Advertisment

ছোট গল্প: মরুৎ

কবিতা দিয়ে লেখা শুরু করলেও ছোট গল্পের ভুবনকেও আবিষ্কার করার সাধ ও সাধ্য দুই-ই রয়েছে সৌম্যদীপ বন্দ্যোপাধ্যায়ের। একদা জাতীয় স্তরের সাঁতারু, এ পরিচয়টা তাঁর সঙ্গে লেগে থাকে আজও। আজ সৌম্যদীপের গল্প।

author-image
IE Bangla Web Desk
New Update
NULL

ছবি- অরিত্র দে

সকালে ব্রাশ করে আয়নার সামনে দাঁড়িয়েই বিনোদের মনে পড়ল, এবার চুলটা কাটতে হবে। বছর পাঁচেক ধরে চুল পাতলা হয়ে আসছে, পেটের সাথে ব্যস্তানুপাতিক হারে।  ক্রমশঃ এদিক ওদিকের অবাধ্য অসমান চুল গুলোকে এবার মোড়ানো নিতান্তই দরকার।  বেমক্কা প্রাক্তন কোন এক মন্ত্রী ফৌত হওয়ায় আজ  চারিদিকে পতাকারা হাফ গুটিয়ে আছে। ছেলে মেয়ে বউ সবার স্কুল ছুটি, পরের দিন রোববার- এই ফাউ পেয়ে সবাই দুদিনের জন্য গেছে বাঁশদ্রোণী, তার ছোট শালার বাড়ীতে।  বউ এর থেকেও বউ এর চা খুব মিস করে বিনোদ, বিশেষ করে সকাল বেলা। আগে, মানে যখন অফিস ছিল তার, তখন আদ্ধেক দিনই অফিসের ক্যাফেটেরিয়াতেই ব্রেকফাস্ট থেকে পারলে ডিনার টাও সেরে আসতো সে। কিন্তু, সে ঝামেলা চোকার পরে, বউ স্কুলে বেরোবার আগে এক টেবিলে বসে চা খাওয়াটা তার প্রায় দু বছরের অভ্যেস হয়ে গেছে। সকালে ভারী ভারী ব্যাপার চিন্তা করা তার একটা প্রিয় টাইম পাস। আচ্ছা এই যে বর বেকার আর বউ সংসার চালাচ্ছে, এই রোল রিভারসাল টা সমাজ বিজ্ঞানীরা কী কী ভাবে দেখবেন, এই সব আবোল তাবোল ভাবতে সে রাস্তায় বেড়িয়ে পড়ল। কেশরঞ্জন বলে যে সেলুনে সে ছোট বেলা থেকে চুল কাটতে যেতো সেখানে না পোষানোয় নাদু নাপিত পঞ্চাশ মিটার দূরেই আরেকটা জায়গা ভাড়া করে একটা সাদা বোর্ডে, এ ১ সেলুন নীচে ছোট ব্র্যাকেটে আমাদের কোন শাখা নেই, লেখা একটা নতুন সেলুন খুলেছে। রাতে  সেখানে একটা নীল আলো  জ্বলে, তবে ১ লেখা অংশটা জ্বলছে না বেশ কিছুদিন। পুরনো খদ্দের বলে তাকে অল্প বিস্তর খাতির যত্ন করে নাদু, দোকানে সবে দিয়ে যাওয়া চায়ের ফ্লাস্ক থেকে তাকে একটা প্লাস্টিকের কাপে চা এগিয়ে দেয়। দুজনের পরে তার লাইন। ঠিক আছে, তার সময়ের অভাব নেই – দোকানে আসা আজকের কাগজ এখন বেশ কয়েক ভাগ হয়ে জনা চারেক খদ্দেরের হাতে হাতে ফড় ফড় করছে, একজনের হাতের কাগজের পিছনের থেকে এক লাস্যময়ী মুখে এক ইঙ্গিতময় আঙ্গুল গুঁজে খুব সম্ভবত সবাইকে চুপ করার অনুরোধ জানাচ্ছেন। তার উল্টোদিকে বসা সিরিঙ্গে পানা কদম ছাঁট দাড়ি অলা ভদ্রলোক উত্তেজিত ভঙ্গীতে কাগজের প্রথম পাতায় একটা কলামের দিকে আঙ্গুল দেখিয়ে পাশের বেঁটে খাটো গোলমাটোল আরেকজনকে উদ্দেশ্য করে বললেন, এই যে ঘোষ দা দেখ দেখ। তোমরা তো ভাল কিছুই দেখতে পাওনা, দেখ দেখ শহরে ঝুলন্ত রেস্তোরাঁ খুলছে, এই প্রথম।  দ্বিতীয় ভদ্রলোক খুব একটা উৎসাহ না দেখানোয় সিরিঙ্গে জোরে জোরে বিশেষ খবরটা  আবার পড়তে শুরু করে দিলেন। বিনোদ এর হাতে যে কাগজের যে অংশটা জুটল, সেখানে প্রথম পাতাতেই একটা বড় গাছের ডালে একটা ফাঁসে ঝোলা মানুষের সিলুএট, দেখে মনে হয় দুলছে।

