Advertisment

ছোট গল্প: যস্মিন দেশে

দীর্ঘদিন ধরে সাহিত্যরচনার মধ্যেই বাস করছেন তিনি। এ পর্যন্ত তাঁর তিনটি গল্পগ্রন্থ ও একটি উপন্যাস প্রকাশিত হয়েছে। বাংলা আকাদেমি প্রদত্ত সোমেন চন্দ পুরস্কারও পেয়েছেন। আজ সেই অলোক গোস্বামীর গল্প।

author-image
IE Bangla Web Desk
New Update
NULL

ছবি- অরিত্র দে

সকাল হয়েছে অনেকক্ষণ। যেকোন সময় সূর্যটা লাফিয়ে উঠে রোদ ছড়িয়ে দেবে।  প্রাক শরতের সেই রোদ আদৌ মিঠে হবেনা। তবু প্রায় ঘন্টা খানেক ধরে মাঠের পশ্চিম কোণের বাবলা গাছটার নীচে দাঁড়িয়েই আছেন সোমনাথ পাকড়াশি। অনেকবারই পাঁয়তাড়া কষেছেন, এবার নেমে পড়বেন  মাঠে। কোনো সঙ্গীর প্রয়োজন নেই, একা একাই চক্কর মারবেন। পেছন থেকে কেউ ডাকলে ফিরে তাকাবেন না। এমন কী মুখোমুখি এসেও যদি দাঁড়ায় কেউ, এড়িয়ে যাবেন। কিন্তু অহেতুক দাঁড়িয়ে থেকে থেকে কোমর ব্যথা করাটাই সার হচ্ছে। প্রতিবারই শেষ মুহূর্তে কে যেন পা টেনে ধরছে!  তাকে সনাক্ত করতে গিয়ে সোমনাথের মর্নিং ওয়াকটাই মাটি হতে বসেছে। ওদিকে বাড়ি ফিরে যাবার উপায়ও নেই। এতক্ষণে সবাই নিশ্চয়ই উঠে পড়েছে। রোহনকে স্কুলে পাঠানোর জন্য যতই ব্যস্ত থাকুক তনিমা, শ্বশুরের ফিরে আসাটা তবু নজর এড়াবেনা। হাঁউমাউ করে উঠবে,“কী হলো বাবা, এত তাড়াতাড়ি ফিরে এলে যে! শরীর খারাপ লাগছে?”

Advertisment

শুধু এটুকুতেই রেহাই পাওয়া যাবেনা। এরপর তনিমা নির্ঘাৎ স্বামীকে বিছানা থেকে টেনে তুলবে,“শিগ্রি এসো, বাবার শরীর খারাপ লাগছে।”

সকালের প্রিয় ঘুম এভাবে চটে যাওয়ায় বিরক্ত চোখে এসে দাঁড়াবে রাহুল। তারপর প্রথম প্রশ্নটাই করবে,

“ওষুধগুলো ঠিক ঠাক খাচ্ছ? কখন ঘুমিয়েছিলে কাল?”

উফ,হয়েছে বটে আজকালকার ছেলেমেয়েগুলো। সব সময় শুধু শরীর আর শরীর। দুনিয়ার সব ম্যাগাজিনের একটাই বিষয়-স্বাস্থ্য। কী খেলে যৌবন দীর্ঘস্থায়ী হবে। কোন ফল আয়ু বাড়ায়। কোন সব্জী ক্যানসার ঠেকাতে পারে, ইত্যাদি ইত্যাদি। শুধু ম্যাগাজিন কেন, টিভির সবক’টা চ্যানেলই তো স্বাস্থ্য নিয়ে একটা প্রোগ্রাম থাকবেই। যতসব বুজরুকি। এমাসে একটা কথা বললো তো পরের মাসেই ভিন্ন কথা বলবে। অথচ তনিমা, রাহুল সেগুলোর একনিষ্ঠ  গ্রাহক-গ্রাহিকা। নিজেরা অনুসরণ করুক বা না করুক,অন্যকে করতে বাধ্য করবেই

