সঙ্গীতা দাশগুপ্ত রায়
“তুমি কি ভেতরে আসতে চাও?” বলে ছেলেটি দরজার দিকে পিঠ করে দাঁড়াল।
অল্প রোদে পোড়া চামড়ায় মেঘ ফুঁড়ে আসা সামান্য তেরছা রোদ্দুর মিশে উজ্জ্বল বাদামী রং। ফুলহাতা জামার হাতদুটি গুটিয়ে কনুইয়ের ওপর তোলা ফলে ছেলেটিকে দেখাচ্ছিল বেশ সুঠাম। ওইভাবে হাতা গুটিয়ে রাখলে অবধারিত ভাবে কিছু স্পষ্ট শিরা চোখে পড়ে এবং রেশনের ব্যাগ বা জলের বালতি তোলা হাতের কবজির ভাঁজে আটকে থাকা আহ্বান জাহ্নবীকে অন্যমনস্ক করে তোলে কিছুটা।
তুমি কি চাও ভেতরে আসতে? - দ্বিতীয়বারের প্রশ্নে জাহ্নবীর ঘোর ভাঙে। রাস্তার থেকে দুটি মাত্র ধাপ উঠে দরজা। সে দরজাকে কেন্দ্রে রেখে একটা দোতলা বাড়ি। বহুকাল জাহ্নবী কোন বাড়িতে থাকেনি। আস্তানায় থেকেছে বিভিন্ন। কখনও সরাইখানা গোছের কিছু কখনও ট্রেনের প্রতীক্ষালয় কখনও কোনো আশ্রমে কাজের লোকের বিশ্রামের ঘরে কেটেছে দিন রাত। কারশেডে পড়ে থাকা রেলের কামরায় দু তিনটি সারমেয় সঙ্গী নিয়েও রাত কেটেছে। তবে এই যে একখানা বাড়ি, যেখানে কিছু নির্দিষ্ট মানুষ নিয়মকরে ঢোকে থাকে বেরোয় এবং ফিরে আসে, এমন কোনো বাড়িতে বহুদিন থাকে নি তাই মুখ তুলে মুগ্ধতার সাথে বাড়িটাকে দেখে জাহ্নবী। ওপর তলায় সারি সারি চারখানি জানলা। প্রত্যেকটির পাল্লা বন্ধ তবে মনে হয় ডানদিক থেকে তৃতীয় জানলাটির পিছনে কেউ একজন আছে যে ওদের লক্ষ্য করছে ওপর থেকে।
“যদি আপত্তি থাকে তবে আমি তোমাকে আর কোথাও নিয়ে যেতে পারি - অল্প ঢেউ খেলানো চুলে আঙ্গুল চালিয়ে বলে এবার ছেলেটি”
“ন্ নাহ.. চল, আমি যেতে চাই... ওপরে” এই কথাকটা বলে হাঁফিয়ে যায় জাহ্নবী।
শুধু এই যে অল্প যতির পর ওপরে কথাটি বসায় তাতে মনে হয় মাত্র এবাড়ির দোতলার কথা বলছে না, বলছে এসবের থেকে অনেক অনেক উর্ধে অবস্থিত কোন প্রতীক্ষালয়ের কথাই বুঝি।
সিঁড়িতে পায়ের শব্দ খুব অল্প ওঠে। সিঁড়ি দেখে বোঝা যায় বহু ব্যবহৃত। মাঝবরাবর পায়ে চলার দাগ ফুটে উঠেছে কাঠের সিঁড়ির। যারা ওঠে নামে তাড়া ধারের রেলিংটি ধরে ওঠে নামে নিশ্চই কারণ রেলিঙের মাথাটি বেমানান রকমের মসৃণ।
“নিচে বাবা থাকে। মা মারা যাওয়ার পর থেকে বাবা আর ওপরে যেতে পারেন না। মা ওপরের ঘরেই মারা গেছিল। বাবার ধারণা মাকে সৎকার হয়নি...মৃতদেহটি ওই ঘরেই রয়ে গেছে এরকম কথা বাবা প্রায়ই বলে”- ছেলেটি ওপরে উঠতে উঠতে বলতে থাকে। জাহ্নবী কাঁধের ব্যাগটি একটু ঝাঁকি দেয় এক্কেবারে ওপরের ধাপটিতে গিয়ে।
“উনি তাহলে অসুস্থ?”
“কে অসুস্থ?”
“ তোমার বাবা?”
“কে বলেছে?” ছেলেটি আচমকা ঘুরে দাঁড়ায় ... “কে বলেছে অসুস্থ? বাবা সম্পূর্ণ সুস্থ। এ বাড়ির সমস্ত কাজ বাবাই একা হাতে করেন। তুমি বাবাকে অসুস্থ ভাবলে কেন?”