Advertisment

বিনোদ জানলা দিয়ে বাইরে তাকাল, অমলতাস গাছটার ওপর শীতের রোদ্দুর পড়েছে- দুটো কাঠ বেড়ালি নিজেদের মধ্যে খুনসুটি করছে। ভিতরে একটা চেয়ার খালি হল, আরেক জনের পরেই তার পালা। নদু ভয়ানক রফি ভক্ত, এখন সারা সেলুন জুড়ে শাম্মি কাপুরের ঠোঁটে  - চাহে কোই মুঝে জাংলি কহে ছড়িয়ে যাচ্ছে।  ঠিক তখনই সেলুনে ঢুকল অভী, বিনোদের সাথে একই ক্লাসে পড়তো মাধ্যমিক পর্যন্ত। বাড়ী ও একই পাড়াতেই প্রায়, উলটোদিকের হালদার বাগানে যে বস্তীটা এখন পাকা হয়েছে, সেখানে দুটো ঘরে অভী দের পাঁচ জনের ফ্যামিলি।  ঢুকেই বিনোদ কে দেখে অবাক। বলল, আরে বিনু তুই...চ একটু বাদে নাহয় চুল কাটবি। একটা ভাল মজা হয়েছে দেখবি আয়। অভী স্কুলে থাকতে দুজনের ঘনিষ্ঠতা ছিলনা একদমই, বিনোদের বাবার যদিও সদ্য ফ্ল্যাট কিনে উঠে আসা পাড়ায় ছেলের সহপাঠী দের পরিবার সংগতি ইত্যাদি নিয়ে মাথা ঘামানোর সময় ছিলোনা, কিন্তু তার মায়ের সবসময়েই ভয় ছিল ওদের সাথে মিশে ছেলে উচ্ছন্নে না যায়। সে কারণেই হোক, বা বেশীরভাগ সময়েই স্কুলে দুজনে আলাদা সেকশনে থাকার কারণেই হোক ওর সাথে না মেশার জন্য বিনোদ কে বিশেষ কষ্ট করতে হয়নি। কিন্তু, বেশ কিছু বছর পরে, পাড়ায় ঢোকার মুখে এক মদ্যপ রিক্সার নালার হড়কে যাবার ফলে তার মার মাথায় প্রবল চোট লাগে। বাবা তখন নেই।  মিউনিসিপ্যালিটির কর্মী অভী তখন কোন মন্ত্রবলে লোক জন, রক্ত, হাসপাতাল ইত্যাদি জোগাড় করে ফেলেছিল কে জানে। এমনকী তখন ইউরোপিয়ান ক্লায়েন্টের গো লাইভ থাকায়, তার অফিস থেকে ছুটি নেওয়া বিশাল চাপ, তা জেনে দিনরাত হাসপাতালে অভীই পড়ে ছিল। অকে নিশ্চিন্ত করেছিল, আরে আমার তো ছুটির অসুবিধে নেই, ম্যানেজ হয়ে যাবে। তুই অফিস যা। কাকিমার জন্য চিন্তা করতে হবেনা। হয়ওনি। সেইদিন থেকে তার মা, এই তিন বছর আগে মারা যাওয়া অবধি হয়ত অতীত অপরাধবোধ ভুলতেই সপ্তাহে অন্তত একবার অভীকে ডেকে খাওয়াত। অভী কী কিছুই বোঝেনি, সে জানে না। তবে এই নিয়ে দুজনের মধ্যে কোনদিন আলোচনা হ্য়নি। তবে তার কৃতজ্ঞতা ক্রমে ক্রমে গাঢ় বন্ধুত্বের হাত ধরে।  তারপরে দুজনেরই সংসার হওয়ায় যোগাযোগ কমেছে কিছুটা, কিন্তু এই রকমই মাঝে মাঝে অভী বিনোদকে কোন না কোন অদ্ভুত জিনিসের কথা বলে ডেকে নিয়ে গেছে, নিজের পুরনো হিরো বাইকে করে।  শেষ বার এই চক্করে তার কপিল মুনির আশ্রম ঘুরে দেখা হয়ে গেছিল, সুতরাং এবারও সে আপত্তি করলনা। প্রশ্নও নয়, কারণ সে দেখেছে এই সব অদ্ভুত জিনিসের সাসপেন্স ধরে রাখার ব্যাপারে অভীর খুব সচেতন। তাই, হু হাঁ ছাড়া কোন উত্তর পাওয়া যাবেনা সে জানে।

