Advertisment

ছোট গল্প: আঁকিবুকি

ঋতুপর্ণা ভট্টাচার্য, বর্তমানে মার্কিনপ্রবাসী। রসায়নে পোস্ট-ডক্টরাল গবেষণা করলেও ফ্রিল্যান্স সাংবাদিকতা আর লেখালিখি সেই ছোটবেলা থেকে। এগারো বছরে প্রকাশিত প্রথম গল্পের বই ভুটিয়া।

author-image
IE Bangla Web Desk
New Update
NULL

অলংকরণ- অরিত্র দে

পুজোর আর বেশি দেরি নেই। উৎসব ধিকিধিকি ডানা বাঁধছে প্রাত্যহিক জীবনের গভীরে। শহরে যদিও শিউলি তেমন চোখে পড়েনা আর। তবু মনের মধ্যে ফুটে উঠছে একটু একটু।

Advertisment

এমন দিনগুলোয় ছেলেকে বড্ড মনে পড়ে রণবিজয়ের। অবশ্য মনে সবসময়ই পড়ে। স্ত্রী রমা চলে যাওয়ার পর থেকে অবেলার শৈশবের ঝড়ের মত তছনছ লাগে নিজেকে রণর। এই মরে আসা আলোর জীবনপ্রান্তে অতীত আলগোছে ধরে নেয় হাত।

পড়াশোনার জন্য কবেই দূরে চলে গেছিল অপু। তারপর চাকরি নিয়ে একেবারে বিদেশে। সৃষ্টি যখন থাকেনা কাছে, স্রষ্টা তখন অসহায়। কিন্তু তাও দুই বুড়োবুড়ি একে অন্যকে আঁকড়ে গুছিয়ে নিচ্ছিলেন ঝরে যাওয়া ফ্যাকাশে সুখগুলো, যতটুকু মুঠোর মাপে। ব্যথার চেয়েও মহান আবিষ্টতার মধ্যে কেটে যাচ্ছিল দিনরাত্তির। রমা এভাবে ফাঁকি দিয়ে চলে যাবে, সে দুঃস্বপ্ন দেখেননি কোনদিন। শরীর বরং তাকেই কাবু করেছিল সুগারে। চোখ আর কিডনিও খারাপ হচ্ছিল আস্তে আস্তে।রমা সুস্থ ছিলেন অনেক বেশি। ভোরে উঠে হাঁটতেন রোজ। স্বল্পাহারী মানুষ বরাবর। সে যে হঠাৎ স্ট্রোক হয়ে ছেড়ে যাবে এক রাতের মধ্যেই বোঝেননি রণবিজয়।

আরও পড়ুন, হামিরউদ্দিন মিদ্যার ছোট গল্প: হাওয়া বদল

সল্টলেকের এই দোতলা বাড়িটা বানিয়েছিলেন বড্ড শখ করে ।কত ধরপাকড় করে একফালি জমি পেয়েছিলেন । তাতে একটু একটু করে স্বপ্ন গেঁথে ইমারত খাড়া করেছিলেন। পুবের সবচেয়ে খোলামেলা ঘরটা অপুর জন্য সাজিয়েছিলেন দুজন মিলে ।

আইআইটিতে পড়ার সময় ছুটিতে অপু ফেরার আগেই ঝেড়েমুছে আয়না করে রাখতেন পুরো ।

-আবার নতুন ওয়াল পেন্টিং লাগিয়েছ?

অপু বিরক্ত হত ।

-তোর তো পছন্দ। হস্তশিল্প মেলা থেকে তোর মা এনেছে।

-পছন্দ বলে এতগুলো টাকা খরচ করতে হবে প্রতিবার?

ছেলেটি তাঁর ছোট থেকেই হিসেবি। অবশ্য মেপে পথ চলেছিল বলেই আজ এতদূর উঠেছে উঁচুতে।

রান্নার লোক দু’বেলা এসে রান্না করে যায়। তাছাড়া সারাদিনের লোক আছে ভজ।

সকালবেলা বারান্দায় একটু বসেন এসে রণ।চায়ের কাপ হাতে ছেলের সাথে স্কাইপ । তখন ওদিকে সন্ধ্যে নেমেছে।ছেলে অফিস থেকে ফিরে জলখাবার খাচ্ছে। বৌমার ফিরতে আরো রাত। তার থিসিসের কাজ চলছে এখন।