“মড়া স্ত্রী ঘরে রয়ে গেছে, সৎকার হয় নি এমন কোনো সুস্থ মানুষ ভাবে নাকি?”
ছেলেটি এগিয়ে এসে সেই রোদে ঘামে তৈরি হাতের আঙ্গুলগুলো দিয়ে আলতো করে জাহ্নবীর কনুই স্পর্শ করে "সুস্থতা শরীর নির্ভর। মানসিক চিন্তাভাবনায় আমাদের কোনো হাত নেই বুঝলে?"
জাহ্নবী ছোট্ট হাই তোলে । তলপেট ভারি হয়ে আছে। সামান্য সুযোগেই শরীর থেকে আধ লিটার জল বেড়িয়ে আসবে এবং মুখেও কিছুটা ঠান্ডা জলের স্পর্শ প্রয়োজন।
“পেচ্ছাপ করব”
“ওই দিকে, ওই ঘরটার পাশেই। ওটা আমার ঘর । এসো” ছেলেটি জাহ্নবীর ব্যাগটার দিকে হাত বাড়ায়, সদিচ্ছাতেই হয়ত জাহ্নবী সরে যায় একটু। রাস্তার মেয়ের ওটুকু সম্বল কারুর হাতে দেয় না।
বাথরুমে উবু হয়ে বসতে গিয়ে জাহ্নবী টের পায় হাঁটুতে প্রচন্ড ব্যাথা। আধবসা অবস্থায় জলমুক্ত হয়ে বেসিনের সামনে গিয়ে দাঁড়ায়। পিছনের পারা উঠে যাওয়া আবছা আয়না।
আরও পড়ুন, কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ গল্প
মুখে জল দিয়েই জাহ্নবী টের পায় আয়নায় দুজন আছে। অন্যজন ওর এক্কেবারে পাশেই, মাথায় মাথায় প্রায়। জলের ঝাপটাটুকু খুব জোরে মারে মুখে জাহ্নবী। খালি পেট। তার ওপর ছেলেটির সাথে ঝুপড়িতে দু পাত্তর নীট নিয়ে একবার শরীরখেলা। এক থেকে দুই দুই থেকে চার দেখা ওর কাছে অস্বাভাবিক না। তবু দেখে চোখ কচলে নিয়ে। হ্যা দুজনই। একজন উঁচু ঝুঁটি, বড় কপালের মাঝে একটা আড়াআড়ি কাটা চিহ্ন। একটু পুরু ফোলা ঠোঁট আর চোখের তলায় হালকা কালির প্রলেপ মুখে সদ্য ঝাপটানো জল, জাহ্নবী নিজেকে চিনতে সময় নেয় না।
আর অন্যটি গোলপানা, ভারি চিবুক, আবছা ভুরু জ্বলজ্বলে চোখ আর স্পষ্ট নাকছাবি ... জাহ্নবী এক ঝটকায় ফিরে তাকায়। আধো অন্ধকার বাথরুমের অন্য দেওয়ালে ওই ভারি চিবুক জ্বলজ্বলে চোখের ছবি। এমন ভাবে টাঙ্গানো যে এদিকের আয়নায় প্রতিফলনটা সোজাসুজি পড়ে।
বাথরুমে মানুষের ছবি রাখে নাকি লোকে? হয়ত রাখে। ও তো বাড়ির বাথরুম দেখেনি তেমন।
ভাবতে ভাবতে বেরিয়ে আসে জাহ্নবী। কিছুটা কম ক্লান্ত দেখায় ওকে।
“হল? ফ্রেশ লাগছে একটু?”
মাথা নাড়ে জাহ্নবী।
“তুমি মাছ খাও? বা মাংস? মানে তোমাকে এই দুদিন আমি মাঝ মাংস খেতে দেখিনি...এটুকু বলেই ছেলেটি একটু হাসে”
“তোমার নাম কি”? জাহ্নবী মাছ মাংসের প্রশ্নের উত্তরে পালটা প্রশ্ন করে
“সোমদেব। তুমি জাহ্নবী, তাই তো?”
“আচ্ছা। আমি কী সোমদেব ডাকব?”
“না তো কি? তুমি কি আমার বিয়ে করা বৌ যে ওগো হ্যাঁগো করে ডাকবে?”
“বন্ধ কেন ঘরের জানলাগুলো? কেমন গুমোট!”
“তুমি বললে না মাছ বা মাংস খাওয়ায় বাধা আছে কিনা”
“না নেই। ভাতের সাথে লঙ্কা পেলেই খাওয়া হয়ে যায় আমার। তবে কেউ তার থেকে বেশি কিছু দিলেও খাব সোমদেব”
দ্বিতীয়বার জাহ্নবী নামটা উচ্চারণ করে। ওর স-এর উচ্চারণে অল্প 'শ' ভাব আছে। ভালো লাগে সোমদেবের।
“তোমার শেলটার ইত্যাদির ব্যবস্থা বাবা করবে। আগে ফ্রেশ হয়ে নাও। গায়ের জামাটা ছেড়ে এগুলো পরে নিতে পার। মায়ের শাড়ি ব্লাউজ, কাচা সব। পোশাক পাল্টাতে চাইলে ওই কোণে...”