ভাগ্যিস মালার তেমন কোনো  বাতিক ছিলনা। বিধাতার প্রতি ছিল অখন্ড আস্থা।  যার যতদিন পরমায়ু সে ততদিনই বাঁচবে, এমনটাই ছিল বিশ্বাস। সুতরাং বিধাতাকে অবিশ্বাস করেও সোমনাথ পেরেছিলেন একটা নির্ঝঞ্ঝাট জীবন কাটাতে। কিন্তু শেষ বয়সে মালা-ই কিনা বরাদ্দ পরমায়ুটাকে চুটিয়ে ভোগ করে সোমনাথের  বাকি জীবনটায় কাঁটা বিছিয়ে গেলেন! সামান্য একটু বুক ব্যথার কথা বলে ওভাবে আচমকা চিরতরে চোখ বুঁজে ফেলাটা তো পুরো বিশ্বাসঘাতকতা! ব্যস, তারপর থেকে তো শুরু হয়ে গেল পুত্র আর পুত্রবধূর অনুশাসন পর্ব

আরও পড়ুন, জোড়া অণুগল্প: লালন-ফকির

তাবলে কেউ যেন না ভাবে স্ত্রী মারা গেল আর সোমনাথ পাকড়াশি সুবোধ বালক হয়ে গেলেন। অঙ্কের দুঁদে অধ্যাপককে কব্জা করা অত সোজা! দিব্যি চলছিলো কাপের পর কাপ কফি আর রাত জেগে বই পড়া। বাদ সাধলো একদিন মাথাটার ঈষৎ দুলে ওঠা। হাতের কাছে কিছু না থাকায় পড়ে গিয়েছিলেন সোমনাথ। ভাগ্যিস রাহুল তখন অফিসে। শব্দ পেয়ে ছুটে এসেছিল তনিমা। ব্যস, শুরু হয়ে গেল আকচা আকচি। সোমনাথ যতই বলেন,“ ও কিছু না, গ্যাসের প্রবলেম।” তনিমা ততই কাঁদে আর বলে,“মায়ের বেলায় যে ভুলটা হয়েছে সেটা তোমার বেলায় কিছুতেই হতে দেবো না।”  

জোর করে টেনে নিয়ে গিয়েছিল ডাক্তারের কাছে।  তখনও মনে আশা ছিল সোমনাথের। কেননা ডাক্তার মানস রায় তো শুধু পাড়ার ছেলে নয়, সোমনাথের ছাত্রও। সে নিশ্চয়ই শিক্ষকের পাশে থাকবে

ভুল ভেবেছিলেন সোমনাথ। মানসও তো আজকালকারই ডাক্তার। ভিজিট না নিলেও একগাদা টেস্ট করানোর সুপারিশ লিখে দিয়েছিল। শুধু তাই নয়, রিপোর্ট দেখতে দেখতে গম্ভীর স্বরে বলেছিল,“ সবকিছুই প্রায় ডেঞ্জারাস লেভেলে স্যার। রেগুলার ওষুধ খেতে হবে কিন্তু নো মোর কফি। সবচে ইমপর্টান্ট হলো, বেশী রাত জাগা যাবে না”।

তারপরই মানস হেঁকেছিল সেই নিষ্ঠুর নিদান,“আর মর্নিং ওয়াক ইজ মাস্ট।”

ব্যস, এরপর অভিভাবক সাজার সুযোগটা পেয়ে গেল তনিমা,রাহুল। শুধু ওরা কেন,সাত বছরের নাতিটাও সোমনাথের অভিভাবক হয়ে বসেছে! যখন তখন এসে চোখের সামনে থেকে বইপত্র ছোঁ মেরে কেড়ে নিয়ে বলবে,“অতো পড়তে হবেনা।”

তাবলে কেউ যেন না ভাবে,ডাক্তার লিখে দিলো আর রোগীও সেই প্রেসক্রিপশনকে চোখের সামনে লটকে সাত সকালে বেরিয়ে পড়লো স্বাস্থ্য সন্ধানে। তারপরও বেশ কিছুদিন  মটকা মেরে বিছানায় পড়ে থেকেছেন সোমনাথ। যখন উঠেছেন তখন চারপাশে গনগনে রোদ। ওই রোদে হাঁটতে বেরিয়ে মাথা ঘুরে রাস্তায় পড়ে থাকবেন নাকি?