২)

ল্যান্ডস্কেপটা বদলে গেছে হঠাৎ করে।  বটগাছ, পানা পুকুর, ভাঙা চোরা ইট খিঁচনো রং ওঠা বাড়ী, মাঝখানে হঠাৎ একটা দুটো পুরোনো দিনের বনেদী মহল সেসব ছাড়িয়ে কোনো ময়দানব যেন শূন্য থেকে গড়ে তুলেছে আকাশ প্রমাণ সব টাওয়ার। রাস্তায় বাহারী বাহারী প্রকান্ড টবে রকমারী ফুল, ঝকঝকে তকতকে দোকান সম্পূর্ণ এক অন্য জগতের দেব দূত রা এই নন্দন কাননে ঘোরা ফেরা করে আর তারপর অদৃশ্য হয়ে যায় টাওয়ারের মধ্যের মহার্ঘ ফ্ল্যাটে। বেশ কবার ইউরোপ আমেরিকা করেছে বিনোদ, এই নতুন এলাকাকে তার অনেকটা এরমই লাগে, খুব সুন্দর চকমকে। কিন্তু কেন জানেনা, নিজের মনে হয়না।  তাই অভী যখন তাকে এনে এলাকার সবচেয়ে নামী, ওয়েস্ট উইন্ড শপিং মলের এন্ট্রান্সের কাছে এসে থামলো, অবাকই হলো সে। অভীই এবার আঙ্গুল দিয়ে পার্কিঙের দিকে দেখালো! ওই দেখ দেখতে পাচ্ছিস?  সেদিকে তাকিয়ে একটা জটলা ছাড়া কিছু দেখতেই পেলোনা বিনোদ। অভীর দিকে একটা এসবের-মানে-কী-ব্যঞ্জক দৃষ্টি দিয়ে তাকালো সে। অভী এইটার জন্যেই অপেক্ষা করছিল যেন, বলল সকালে এদিক দিয়ে যেতে গিয়ে দেখি ব্যাপক হাললাক। একটা বুড়ো নাকি তার বাড়ী হারিয়ে ফেলেছে বলে মলে কান্নাকাটি জুড়েছে! ওখানেই নাকি ওর বাড়ী!  যাবি নাকি একবার মজা দেখতে। এইটা হচ্ছে ট্রেডমার্ক অভী, পাঁচঘন্টা বাইক ছুটিয়ে কোন প্রাচীন টেরাকোটা মন্দির দেখতে গিয়ে, সেখানের গেটে পৌঁছে জিজ্ঞেস করেছিল, ভিতরে যাবি?  আলতো করে একবার ঘড়ি দেখল বিনোদ, এতক্ষণে তার চুল দাড়ি কাটা হয়ে গেছে, বাড়ী এসে কালকের কেনা বইটা র পাতা উল্টানোও হয়ে যেত। খুব খিস্তি করতে ইচ্ছা করছিল অভীকে। সেটা সামলে সে শুধু বলল, চ আর ন্যাকামি করতে হবে না।

