙ্গে সে কিছুতেই ছেলের বিয়ে দেবে না। কিন্তু এহেসানের মন তখন কচুর বনে, কী হবে সিংহাসনে? বাপের মানসম্মান, গরিমা ভাঙতে সে একদিন বাড়িতে এনে রাখা কীটনাশক খেয়ে বসল। কপাল ভাল। তেঁতুলগোলা পানি খাইয়ে সেই যাত্রায় তার প্রাণ রক্ষে হল। সঙ্গে রাহিলাকেও বউ হিসেবে পেল। তারপর থেকে ছোঁড়া সেই ঝিয়েরই গোলাম হয়ে আছে।

একবার অসেফকে এহেসানের কথা বলতে সে আমার ওপর এমনই রেগেছিল, যেন আমাকে খুন করে বসবে। যদিও আমি খুন হইনি। আর খুন হইনি বলেই একদিন আমি চুপি চুপি হাজেরার সঙ্গে দেখা করেছিলাম। বলেছিলাম, ‘হ্যাঁরে- অসেফ নাকি তোকে ভালবাসে! তোকে বিয়ে করবে! তুই কি তা জানিস?’

শুনে হাজেরা বলেছিল, ‘কী বুল্লি? ওই পাগলটো হামাকে ভালবাসে? বিয়ে করবে? তার আগে যেনে আল্লা হামার মরণ দেয়!’

না, একথা অসেফকে বলতে সাহস হয়নি আমার। বললে এবারে যে অসেফের হাতে আমার নির্ঘাত মরণ ছিল তাতে কোনও সন্দেহ নেই। যাইহোক, আজ দু’দিন অসেফের কোনও পাত্তা নেই। তাহলে কি ছোঁড়া আমাদেরকে এড়িয়ে চলছে?

niharul storyNIHARUL ISLAM 1-001 পরির গল্প হয় জানি। পরির গল্প অনেক শুনেছি। কিন্তু পরি যে চোখে দেখা যায় এতদিন শুনিনি তো! (ছবি- চিন্ময় মুখোপাধ্যায়)

তৃতীয় দিনে খোঁজ নিতেই জানতে পারলাম শুধু আমাদেরকে নয়, বাড়িঘর- আত্মীয়স্বজন- সবকিছু ছেড়ে এমনকি নাওয়াখাওয়া ভুলে ছোঁড়া নাকি আদেড়ার মাঠে ল’পুকুরপাড়ে দিনরাত পড়ে থাকছে। সেখানে বটগাছের নীচে ফকিরবাবার যে মাজারটা আছে, সেই মাজারে নাকি নিত্য নতুন লালশালু চড়াচ্ছে আর সকাল সন্ধ্যা ধূপধুনো দিচ্ছে।

অসেফের ওপর আমাদের এই প্রথম খুব অভিমান হয়। সেই অভিমান থেকে আমরা ভাবি, যা খুশি করুক গে! আমাদের কী? এমন ভেবে আমরা আমাদের নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়ি। এবং দেখতে দেখতে আমরাও তাকে ভুলে যাই। কিন্তু আমরা ভুললে হবে কী, অসেফ কিন্তু আমাদের ঠিক মনে রেখেছে।

এর মধ্যে একদিন আমি একা একা কোথায় যাচ্ছিলাম, হঠাৎ আমার নাম ধরে পিছু ডাক। ঘুরে দেখি একটা পাগল। আমার নাম ধরে ডাকতে ডাকতে আমার দিকেই ছুটে আসছে। আমি তাকে চিনতে পারি না। আমি ভয় পাই। কিন্তু সে যখন আমার কাছে এসে বলল, ‘তোকেই ঢুঁড়ে বেড়াইছি আইজ সারাদিন। জলদি দশটা টাকা বাহির কর তো!’ তখন আর আমি আমাদের বন্ধু অসেফকে অস্বীকার করতে পারলাম না। আসলে চুলদাড়ি গজিয়ে তার এমন চেহারা হয়েছে যে তাকে আমার না-চেনারই কথা। তাই হয়ত তাকে আমি প্রথমে পাগল ভেবেছিলাম। ভয়ও পেয়েছিলাম।

আরও পড়ুন, শাক্যজিৎ ভট্টাচার্যের ছোট গল্প: উপনিবেশ

অবশেষে আমি তাকে জিগ্যেস করলাম, ‘দশ টাকা কী করবি তুই?’

অসেফ যেন বিরক্ত হল। সে তার স্বভাবসিদ্ধ ভঙ্গিতে বলল, ‘বেশি বক বক করিস না। জলদি দে। আমার কাজ আছে।’

তার কী কাজ আছে, আমি সেটা জানি না। আর জানার প্রয়োজনও বোধ করি না। হয়ত ফকিরবাবার মাজারের জন্য আগরবাতি কিংবা মোমবাতি কিনবে। যা খুশি কিনুক গে, আমার কী?