ঘরের অন্যদিকে একটা সুন্দর কাঠের জাফরির পার্টিশান। তার ওপাশেই তার মানে জামা পাল্টানোর ব্যবস্থা। সোমদেব ভরসা করে ওর হাতে ঘর ফেলে যেতে পারছে না।
“তুমি মনে হয় বেশ বড় বাড়ির মেয়ে, নয়?” বাটিতে ঝোল আলু আর মাংসের টুকরো ভাগ করতে শক্ত পেটানো চেহারার সোমদেবের বাবা প্রশ্ন করে।
“না, আমার মা আর দাদি গোবর কুড়োতো। আমি জন্মেছিও খাটালে। মার ব্যথা ওঠে গোবর তুলতে তুলতেই। খড়ের ওপর শুয়ে মা আমাকে জন্ম দেয়। দাদি সুতো কেটে আলাদা করে দেয়। তারপর আমাকে মনিবের বাড়িতে বেচে দেওয়া হয় আজন্ম কাজের কড়ারে”
সোমদেব রুটিগুলোকে নরম কাপড়ে মুড়ে টেবিলের ছোট বাখারির ঝুড়িতে রাখছিল। জাহ্নবী সেদিকে তাকিয়ে হাত বাড়ায় “আমাকে রুটি দাও।”
বাবার ভ্রুভঙ্গিতে বিরক্তির তীব্র আঁচড় ফুটে ওঠে “সালাদ নিয়ে আসি, তারপর রুটি দিচ্ছি আমি।”
শসা পেঁয়াজ টমেটোর ওপর গুঁড়ো নুন ছড়ানো প্লেটটির দিকে তাকিয়ে জাহ্নবীর আরাম লাগে। রুটি ছিঁড়ে মাংসের ঝোলে ডুবিয়ে খায় একটু একটু করে ।
“খাওয়া দেখেই কেমন ভদ্রবাড়ির মনে হয়। ঠিক বুঝেছিস তো? পরে ঝামেলা না হয়!” বেসিনে এঁটো থালা নামানোর সময় বাবা সোমদেবকে নিচু গলায় বলে।
“তিনকুলে কেউ নেই। পেটের ধান্দায় যা কাজ পায় করে। তবে মাথায় বুদ্ধি খুব। দুদিন ঘুরেছি তো সঙ্গে …” সোমদেব মাংসের বাটিটা ফ্রিজে তুলতে যায়।
“হুঁ তাহলে সময় নিস না বেশি”
সিঁড়িতে পায়ের শব্দ তুলে জাহ্নবী ওপরে উঠতে উঠতে খেয়াল করে সিঁড়ির রেলিংটা ভিজে। যেন কেউ ভিজে হাতে ওটা ধরে এখুনি ওঠানামা করেছে।এদিক ওদিক তাকায়। কাউকে দেখা যাবে? নিদেনপক্ষে কোনো ছবি। কিন্তু মাঝপথেই মাথা ভার হয়ে ঘুম নেমে আসে যেন চোখে। পিছন থেকে সোমদেব জড়িয়ে না ধরলে সিঁড়ি থেকে গড়িয়ে পড়ত নিশ্চিত।
“তাড়াতাড়ি ওপরে তোল” ভারি মুখের ছবির মহিলাকে সিঁড়ির মাথায় দাঁড়িয়ে থাকতে দেখা যায়। হাতের দড়িটাতে ফাঁস তৈরিই আছে। ছুঁড়ে দেয় সেটা। সোমদেব যেন কাঁপছে একটু। মাথায় দড়িটা গলাতে এত সময় লাগে নাকি? মহিলা নেমে এসে হাত লাগায়। ঝটকা টানে চেপে বসে দড়ি। সোমদেবের চোখ জ্বালা করে। ভোররাতের দিকে এই শরীরটাকে ও কিছু ঘেঁটেছে বলেই হয়ত। মেয়েটাকে বিশ্বাস করানোর মত ভালো কিছু কথাও বলেছে। শেল্টারের খোঁজ পাওয়া অবধি ওর কাছে থাকা ইত্যাদি।
রাতের অন্ধকারে হাইওয়ের ওপর মেয়েটাকে ধরাধরি করে ফেলে দিয়ে জঙ্গলের পাশে অপেক্ষা করতে করতে সোমদেবের মনে হয় এত লোভী কী করে হয়ে গেল ওরা? আর কোনো উপায় কি ছিলনা?