আজকে ছুটির সকালবেলা তাই বাইক পার্ক করতে খুব একটা অসুবিধে হলোনা অভীর। জটলার কাছাকাছি গিয়ে বিনোদ একটা পান ওলাকে জিজ্ঞেস করলো, ব্যাপারটা কী। খুব মনোযোগ দিয়ে সামনের বালতি থেকে নেওয়া একসাথে দশটা পানপাতায় খয়ের লাগাতে লাগাতে সে উদাসীন উত্তর দিলো, এই একটু আগে ওই বুড়া আদমী (বলে ভীড়ের মধ্যবর্তী একটা বছর ষাট থেকে সত্তরের লোকের দিকে আঙ্গুল দেখালো) সক্কাল সক্কাল এসে কী সব সওয়াল জবাব করছে। এখান থেকে অকুস্থলটা ভালোই দেখা যাচ্ছে, একটু এগিয়ে যেতেই একটা তীব্র গলার স্বর কানে এল বিনোদের, ভিজে ভিজে ভেঙে গেছে তাই অল্প খোনা শোনাচ্ছে। ‘হ্যা গো বাবু- আমার বাড়ীটা কোথায় গেল বলতো?  বলোনা বাবুরা !’  চোখাচোখি হতেই পানের দোকানের সামনে দাঁড়ানো, গেঞ্জিতে 'আই এম সেক্সি এন্ড আই নো ইট' লেখা পাঁচফুট দু ইঞ্চির  লোকটা নিজের রক্তাক্ত দাঁতের ফাঁক গলিয়ে একটা ব্যাকা হাসি হেসে আঙ্গুল নিজের মুখের দিকে নিয়ে একটা ইশারা করলো, যার অর্থ সকাল বেলাতেই টেনে এসেছে বুড়ো।

বিনোদও কীরকম একটা ব্যোমকে গেল। বাড়ী! খুঁজে পাচ্ছেনা, এখানেই ছিল ! ঠিক শুনলতো! স্কিজোফ্রেনিক নাকি ?

লোকটাকে স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে এবার। বুড়োই বলা চলে। একটা ময়লা ফতুয়া আর হেঁটো ধুতি, পায়ের চটিটা মেরামত হয়েছে অন্তত বার কয়েক। পাঁচ কম বেশী সত্তর মত বয়স হবে। বয়সের নিয়মিত হালচাষে মুখের মাটি ছেনে হনুর হাড় এগিয়ে রয়েছে খানা খন্দ ভরা চামড়া ঘিরে। পিচুটি পড়া ঘোলাটে চোখদুটোর দিকে তাকিয়ে খালি পেট গুলিয়ে উঠল বিনোদের।

এর মধ্যে চারিদিকে বেশ একটা ভীড় জড়ো হয়ে এসেছে, অন্যান্য দিন যে সব হাড় হাবাতেরা এই ফুটপাথ মাড়ানোর সাহস পেতোনা, তারাও জমিয়ে তুলেছে। চেটে পুটে নিচ্ছে কাঁচের জানলায় লাগানো সুবেশ নর নারীর পোস্টার, ডাক্ট দিয়ে বেরিয়ে আসা লেবু পাতা গন্ধ। এখানের দোকান পাট খুলতে আর ঘন্টা দুয়েক বাকী। নমস্কার জানিয়ে আর দরজা খোলা বন্ধ করতে করতে বাইসেপ গজিয়ে ফেলা রোগা সিকিউরিটিরা তাই এখন একটু ঢিলেতে আছে. তবু তারই মধ্যে একজনকে এদিকে আসতে দেখা গেল। তারও বুটের নানা জায়গা ফেটেফুটে গেছে তবু গাম্ভীর্য কমেনি। বুড়োর কলারের দিকে তার হাত টা এগোচ্ছে- এমন সময় বুড়ো আবার জোরসে ককিয়ে উঠলো – হ্যা গো বাবু- আমার বাড়ীটা কোথায় গেল বলতো?  বলোনা !

কী সব বলছে মাইরি!

সকাল সকালই মাল খেয়েছে শালা!

আরে পাগলা হ্যায়। ছোড়!

যাকে ঘিরে আশপাশ থেকে এত মন্তব্যের ঝড় বয়ে গেল সে কিছুটা হতবুদ্ধির মতই এখনো মেরুন সোনালী অট্টালিকার সামনে তাকিয়ে। সিকিউরিটি নিশ্চয়ই তার এযাবৎকালীন অভিজ্ঞতায় এরকম প্রশ্ন কোনদিন শোনেনি – এ মুহূর্তে তার হাত টা বুড়োর ময়লা কলারের ইঞ্চি ছয়েক দূরে স্তম্ভিত ত্রিশঙ্কু  হয়ে ব্রেনের থেকে পরবর্তী তড়িত চুম্বকীয় নির্দেশের অপেক্ষা করছে।

বুড়ো কঁকিয়ে উঠেছে আবার , এত্ত গমগমে কারখানা, শ চারেক লোক। রোজ সকালে আমার এই রুটি আলুদ্দম এর দোকানে ভীড় করে খেয়ে কারখানায় ঢুকে যেত ভোঁ বাজলেই। এই তল্লাটে এরম আলুদ্দম কোত্থাও পাবেন না, বাবলুর মা যা বানাতো না।