ফোনের এপার ওপারে যত্ন-চিন্তা-ভালবাসা আদানপ্রদান হয়। গুপ্ত সংবাদের পাওয়ার মত যে ছটফটানি ছেলের জন্য জমিয়ে রাখেন তিনি, সেটা অপুকে দেখাননা মোটেই । শুধু বলেন,

-তোমরা ভাল থেক ।

ছেলের কাছে গিয়ে থাকা যায় হয়ত। তারা তো এখন ওই দেশের সিটিজেন।

কিন্তু আজন্মের এই ধুলোবালির শহরে জীবনযজ্ঞের আড়ম্বর ছেড়ে যেতে মন চায়না । রাজার কাঙালপনা বুকে নিয়েও নতুন ইতিহাসে লিখে চলেন নিত্য দিনযাপনের একাকী গল্প।

আরও পড়ুন, ভাস্বতী বন্দ্যোপাধ্যায়ের ছোট গল্প: সদানন্দের সাধ

“কাচের চুড়ি ভাঙ্গার মতন মাঝেমাঝেই ইচ্ছে করে দুটো চারটে নিয়মকানুন ভেঙ্গে ফেলি”.....ঠিক তেমনভাবে শরীরের নিয়ম ভেঙ্গেই কচুরি দিয়ে জমিয়ে আলুর তরকারী খাচ্ছিলেন রণবিজয়। মোড়ের মাথার পুরনো এই ‘ব্রজহরি নিরামিষ তেলেভাজা’ আর দামী রেঁস্তরার মধ্যে কোনো তফাত খুঁজে পাননা রণ। কুড়ি টাকায় যে অমৃত তিনি পেটে ঢোকাচ্ছেন তার সাথে পাল্লা দিয়ে স্বাদ এবং দাম দুটোতেই কেউ পারবেনা।

হঠাৎ একটা স্পর্শে চমকে তাকালেন।

-এখনো কচুরি খান স্যার?

পায়ে হাত দিয়ে প্রণাম করছিল একটা লোক।

মোটা গোঁফের গুচ্ছ, কাটা হাত গেঞ্জি, হাতেগায়ে অজস্র ওই ট্যাটু করানো । কানে দুল ।সানগ্লাসটা কায়দা মেরে মাথার ওপরে তুলে রাখা। দামী ঘড়ি ডানহাতে।

এঁদোমার্কা এই স্যাম্পেল আবার তাকে স্যার বলছে যে!

তাঁর অবাক চেহারা দেখে সে নিজেই বলল,

-আমি ভুঁইয়া স্যার। লোটন ভুইঁয়া। আপনার হাতে রোজ মার খেতাম মনে আছে ক্লাসে?

এবার অল্প অল্প করে মনে পড়ছে রণবিজয়ের। ইংরিজির শিক্ষক হিসেবে তো বটেই, ছাত্র পেটানোর জন্যও বেশ নাম ছিল তাঁর স্কুলে। তবে সেই মারের ঠ্যালায় কত বাঁদর যে শুধরে গিয়ে মানুষ হয়েছে দিব্যি সেটা তারা নিজের মুখেই বলেছে পরবর্তীকালে  ।কিছু অবশ্য এসবের ঊর্ধ্বে ছিল। যেমন এই লোটন । স্কুলের শেষদিন অবদি তারা যেমন ছিল, তেমন রয়ে গেছে । রণবিজয়ের বেত ভেঙ্গে গেছে, তাদের জেদ ভাঙ্গেনি।

-আরে! তুমি এত যুগ পরে? চিনতে পেরেছ আমায়?

ভাল লাগল রণর।

-চিনবনা স্যার? রোজ তো স্কুলফেরত এইখানেই আপনি কচুরি খেতেন দাঁড়িয়ে। আমরা দেখতাম দূর থেকে। বিপদে ফেলার কত চেষ্টা করেছি স্যার আপনাকে।

সে করেছিল বটে । সাইকেলের হাওয়া খুলে দেওয়া, চেয়ারের নিচে পটকা, চক ভেঙ্গে রাখা এমন কত কি যে সয়েছেন রণবিজয়। ধরতে পারলে মারের পরিমাণ দ্বিগুণ করে দিয়েছেন তাদের । তাও নিজের ব্রত থেকে সরে আসেননি তিনি কোনদিন।

অবশ্য এখনকার যুগ হলে এতদিনে তার হাজতবাস হয়ে যেত এই ব্যাপারে নিশ্চিত।

আজকাল তো বাচ্চারা প্রতিবাদ করার আগে মা বাবা ঝাঁপিয়ে পড়ে। টিচাররাও দোষী বটে কিছু ক্ষেত্রে। সোহাগের শাসন আর অত্যাচার দুটো তো সমান নয় ।

