বিমল লামা
যুবতী বিধবা সে। চাইলে তার একমাত্র ছেলেকে রাজার হালে রাখতেই পারত। কিন্তু সে তা করেনি। ভর্তি করেছে গ্রামেরই স্কুলে। পাঁচ ক্লাসে। বিবর্ণ শার্ট, ছেঁড়া হাফ প্যান্ট, চটা ফাটা হাওয়াই চটি..., এই তার ছাত্র দশার চলমান চিহ্ন। কাঁধে ব্যাগ ঝুলিয়ে যখন সে স্কুলে যায় তার ভাবতে ভাল লাগে তার ছেলে একদিন ডাক্তার হয়ে ফিরবে। না হোক সরকারি অফিসার কি ইস্কুলের মাস্টার।
তাই সে যথাসাধ্য চেষ্টা করে ছেলের যাতে পড়াশোনায় কোনও অসুবিধা না হয়। কি না করে সে। একশো দিনের কাজ, রাজমিস্তিরির জোগাড়ে, ভাটায় ইট পাড়া, মরশুমে ধান রোয়া ধান কাটা। আর কিছু না পেলে লোকের বাড়ি বাসন মাজা কাপড় কাচা। তাকে এই সব করতে দেখে অনেকেই গায়ে পড়ে সাহায্য করতে চায়। যদিও ধার চাইতে গেলে কেউ পঞ্চাশ টাকাও দেয় না এমনিতে।
যেমন হল সেদিন আর কী। ছেলে আগেই বলে রেখেছিল বড়দিনে পিকনিকে যাবে বন্ধুদের সঙ্গে। পঞ্চাশ টাকা দিতে হবে। ধার চাইতে গেছিল মহাজনের কাছে। শুনে মহাজনের সে কী ফুর্তি। লাফ দিয়ে বলে, “পঞ্চাশ কেন, পাঁচ শ নিয়ে যা। আয় আয় ভেতরে আয়।”
তাড়াতাড়ি পালিয়ে এসেছিল সে।
বড়দিনের দিন সকাল থেকে ছেলের সঙ্গে অশান্তি। টাকা দাও টাকা দাও...ঘ্যান ঘ্যান.. ঘ্যান ঘ্যান..। শেষে চিল চিৎকার দাঁত খিচুনি কান্নাকাটি পা দাপানি। তারপর দুই ঘা পিঠের ওপর। আর অভিমান করে ছেলের দৌড় ধুলোর রাস্তা ধরে। পিছন পিছন সে-ও ছুটে এসেছিল খানিকটা। ছেলের নাম ধরে ডাকতে ডাকতে। কিন্তু ছেলে থামে না। ছুটতেই থাকে রাঙা ধুলোর মেঠো পথ ধরে। দু’পাশে পাকা ধানের সোনালি সম্ভার। সামনে কালচে বন রেখা। বনের ওপারে সারি সারি টিলা ডুংরি পাহাড়। সেদিকেই ছোট হতে হতে মিলিয়ে যায় তার বাপ মরা অনাথ ছেলেটা।
আরও পড়ুন, ছোট গল্প: উপনিবেশ
ছুটতে ছুটতে ছেলে পাহাড় গোড়ায় চলে আসে। সেখানে তখন ধুম লেগেছে পিকনিকের। ছোট বড় অসংখ্য গাড়ি করে লোক এসেছে পিকনিক করতে। এমনকী বাসে করেও। চারিদিকে গান বাজছে। মহানন্দে লাফিয়ে লাফিয়ে নাচ করছে লোকে। গোল হয়ে মদ নিয়ে বসেছে অনেকে। হাতে হাতে লুচি তরকারি ডিম কলা মিষ্টি সন্দেশ। এলাহি কারবার পাহাড় গোড়ায়।
ছেলেটা অবাক হয়ে নাচ দেখছিল একটা গাড়ির পাশে দাঁড়িয়ে। হঠাৎ একজন তার জ্যাকেটটা ছেলেটার হাতে দিয়ে বলে, “ধর তো একটু।” আবার সে নাচতে লাগে দলে ভিড়ে। অনেক্ষণ পর নাচ থামিয়ে লোকটা এসে বসে ছেলেটার কাছে। নিজের জ্যাকেটটা ফেরৎ নিয়ে বলে, “একটু জল নিয়ে আয় তো।”