এর পর বুড়ো একটু থেমে যেন সেই হারিয়ে ফেলা আলুর গন্ধ নেয়...।তারপর  আবার গলা তোলে ‘হ্যাঁ গো ও বাবাঠাকুরের দল। এইতো সেদিন কারখানা ছুটি হবার পর মিষ্টির দোকানে পানু কে বলে গেলাম, বাবা আমার দোকানটা দেখিস দুদিন, আমি একটু গেরামে যাচ্ছি। ওমা, এসে দেখি পানু নেই তার মিষ্টির দোকান নেই এমনকী আমার দোকান ও নেই! কারখানাও নেই, রোজ সকালের রুটি আলুদম ডিমসিদ্ধ খেয়ে কারখানায় ঢুকে যাওয়া লোকগুলোই বা গেল কোথায়? আর আমার বাড়ী! সেটাই বা কোথায় গেল। কোথায় গেল আমার বাড়ী? কোথায় কোথায়? ও বাবুমশাই রা।‘

অভী বিনোদের দিকে তাকালো একবার , ফিস ফিস করে বলল শুনতে পাচ্ছিস, চারিদিকে একটা কিরম প্রতিধবনি আসছে ? ‘কোথায় গেল আমার বাড়ী? কোথায় কোথায়? ও বাবুমশাই রা।’ তার গলায় একটু আগের উচ্ছলতার এক ফোঁটাও নেই কোথাও।

বুড়ো একাই একশো গলা হয়ে চেঁচিয়ে যাচ্ছে, এসব কী হচ্ছে ! এই তো এখান  থেকে বাঁ হাতায় ওলাইচন্ডীর থান। সেই বারে যখন ছেলের  এখন তখন অবস্থা, ওর মা তিন দিন ওখানে হত্যে দিয়ে পড়ে  ছিল। তবে না সে ঠিক হলো। মায়ের  থান টাই বা কোত্থায় গেল! -আরে সেই ওলাইচন্ডী তলা, মাইল খানেক লম্বা লাইন পড়ে যার পুজোর সময়, মানত করার জন্য দু তিন দিন আগের থেকে দূর দূরান্তরের লোক জন হন্যে হয়ে পড়ে থাকে, আজ নেই !!  তার দৃষ্টি অনুসরণ করে বিনোদরা দেখল , একটা মন্দিরের চূড়া কোণ থেকে দেখা যাচ্ছে বটে। এতদিন চোখে পড়েনি কেন কে জানে! তার মাথায় একটা জরির কাজ করা গেরুয়া ধ্বজ পতপত করছে। একটা হালকা ওং বৈষ্ণ মাতার সুর ও লাউডস্পিকারে ভেসে আসছে। এতদূর থেকেও তার গায়ের শ্বেত পাথরের অহংকার অনুভব করা যাচ্ছে।

আর ওই ওই যে যক্ষ্মা হসপিটাল গো, রোজ সকালে ব্লিচিং ছড়িয়ে দিয়ে যেত  হাসপাতালের লোক। ওই ওই তো লেবার কোয়ার্টারের দেওয়াল টা, যেটার সামনে দিয়ে পাকা রাস্তা চলে গেছে গো , তারপাশেই দরমার বেড়া, সামনে একটা কলমী শাকের বন , দক্ষিণে কমলা পুকুর, ওই তো সেবার নিবারণের ছোট মেয়েটার খোঁজ নেই, তা সে পাওয়া গেলো পুকুরের মধ্যে- নীল হয়ে গেছে । উফ, মা টার কি আছড়ে পিছড়ে কান্না। ওই ওই ওখানেই তো আমার বাড়ীটা ছিল গো ।

এত গুলো লোক, কারখানা, বাড়ী, পুকুর, মায়ের থান সব কি এই কদিনেই হাওয়ায় মিল্যে গেল গো বাবুমশাইরা। ও বাবুমশাই রা, জবাব দেন না ক্যান।

অনেক গুলো বড় বড়  ঢেউয়ের পরে হঠাৎ সবকিছু চুপ হয়ে যায় সমুদ্রে,  দেখেছে বিনোদ। এই এতক্ষণ একনাগাড়ে চেঁচিয়ে বুড়োও হঠাৎ চুপ হয়ে গেলো। অভী ও চুপচাপ একদম।