পুরনো ছাত্রকে দেখে মনটা বেশ ফুরফুরে হয়ে যায় রণর। অনেকের খোঁজখবর নেন লোটনের কাছে।

-তা এই সব আঁকিবুকি যে কেটেছ তাতে ব্যথা লাগেনা? খরচও তো ভালই।

একগাল হেসে ফেলে লোটন।

-আমি নিজেই তো এই ব্যবসা করি স্যার। ট্যাটু আঁকার। ছোট থেকেই আঁকাটা ভাল লাগত। পড়াশোনা কোনদিনই মাথায় ঢোকেনি।

-তাই নাকি?

-হ্যাঁ স্যার । ইলেভেনের পরেই লেগে পড়লাম ফেস্টুন, মেহেন্দি সবরকম কাজে । তুলি রং পেলেই হত । তারপর ধীরে ধীরে ট্যাটুর বাজার এল। ট্রেনিং নিলাম । প্রথমে এর তার দোকানে কাজ করতাম । এই বছর দুয়েক হল নিজের দোকান দিয়েছি। একটা ছেলে আছে সাহায্য করে।

-ভালই তো । করেকম্মে খাচ্ছ নিজের যোগ্যতায়। এইটাই চাই। কাজ কিন্তু ছোটবড় হয়না।

-আপনাকে এইজন্যে এত ভাল লাগে। আপনি সবার মত নন স্যার।

আরো টুকরো এদিক ওদিক কথা হয় । অপুর কথাও বলেন রণবিজয় ।জোর করে দোকানের বিল মিটিয়ে দেয় লোটন।রণকে রিকশায় চাপিয়ে ভাড়া দিয়ে তবে বিদায় নেয় । ফোন নম্বর দিয়েছেন রণবিজয় । লোটনের নম্বরও নিয়ে নেন মোবাইলে।

হয়ত যোগাযোগ থাকবেনা । তাও একজন পুরনো ছাত্রকে পেয়ে আজ যেন অনেকটা অতীতকে একসাথে ছুঁয়ে ফেলেছেন হঠাৎ।

সব বিকেলগুলো মনমরা হয়না।

আরও পড়ুন, অদিতি বসু রায়ের ছোট গল্প: গরীব লোকের গল্প

নভেম্বরের শেষের দিকটায় বেশ শীত এসে গেছে এই বছর।ঘরে বসে হালকা চাদর মুড়ে টিভি দেখছিলেন রণ । ভজ আসে।

-আপনারে একজন ডাকতিছে ।

বেল বেজেছিল বটে। রণ ভেবেছিলেন দুধওয়ালা।

দরজায় দাঁড়িয়ে লোটন।

-আরে ভেতরে এস।

ভজটা চিরকাল বেআক্কেলে।

আবার প্রণাম করে লোটন।

-তুমি দেখা হলেই এত প্রণাম করনা। এটা সস্তা নয়।

-না স্যার। যাকে তাকে করিনা । আপনি যোগ্য বলেই করি।

হাসিমুখে আশীর্বাদ করেন রণ। কতদিন পর সন্ধ্যেবেলা টিভি আর ভজ ছাড়া অন্য কারো আওয়াজ পাচ্ছেন এই বাড়িতে। কুশল বিনিময় হয় কিছুক্ষণ।

-একটা আর্জি নিয়ে এসেছি আজ স্যার।

-সে কি! আমার কাছে ?

-হ্যাঁ । একটা উদ্যোগ নিচ্ছি আমি। কিন্তু বোঝেন তো, ভাবি অনেক। করতে গেলে একটা পোক্ত মাথার সাহায্য দরকার হয় । পড়াশোনা তো বেশি নেই স্যার।

-আচ্ছা বল কি চাই তোমার। সাধ্যের মধ্যে হলে অবশ্যই আমি পাশে থাকব।

-যেসব মেয়েরা ওই অ্যাসিডে পুড়ে যায় তাদের ক্ষত যতটা পারি ট্যাটু এঁকে ঢেকে দিতে চাই স্যার। যাতে অপমানের আর ব্যথার দাগগুলো তারা ভুলে যায়।

অবাক হয়ে তাকিয়ে আছেন রণবিজয়। শীতের সকালের নলেনগুড়ের মত মিঠে একটা অনুভূতি চারিয়ে যাচ্ছে মনে।

লোটন বলে চলেছে,

-আপনাকে পাশে চাই স্যার। কিভাবে একটু আধটু প্রচার করব সবাই যাতে জানতে পারে আপনাকে বলে দিতে হবে স্যার । আপনি তো পেপারে লিখতেন একসময়। তাছাড়া মেয়েগুলোকেও তো বোঝাতে হবে। ওরা এগিয়ে না এলে তো কিছুই হবেনা।

-সে নাহয় একটু লিখে টিখে দিলাম। কিন্তু এসব ব্যবসার ব্যাপার। আমি কী বুঝব?