কৌশলটা ধরতে পেরে  ফের আদা জল খেয়ে লেগে পড়েছিল তনিমা। বাধ্য হয়ে বাড়ির কাছের মাঠের দিকে রওনা  দিতে বাধ্য হয়েছিলেন সোমনাথ। তবে মোটে দশদিন। তারপর সকালে উঠতেন বটে তবে বাইরে বেরুতেন না, ছাদে চেয়ার পেতে বসে থেকে পৃথিবীর ধীরে ধীরে জেগে ওঠাটা উপভোগ করতেন। সূর্য উঠে গেলে এক সময় চুপিসারে নেমে আসতেন

সাংসারিক কাজে ব্যস্ত থাকায় প্রথম কয়েকদিন চালাকিটা ধরতে পারেনি তনিমা, যেদিন পারলো সেদিন হাঁউমাউ করেনি। শান্ত গলায় জানতে চেয়েছিল,“ব্যাপারটা খুলে বলো তো। সমবয়সী বন্ধুদের ভালো লাগেনা তোমার? ইচ্ছে করেনা দুটো প্রাণের কথা বলতে!”

উত্তর দিতে পারেনি সোমনাথ। দিলেও লাভ হোত না। সিধেসাধা মেয়েটা বুঝতো না যে সমবয়সী হলেই কেউ বন্ধু হয়না। কিংবা বন্ধু হ’তে হলে সমবয়সী হওয়ার প্রয়োজন পড়েনা। তাছাড়া  ভালো লাগা কিংবা না লাগার ব্যাপারটা তো সোমনাথের ওপর কোনদিন নির্ভর করেনি। বরং অন্যরাই বরাবর তাকে এড়িয়ে চলেছে।

এই সমস্যাটার শুরু যৌবনে নয় বরং শৈশবে। অনেক নাতির মধ্যে বড়ছেলের ঘরের নাতিটাকেই বেশী পছন্দ করতেন ঠাকুমা। কেননা ঠাকুর্দার চেহারার সঙ্গে এই নাতিটার সবচে বেশী মিল। তাই ছুটিছাটায় দেশের বাড়ি গেলেই  সোমনাথের শোয়ার বন্দোবস্ত হতো ঠাকুমার পাশে। অনেক রাত অবধি পিঠে সুড়সুড়ি দিয়ে নাতিকে ঘুম পাড়াতেন ঠাকুমা। যতক্ষণ ঘুম না আসতো ফিসফিসিয়ে জানতে চাইতেন,“ তর মায়ে আমার নামে তর বাপের কাছে লাগানি ভাঙ্গানি করে, না রে? কী কয়?”

সোমনাথ অক্লেশে বলতেন,“না তো ঠাকুমা, কিচ্ছু বলে না তো!”

বাড়ি ফেরার পর মা যখন জিজ্ঞেস করতেন,“বুড়িটা তোকে পাশে শুইয়ে আমার নিন্দে করে, না রে?” তখনও একই উত্তর দিতেন সোমনাথ

আরও পড়ুন, ছোট গল্প: সঙ্গীত নন্দন

এর ফলে লাভ তো কিছুই হয়নি বরং ক্ষতি হয়ে গিয়েছে। ঠাকুমার পাশের জায়গাটা পেয়ে গিয়েছিল সোমনাথের পরের ভাই শিবব্রত। শুধু ঠাকুমা কেন, মায়ের কাছেও প্রিয় সন্তান হয়ে উঠেছিল শিবু। পরিবর্তনটা টের পেলেও কারণটা বুঝতে পারেননি সোমনাথ। যখন পারলেন ততদিনে স্কুলজীবন শেষ। কিন্তু অভ্যেসটা ততদিনে মজ্জাশ্রয়ী হয়ে পড়ায় নিজেকে বদলানো সম্ভব হয়নি। ফলে কলেজ কিংবা বিশ্ববিদ্যালয় পর্বটাও একাই কাটাতে হয়েছিল।  

চাকরি পাবার পর খানিকটা স্বস্তি পেয়েছিলেন সোমনাথ, যাক, এতদিনে দুঃখের দিন শেষ হলো। সহ অধ্যাপকরা নিশ্চয়ই অতটা বালখিল্য হবেন না! কিন্তু বছর ঘোরার আগেই চুরমার হয়ে গেল স্বপ্ন। কালীপদ গুছাইত এসে যা তা বলে যাচ্ছে তপন বাঁড়ুজ্যের সম্পর্কে, আবার কালীপদ যেতেই তপন হাজির,“ কী বলছিল কেলে ব্যাটা আমার নামে?”