সেদিকে তাকিয়ে বিনোদ মনে মনে বলল, আমি জানি অভী তুই আমাকে মনে মনে ঘেন্না করিস। যে জমিতে আমাদের ফ্ল্যাট টা, পরে শুনেছি সেটা তোদের খেলার মাঠ ছিল, ঘুড়ি ওড়াবার জায়গা ছিল। কিন্তু আমি কী করতাম বলতো? অনেক ছোট ছিলাম। বাবাও এত কিছু জানত বলে মনে হয়না। ক্ষমা করে দে ভাই।

অভী কি শুনতে পেল তার কথা! কীরকম মন্ত্রমুগ্ধ হয়ে সে তাকিয়েই রয়েছে। সেও এবারে ফিসফিস করে বলছে, হ্যাঁ কোথায় গেল রে ... আমাদের নোনা পুকুর, বকুল ডাঙ্গা, মহিশবাথান, নারকেল বাগান! মনে আছে আমাদের স্কুলের মাঠের ওপর দিয়ে কালো মাথা হাঁসের ঝাঁক উড়ে যেত- কত বছর হল আর আসেনা, শুনতে পাচ্ছিস না, ওই ওরাও জিগ্যেস করছে......কোথায় গেল? কোথায়!  তুই জানিস বিনু?

এবারে বুড়ো ঘুরলো এদিকে আবার, তার পর হয়তো ওদের দিকে, বা হয়তো কারো দিকেই তাকালো না । চারিদিকের লোকজন, ব্যস্ততা , নীল আকাশে সাদা মেঘের ছোপ ছোপ , মৃদু ডিসেম্বরী রোদের উষ্ণতা সব কিছু এড়িয়ে সে যেন অনেক দূরে চলে গেছে। হয়তো দেখতে পাচ্ছে, সকালের সাইকেলে যক্ষা হাসপাতালের ব্লিচিং গন্ধ পেরিয়ে এই রাস্তা দিয়েই ছেলেকে বসিয়ে সে দোকান খুলতে যাচ্ছে, দরমার দরজায় বৌয়ের ফিসফিস -'সাবধানে যাবা' , কারখানার চিমনিতে তখন উষ্ণতা ছড়াচ্ছে  সূর্য, পাড়ার টিউকলে আর তার দোকানের সামনে সারি সারি ভাঙাচোরা লোকের ভীড়। সে সব মলিন দৃশ্য কল্প আজ হঠাৎ এই অভ্ৰংলেহী ইমারতের ঝকঝকে কাঁচে ঠিকরে বড়োই বিব্রত বোধ করছে , বুড়োর মতোই।

আরে বিনোদ, বুঝতে পারছেনা যে সে শুনতে পাচ্ছেনা? নাকি চাইছেনা ? –ওই তো ....সামনের স্মার্ট শহর - এই ঝকঝকে মেকআপ , এল ই ডি র সাজ , সিগন্যালে রবীন্দ্র সঙ্গীটের টানে থেমে  যাওয়া চার চাকার সুখী শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত  জীবন লহরী সব ডুবিয়ে দিয়ে তীব্র ওই শব্দতরঙ্গ। ... রোগাভোগা কারখানার কঙ্কাল করোটির খিলখিল, লেবার কোয়ার্টারের ধ্বংসস্তূপের সামনে জড়ো হয়ে থাকা শুকনো পাতার সড়সড়, কৌলিন্যহীন ওলাইচন্ডী থানে হত্যে দিতে দিতে বন্ধ হয়ে যাওয়া টিবি হসপিটালের এবড়ো খেবড়ো শুকনো কাশির গমক আজ বুড়োর আওয়াজ হয়ে গুঁড়োগুঁড়ো হয়ে যাচ্ছে তার নাগরিক ভ্রুকুটির কার্নিশে!

সে চুপ করে রইল।

আর তারপর.......

না কিছু না। ....শুধু , এই সব কিছুকে ফুৎকারে উড়িয়ে দিতেই হয়তো একটা তীব্র উত্তুরে হাওয়ার ঝাপ্টা এলো। আর সেই অভিঘাতে ওয়েস্টউইন্ডের এতক্ষণের নিস্তব্ধ ফেস্টুনে সমস্বরে নেচে উঠলো সোনালী অক্ষরে ছাপা অক্ষরগুলো  - সেল সেল সেল!

Bengali Literature Bengali Short Story
Advertisment