ছেলেটা গিয়ে জল নিয়ে আসে। আর একজন বলে, “একটা দেশলাই নিয়ে আয় তো।” সে গিয়ে দেশলাই নিয়ে আসে। আর একজন ক্যামেরাটা তার হাতে দিয়ে বলে। “একটা ছবি তুলে দে তো।” একজন আবার মোবাইল ফোনটা দিয়ে বলে, “ওই ওকে দিয়ে আয়, লাল সোয়েটার।”
লাল সোয়েটার খানিক দূরে বসেছিল। ছেলেটা তার কাছে নিয়ে যায় মোবাইলটা। সেটা নিয়ে লাল সোয়েটার বলে, “ওকে বল আমি ডাকছি।” সে গিয়ে বলে, “লাল সোয়েটার ডাকছে।” লোকটা নাচতে নাচতেই বলে, “গিয়ে বল আমি নাচছি।” সে গিয়ে বলে, “উনি নাচছেন।” লাল সোয়েটার আবার বলে, “গিয়ে বল আমার পেচ্ছাপ পেয়েছে, জায়গা পাচ্ছি না।”
আরও পড়ুন, সখিসংবাদ
কথাটা লোকটাকে গিয়ে বলতেই লোকটা সেই দায়িত্ব ছেলেটাকেই দিয়ে দেয়। বলে, “নিয়ে যা, করিয়ে আন।” ছেলেটা গিয়ে সেকথা লাল সোয়েটারকে বলতেই সে বলে, “তুই জানিস কোথায় জায়গা?”
“জানি।”
“তবে চল।”
সে লাল সোয়েটারকে খানিক দূরে নিয়ে যায়। এদিকটা কেউ নেই। গাছপালাও বেশ ঘন। বুনো বুনো আবহ। কাছেই এত কোলাহল সত্ত্বেও একটা নির্জন ভাব।
লাল সোয়েটার শান্তিতে কাজ সারে সেখানে। তারপর উঠে দাঁড়িয়ে কাপড় ঠিক করতে করতে বলে, “কিসের শব্দ রে?”
“ঝর্ণার।”
ঝর্ণা শুনে উৎফুল্ল হয়ে ওঠে লাল সোয়েটার। চোখ বড় বড় করে বলে, “ঝর্ণা আছে! কত দূর?”
“কাছেই।”
“যাওয়া যাবে?”
“হ্যাঁ।”
“চল তবে, নিয়ে যাবি আমাকে?”
“চলো।”
লাল সোয়েটার তার মায়ের বয়সীই হবে। কিন্তু এমন করছে যেন তারই সমবয়সী। যেন একই ক্লাসে পড়ে তারা। বন্ধুর মতো।”
দু’জনে বনের শুঁড়ি পথে এগিয়ে যায়। অনেকগুলো বাঁক পেরিয়ে রাস্তা নামতে শুরু করে। তারপর অনেক বোল্ডারের ফাঁক ফোকর গলে গিয়ে পৌঁছায় একটা কুলকুল করে বইতে থাকা জলধারার কাছে। দুই মানুষ উচ্চতার এক পোষমানা ঝর্ণা।
আরও পড়ুন, সাদাত হাসান মান্টোর গল্প: লাইসেন্স
একটা বোল্ডারের ওপর বসে ঝর্ণার দিকে তাকিয়ে গান গায় লাল সোয়েটার। মিষ্টি সুরের গান। চটি খুলে জলে নামে। হাতে নিয়ে চোখে মুখে দেয়। ছেলেটার দিকে ছিটিয়ে দেয় জল আর খিলখিলিয়ে হাসে। ছেলেটারও মজা লাগে, সে-ও ছিটা দেয় জলের। লাল সোয়েটার আরও হাসে। খেলার ছলে দুজনে আধ ভিজে হয়ে যায়। শেষে লাল সোয়েটার বলে, “একি রে তুই আমাকে ভিজিয়ে দিলি, দাঁড়া তোকে দেখাচ্ছি।” তারপর লুকোচুরি ছুটোছুটি চোরপুলিশ খেলা চলে ঝর্ণা নদী বন আর বোল্ডারের গোলোক ধাঁধার ভেতর।
এক সময় শেষ হয় খেলা। লাল সোয়েটার ছেলেটার গলা জড়িয়ে ধরে বলে, “বোস একটু জিরিয়ে নি।” তারপর হঠাত খেয়াল হওয়ার মতো করে বলে, “তুই কার সঙ্গে এসেছিস রে?”