সোমনাথ যতই মাথা নাড়ান, তপন কিংবা কালীপদ, কেউই বিশ্বাস করতো না। না করারই কথা। দুজনেই তো স্ব স্ব বিষয়ে গোল্ড মেডালিস্ট। সত্যি-মিথ্যেও ফারাক বুঝতে অসুবিধে হওয়ার কথা নয়। সুতরাং তারপরও কালীপদ আর তপনের গলায় গলায় দোস্তি  থাকতো আর অবাঞ্ছিত হয়ে পড়তেন সোমনাথ পাকড়াশি

সবচেয়ে বড় ঝামেলাটা হয়েছিল চামেলী  দস্তিদারকে নিয়ে। কলেজে জয়েন করা মাত্র খবর চলে এসেছিল, মেয়েটার সাতজন প্রেমিক। শুনে গর্বই হয়েছিল সোমনাথের, যাক,তার ডিপার্টমেন্টে এমন একজন অন্তত আছে যে সাতজনের সঙ্গে মানিয়ে চলতে জানে। ইচ্ছে ছিল সুযোগ পেলে কৌশলটা জেনে নেয়ার কিন্তু সে সুযোগ এলো কোথায়!

প্রায়ই শেষ ক্লাসগুলো সোমনাথকে গছিয়ে কেটে পড়তেন চামেলী। অন্যরা ওস্কানোর চেষ্টা করলেও  আপত্তি করতেন না সোমনাথ, আহা, সাতজন প্রেমিক বলে কথা! তাদের সময় দিতে হবে না? একদিন শুধু ব্যক্তিগত কোনো অসুবিধের কারণে অপারগতার কথা জানিয়েছিলেন সোমনাথ। সেটাও যথেষ্ট লজ্জা এবং বিনয় সহ। কি‌ন্তু তাতেই চামেলী কান্নাকাটি করে সিন ক্রিয়েট করেছিলেন। অভিযোগ করেছিলেন,সোমনাথ নাকি সুযোগ পেলেই তাকে অপমান করেন! তুমুল হইচই হয়েছিল এবং যথারীতি কাউকে পাশে পাননি সোমনাথ

এরপর বিয়ে নিয়ে স্বপ্ন দেখেছিলেন সোমনাথ। স্ত্রীর সমার্থক শব্দ তো সহধর্মিনী। স্বভাবের চেয়ে বড় ধর্ম আর কী  আছে! সেটুকুর মিল মানেই সার্থক দাম্পত্য। কিন্তু সে স্বপ্নটা ভেঙে যেতেও বেশি সময় লাগেনি। শরীর থেকে নতুন বউয়ের গন্ধ মোছার আগেই শ্বশুরবাড়ির লোকদের কোনটা মুখ আর কোনটা মুখোশ, সেটা ধরে ফেলতে অসুবিধে হয়নি মালার। বাধ্য হয়ে ভিন্ন সংসার পেতে ছিলেন সোমনাথ। লাভের মধ্যে লাভ হয়েছিল,মৃত্যু অবধি ছেলের সঙ্গে কথা বলতেন না সোমনাথের বাবা

আরও পড়ুন, হত্যা হাহাকারে – অপরাধসাহিত্যে বিনির্মাণ ও আধুনিকতা

তাতেও কি সন্তুষ্ট করা গিয়েছিল মালাকে? বরং শেষ দিন অবধি সোমনাথকে ব্যঙ্গ করে বলেছেন,“পৃথিবীটা আমাদের  মতো পাপীদের জন্য। তুমি তো দেবতা। তোমার জন্য স্বর্গই আসল জায়গা।”