-স্যার! ব্যবসা নয়। এইটা আমি নিজের জন্য করছি। বিনে পয়সায় করব ট্যাটু ওই মেয়েদের। আমার নিজের বোনটাও স্যার ওই অ্যাসিডেই....

শেষ ভালবাসা বিলিয়ে যেমন নিঃস্ব লাগে, ততটাই শূন্য লাগে লোটনের গলাটা।

হটাত নিজেকে বেশ শক্ত লাগে রণবিজয়ের । বেদান্তের মন্দিরচূড়ার মত বিষণ্ণতামাখা বৃদ্ধ ভাবেন, ছেলের বিরহে কাতর হয়ে আজ আর পা মচকে পিছিয়ে পড়ার দিন নয় ।

লোটনের হাতটা ধরে ফেলেন অশীতিপর হাতের যতটুকু জোর বাকি ছিল সবটা দিয়ে।

-আমি থাকব তোমার সাথে। আমায় একটু সময় দাও শুধু।একটু ভেবে নি কিভাবে শুরুটা হবে।

-থাকবেন স্যার? যত খুশি সময় নিন আপনি, তাড়াহুড়ো করে কিচ্ছু হয়না ।

টগবগ করছে লোটন উত্তেজনায়।

-আমার বোনকে বাঁচাতে পারিনি । ঝলসে গেছিল পুরো মুখটা। কিন্তু আর কেউ যদি বেঁচে যায়, একটা সুন্দর জীবন পায় তবে আমার আঁকা সার্থক....

আবেগে মথিত হয়ে আসে লোটনের বাস্তবমাখা কঠিন গলাটা। চোখ থেকে ঝুরঝুর করে ঝরে পড়তে চাইছে সোনার বালির মত জলবিন্দু....

অসুখ ভুলিয়ে দেওয়া প্রিয় খুনসুটির মত অপার্থিব ভাল লাগায় দুটো মানুষ নিশ্চুপ বসে থাকে কিছু সময়।

একসময়ে চলে যায় লোটন।

বারান্দা থেকে তার চলে যাওয়া দেখছিলেন রণবিজয়।

এইসব ছাত্ররা তাঁর শিক্ষার অপার দান সঠিকভাবে নিতে পারেনি বলে মনে আজীবন খেদ রেখে দিয়েছিলেন তিনি । কিন্তু যে শিক্ষায় একলব্যের মত নিজেকে শিক্ষিত করে এসে দাঁড়াল আজ লোটন তাঁর সামনে, সেই শিক্ষা বিলোনোর সাধ্য রণবিজয়ের ছিলনা কোনদিনই।

বৃষ্টির দিনে সপ্তরং ভুরু এঁকে যেমন গাছের কচিপাতাগুলো জন্ম নেয়, ঠিক তেমনি এক সুখের এক্কাদোক্কা চলতে থাকে বুকের ভেতর ।

রণবিজয় পলকে এক ফুরিয়ে আসা বৃদ্ধ থেকে রণসৈনিকে রূপান্তরিত হয়ে যান। অপু যেমন পালন করছে নিজের জীবনের নিদারুণ কর্তব্য, রণর সামনেও এখন থেকে কঠিন লড়াই। লোটনের হাত ধরে বেদনায়, মাধুর্যে খুঁজে নিতেই হবে রাত্রিব্যাপী আঁধারের মধ্যে মিলনান্ত নীলিমা....., ঝলসানো, আহত মেয়েগুলো যাতে ডানা মেলে দিয়ে রঙিন প্রজাপতির মত উড়তে পারে । তাদের গায়ে লেগে থাকবে লোটনের মমতায় উজ্জ্বল আঁকিবুকি !

(সংবাদপত্রের একটি খবর থেকে আংশিক অনুপ্রাণিত)

Bengali Literature Bengali Short Story
Advertisment