নিখুঁত প্ল্যান অনুযায়ী রাত আড়াইটে নাগাদ বিরাট গাড়িবাহী ষোল চাকার ট্রাক একেবারেই পিষে দিয়ে যায় জাহ্নবীর শরীর। কিছুটা মুখ আর ঘাড়ের কিছুটা চাকায় চাকায় আটকে মিরাট ছাড়িয়ে বেরিয়ে যায় হয়ত। একমাত্র জামাকাপড় আর একটু দূরে পড়ে থাকা পার্স ছাড়া সনাক্ত করার উপায় থাকেনা।
পোষ্ট মর্টেম রিপোর্ট লিখেছিল যে লোকটা তার নামি তাতিয়া। বাবার ছোটবেলার বন্ধু। এমনিতেই ভয়ঙ্কর অ্যাকসিডেন্টে শরীরটা রাস্তায় কিছুটা মিশেছে চাকায় কিছুটা খেয়ে গেছে। তায় চেনা বন্ধুর বৌ, মু বোলি ভাবি। তাতিয়া চোখটোখ মুছে রিপোর্টে মায়ের নাম ঠিকানা বয়স আর মৃত্যুর কারণে রোড অ্যাকসিডেন্ট, আন ইউজুয়াল ডেথ লিখে ছেড়ে দিয়েছিল। ডেথ সার্টিফিকেটটা শ্মশানে দাঁড়িয়ে নেওয়ার সময় সোমদেবের হাত কাঁপছে দেখে বাবা ওকে বুকে জড়িয়ে ধরে।
রাতে রুটি আর ডিমতর্কা।
“প্রতিবেশীরা উঁকি দিতে চাইছে। নেহাত দরজা জানলা বন্ধ তাই ভেতরে আসেনি কেউ” কথাটা বলতে বলতে মা তর্কার বাটি থেকে লঙ্কা তুলে কামড়ায়।
স্যালাদের চাকাচাকা শসা পেঁয়াজ কামড়ানোর শব্দের মধ্যে চাকার নিচে মাথা ফাটার শব্দটা ঢুকে যায়। সোমদেবের বমি উঠে আসতে থাকে। মা লক্ষ্য করেও মুখ ঘুরিয়ে নেয়।
“তুমি একেবারে ঘরের বাইয়ে যেও না। ওপরে তো উঠবেই না। আর তো ক’দিন মাত্র। ইন্সিওরেন্স কোম্পানির লোকজন আসবে একটা রুটিন ইনভেস্টিগেশনে। তারপর ক্লেমের চেকটা পেয়ে গেলেই এ বাড়ি বেচে মিরাট ছেড়ে গাঁয়ের দিকে চলে যাওয়া। যে টাকা আসবে তাতে হেসে খেলে চলে যাবে অনেককাল। একটা ব্যাবসার প্ল্যান আছে। সেটা লেগে গেলে তো বসে খেতে পারবে তারপর”, বাবা হাত চাটে লোভী বেড়ালের মত।
মাঝরাতে ঘুম ভেঙ্গে যায় সোমদেবের। খসখসে একটা শব্দ আসছে জাফরির ওধার থেকে। যেন কেউ সিল্কের শাড়ি গায়ে ঘষছে। লাফিয়ে ওদিকে গিয়ে দেখে।
জাহ্নবীর গায়ে যে জামাটা ছিল সস্তা কোনো কাপড়ের, সেটা পড়ে আছে। জামাটা পুড়িয়ে ফেলা হয়েছিল না? নিচু হয়ে তুলতে যেতেই দমকা হাওয়ায় জামাটা সরে যায়। দরজা জানলা বন্ধ করা ঘরে এত হাওয়া কোথা থেকে আসে কে জানে।
বাথরুমে যাওয়া দরকার। নিজেকে হালকা করতে করতেই আবার খসখসে আওয়াজটা কানে আসে। মুখে চোখে জলের ঝাপটা দিয়ে সামনের আয়নায় তাকিয়েই স্থবির হয়ে যায় সোমদেব। বন্ধ দরজার ছিটকানি আড়াল করে হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে আছে জাহ্নবী।
পুলিশ আসে অনেক বেলায়। সিঁড়ির মাথায় দাঁড়িয়ে বাবা আর দরজার আড়ালে দাঁড়িয়ে মা দেখে একমাত্র ছেলের শরীর সাদা চাদরে বেঁধে মর্গে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে।
আবার পোস্টমর্টেম রিপোর্ট আসে।
ঘাড়ের শিরা ছিঁড়ে মৃত্যু। মুখ থেঁতলে যাওয়ার কারণ হিসেবে লোহার বালতিতে মুখ থুবড়ে পড়া দেখানো হয়েছে।