অথচ সোমনাথকে ফেলে মালাই কিনা আগে ভাগে স্বর্গে চলে গেলেন ড্যাঙডেঙিয়ে। অবশ্য সেটা একদিক থেকে ভালোই হয়েছে। সব সময়ে কৃত্রিম দুঃখে ভুগতেন।  এমন কী এতো ভালো ছেলের বউ পেয়েও সুখী হতে পারেননি। কারণ প্রেম করে বিয়ে করেছে রাহুল। অথচ চিন্তাভাবনায় আধুনিকই ছিলেন মায়া

মালার মৃত্যুসংবাদ পেয়ে অনেকে এসেছিল। সবাই শুনিয়ে গিয়েছে মালার মাহাত্ম্য সংবাদ। শুনতে শুনতে অবাক হয়েছেন সোমনাথ, এত গুণ ছিল নাকি তাঁর সহধর্মিণীর! কই, গত আঠাশ বছরে টের পাননি তো!

সুতরাং তনিমার প্রশ্নের উত্তর দিতে পারেননি সোমনাথ। শোনাতে পারেননি গত দশদিনের মর্নিং ওয়াকের অভিজ্ঞতা যার কারণে ওই লুকোচুরি খেলা

সকালের স্বাস্থ্যসন্ধানীরা বন্ধু না হলেও অধিকাংশই যেহেতু পরিচিত তাই সামান্য কুশল বিনিময়ের পরই তাদের সঙ্গে হাঁটতে শুরু করেছিলেন সোমনাথ। প্রথম পাকটায় আলোচনার বিষয় ছিল স্বাস্থ্য। মোটামুটি সায় দিতে পেরেছিলেন সোমনাথ। দ্বিতীয়টায় এসেছিল রাজনীতি। বিষয়টা প্রিয় হওয়ায় পিছিয়ে ছিলেন না সোমনাথ। আন্তর্জাতিক তথা দেশীয় রাজনীতি বিষয়ে আহরিত জ্ঞান উগড়ে দিয়েছিলেন। সমস্যাটা শুরু হয়েছিল তৃতীয় পাকের সময় থেকে। এবারের বিষয় পরনিন্দা পরচর্চা। মুন্ডুপাতের সেই তালিকায় পাড়া প্রতিবেশীর নাম তো বটেই এমন কী স্ত্রী,পুত্র,কন্যা,জামাতা, পুত্রবধুরাও হাজির। ব্যাপারটা অসহ্য হয়ে উঠেছিল যখন দেখেছিলেন মুণ্ডপাতের তালিকা থেকে  নাতি নাতনিরাও রেহাই পাচ্ছেনা

এরপর গতি কমিয়ে পিছিয়ে পড়তে বাধ্য হতেন সোমনাথ। সুযোগ বুঝে এক সময় কেটেও পড়তেন। পরপর দশদিন একই ঘটনা ঘটায় এগারোতম দিন থেকে বাইরে বেরোনোর বদলে ছাদে বসে থাকতেন সোমনাথ

হয়তো  আর কোনদিনই আসতেন না। তনিমা বাড়াবাড়ি করলে হাতজোড় করে রেহাই চাইতেন। কিন্তু গতকাল রাহুলের কথাগুলো এমন জবরদস্ত খোঁচা মেরেছে যে সারা রাত ঘুমুতে পারেননি। অপেক্ষা করেছেন। আলো ফোটা মাত্র বেরিয়ে এসেছেন মাঠে। যতটা না মর্নিংওয়াকের জন্য, তারচেয়েও বেশি কথাগুলোর হাত থেকে রেহাই পাবার জন্য

কেউ শুনলে হয়তো ভাববে, কথাগুলো তো সরাসরি বাবাকে বলেনি রাহুল, বলেছে নিজের স্ত্রীকে। স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে এমন গোপনীয় কথা তো কতই হয়! বরং সোমনাথেরই উচিৎ হয়নি তাতে কান দেয়া। কিন্তু সোমনাথ তো শুনতে চাননি। বরং কথাগুলোতে এতটাই তেজস্ক্রিয়তা ছিল যে সেগুলো দেয়ালের বাঁধন মানেনি। ইট ভেদ করে এঘরে এসে সোমনাথকে এফোঁড় ওফোঁড় করে দিয়েছে