আপদ বিদেয় হোক ভেবে আমি তাকে দশটা টাকা দিই। সে চলে যায়। তবে যাওয়ার আগে আমাকে ফিসফিস করে বলে যায়, ‘পারলে সন্ধ্যার পর ল’পুকুরের পাড়ে আসিস একবার। একটা জিনিস দেখাবো তোকে।’

আমার হঠাৎ-ই মনে পড়ে গেল আমাদের সেইসব অতীত দিনের কথা। এই অসেফ যখন হাজেরার জন্য পাগল হয়নি কিংবা এরকম একজন পাগল প্রেমিকের চেহারা হয়নি তার তখন সে ছিল আমাদের গ্রামের আদর্শ ছেলে। পড়াশুনায় সে ছিল তুখোড়। খেলাধুলাতেও ছিল অপ্রতিদ্বন্দ্বী। পরোপকারে তার জুড়ি ছিল না। আমরা চোখের সামনে দেখেছি তার সেই সব গুণ। আর তার সেই সব গুণের জন্য আমরা নিজেদের বাপ-মায়ের কাছে যখন তখন অপমানিত হয়েছি। কথায় কথায় অসেফের তুলনা টেনে আমাদের অভিভাবকেরা আমাদের লজ্জা দিতেন। বলতেন, ‘অসেফের মতো ছেলের জন্ম দিতে পারলেও না হয় বুঝতাম দুনিয়ায় এসে কিছু নেকির কাম করলাম। তকদির বটে অসেফের বাপ-মায়ের যে আল্লা অমন ছেলে পাঠিয়েছে ওদের ঘরে।’ অভিভাবকদের এসব কথা শুনে আমাদের খুব রাগ হতো। সত্যি বলতে আমরা অসেফের মৃত্যু কামনা করতাম। মনে মনে খোদাতালার কাছে দোয়া করতাম, ছোঁড়াকে যেন সাপে কাটে আর সে মরে যায়। কিংবা এমন জ্বর হয় যেন ছোঁড়া পুড়ে মরে। কিংবা রংসাগরে নাইতে নেমে ডুব মারলে যেন আর না ওঠে, রংসাগরের পাঁকেই যেন তার দাফন হয়। তার লাশ যেন কেউ খুঁজে না পায়। কিন্তু আমাদের দোয়া খোদাতালা কবুল করতেন না। শেষমেশ আমরা হাল ছেড়ে দিয়েছিলাম।

তারপর-পরই অসেফের হাজেরার প্রেমে পড়া। এবং আমাদের আবার তার প্রতি আকৃষ্ট হওয়া।

এক এক করে আমার মনে পড়ে যাচ্ছে সেইসব কথা। আর কী জানি কেন, আমি আবার আগের মতোই অসেফের প্রতি সেই আকর্ষণ বোধ করতে লাগলাম। নাকি তার চেয়েও তীব্র কিছু? যাইহোক, কতক্ষণে সন্ধ্যা নামবে আমি একা একা তার অপেক্ষা করতে লাগলাম।

দুই  

হেমন্তের জ্যোৎস্না মাখা সন্ধ্যারাত। অসেফ ল’পুকুরের পাড়ে বসে আদেড়ার মাঠের দিকে মুখ করে আপন মনে গাঁজা টানছে। আমি তার কাছে যেতেই দিগন্ত বিস্তৃত আদেড়ার মাঠের দিকে তাকিয়ে সে বলল, ‘শেষপর্যন্ত এলি তাহলে?’

আমি বললাম, ‘হ্যাঁ।’

আমাকে অবাক করে দিয়ে জিজ্ঞেস করল, ‘এলি যখন পরি দেখবি- পরির নাচ?’

পরির গল্প হয় জানি। পরির গল্প অনেক শুনেছি। কিন্তু পরি যে চোখে দেখা যায় এতদিন শুনিনি তো!

কৌতূহল হয়। তাই হয়ত বলি, ‘হ্যাঁ দেখব।’

অসেফ আমার হাতে গাঁজার কল্কে ধরিয়ে দিয়ে বলল, ‘তাহলে চুপচাপ মাঠের দিকে তাকিয়ে থাক। চোখের পলক ফেলবি না। এক সময় ঠিক দেখতে পাবি।’

অসেফের কথা মতো আমি নিষ্পলক তাকিয়ে থাকি আদেড়ার মাঠের দিকে।

পাকা ধান কেটে নেওয়ায় মাঠটা দেখতে ঠিক সদ্য সন্তানহারা মায়ের কোলের মতো। তাহলে এমন মাঠে পরি নামবে কেন? শুধুই কি অসেফের ইচ্ছেই নাচার জন্য?

আমার মনে প্রশ্ন জাগে। অথচ আমি অসেফকে জিগ্যেস করতে পারি না। সে আমাকে চুপ থাকতে বলেছে। আমি ধৈর্য হারিয়ে তার ধরতে দেওয়া গাঁজার কল্কেতে টান দিই। আমার গাঁজার ঘোর ধরে। আর আমি দেখি একটা ধবধবে সাদা বক তার দুই ডানায় জ্যোৎস্না ঝরাতে ঝরাতে নেমে আসছে আদেড়ার মাঠে।

কে জানে এই বকটাই হয়ত অসেফের কাছে হাজেরা! যার প্রেমে পাগল হয়ে সে ল’পুকুরের পাড়ে দিনযাপন করছে।

short story
Advertisment