--আরে, কেন ফালতু ঝামেলা করছো। লোকটা চিরকালই এরকম একলষেঁড়ে। মানুষকে মানুষ মনে করে না। নিজেকে বিশাল কিছু ভাবে। এই যে আমি, একমাত্র ছেলে, আমার সঙ্গেও কোনদিন সেভাবে মিশেছে! এনিয়ে মায়ের অনেক দুঃখ ছিল। সেই দুঃখ বুকে চেপে রাখতে রাখতেই তো মা ওরকম দুম করে  চলে গেল

ছেলে বাপকে একলষেঁড়ে বলছে শুনে ততটা দুঃখ পাননি সোমনাথ। কিংবা তিনি নিজেকে বিশাল কিছু ভাবেন, মানুষকে মানুষ ভাবেন না, তা নিয়েও নয়। আঘাতটা বেজেছিল অন্যখানে। একমাত্র ছেলেকে ভালোবাসেননি সোমনাথ? তা নিয়ে দুঃখ ছিল মালার? কোনদিন বলেননি তো! তাহলে তো সত্যিই মালার মৃত্যুর  জন্য সোমনাথই দায়ী!

সূর্যটা একলাফে উঠে এসে মুখে সরাসরি ফোকাস মারতেই ধাতস্থ হলেন সোমনাথ। মাঠ এখন মর্নিং ওয়াকারদের  কবল মুক্ত হয়ে খেলোয়াড়দের অধীনে চলে এসেছে। চারদিকে তাকালেন সোমনাথ, কোথায় গেল পরিচিত মানুষগুলো? এত তাড়াতাড়ি বাড়ি ফিরে গেল নাকি!

দমকা হাসির শব্দে সোমনাথ খেয়াল করলেন সবাই গিয়ে বসেছে মোড়ের চায়ের দোকানে। অর্থাৎ এখন চা বিস্কুট সহযোগে আরেক দফা প্রিয়জনদের মুণ্ডপাত চলবে, তারপর আজকের অধিবেশন খতম হবে। এসব জানা থাকা সত্বেও পায়ে পায়ে এগোলেন সোমনাথ

--কী,আমাকে ফাঁকি দেয়া হচ্ছে! কই,আমার চা বিস্কুট কোথায়? মিষ্টিটা যেন কড়া হয়

গোটা দলটা ঘাড় ফিরিয়ে সোমনাথকে দেখতে পেয়ে হইহই করে উঠলো

--আরে আপনি, এই অধমদের দলে!

--এই বিষাক্ত চা খাবেন!

--আপনার জন্য তো গ্রিন টি বানিয়ে রেখেছেন আপনার বউমা!

--সঙ্গে সুগার ফ্রি ডাইজেস্টিভ বিসু্কট

--এসব ছোটলোকি ব্যবস্থা তো আমাদের মতো ভাগারের শকুনদের  জন্য

সম্মিলিত আক্রমণে যে খেই হারানোর উপক্রম হচ্ছে সেটা টের পেলেন সোমনাথ। গলা শুকিয়ে আসছে। পা দুটোও এমন কাঁপছে, কে জানে কতক্ষণ ভার ধরে রাখতে পারবে!

--একটু বসতে দিন

আদেশ মেনে সবাই সরে গিয়ে বসার জায়গা করে দিতেই জীবনে প্রথমবার রাস্তার ধারের চায়ের দোকানে বসলেন সোমনাথ। তারপর এগিয়ে দেয়া চায়ের কাপটায় চুমুক দিয়ে কাঁপাকাঁপা গলায় শুরু করলেন,“ রাখুন তো মোশায়, ছোটলোক-ভদ্রলোক। সংসারে রিটায়ার্ড মানুষের কোন মান সম্মান থাকে! আমরা কি আদৌ ভদ্রলোকের পর্যায়ে পড়ি? আর ওই গ্রিন টি আর ডাইজেস্টিভ বিস্কিটা না কী যেন বলছিলেন, শুনুন তবে.....”।

Bengali Literature Bengali Short Story
Advertisment