সে বলে, “আমি তো তোমাদের সঙ্গে আসিনি।”
আকাশ থেকে পড়ে লাল সোয়েটার। প্রায় চিৎকার করে বলে, “তাহলে?”
ছেলেটা নিজের বড় দিনের গল্প বলে লাল সোয়েটারকে। শুনে তার চোখে জল এসে যায়। অনেক্ষণ সে চেয়ে থাকে ছেলেটার দিকে। তারপর আবার তার গলা জড়িয়ে ধরে বলে, “তুই আমার দিদির ছেলে। আমাকে মাসি বলে ডাকবি। সবাইকে বলব হঠাৎ দেখা হয়ে গেল। তাই ধরে নিয়ে এলাম।”
ফিরে এসে সহজেই দলে ভিড়ে যায় ছেলেটা। আর সবার মতই খায় দায় নাচ করে। তারপর দিনের শেষে বিদায় নেয় লাল সোয়েটারের কাছে। লাল সোয়েটার তার মায়ের জন্য খাবার দিয়ে দেয়। আর হাতে পঞ্চাশ টাকা দিয়ে বলে, “ফার্স্ট জানুয়ারি পিকনিক করিস।”
ছেলেটা আবার সেই সোনালি ধানের পথে ফিরে আসে ঘর মুখে। হাতে মায়ের জন্য মাংস ভাত মিষ্টি সন্দেশ। পকেটে পঞ্চাশ টাকা।
উঠোনে পা দিয়েই সে দেখে মা বসে আছে উদ্বিগ্ন মুখে। তাকে দেখেই মা লাফ দিয়ে উঠে দাঁড়ায়। তাকে আবেগ ভরে বুকে জড়িয়ে ধরে বলে, “কোথায় ছিলি সারাদিন?”
নীরবে সে মায়ের গন্ধ নেয় চুপ করে দাঁড়িয়ে। এক সময়ে বুক ভরে যায় তার। শান্ত হয় মা-ও। আঁচলের খুঁট খুলে পঞ্চাশ টাকা বার করে মা বলে, “তোর জন্য টাকা নিয়ে এলাম কাঠ বেচে। আর তুই কোথায় চলে গেলি?”
সে-ও পঞ্চাশ টাকা বার করে পকেট থেকে। মায়ের হাতে দিয়ে বলে, “এই টাকা দিয়ে তুমিও পিকনিক করবে।”
মা হেসে বলে, “আমি কোথায় পিকনিক করব? আর টাকা পেলি কোথায়?”
আরও পড়ুন, পাগলের পাগলামি কিংবা একটি নিখাদ প্রেমের গল্প
সে লাল সোয়েটার মাসির গল্প বলে। খাবারের প্যাকেটটা মায়ের হাতে দিয়ে বলে, “তোমার জন্য খাবার পাঠিয়েছে মাসি।”
ততক্ষণে দিনের আলো ফুরিয়ে অন্ধকার নেমে আসছে ধীরে ধীরে। অস্তগামী সূর্যের দিকে তাকিয়ে মা বলে, “চল, আজ আমরা দুজনেই পিকনিক করব।”
“দুজনে পিকনিক! রাত্তিরে? কোথায় পিকনিক করব?”
মা ততক্ষণে বেড়া ঘেরা উঠোনের মাঝখানে কাঠ কুটো জড়ো করে ফেলেছে। আগুন দিতেই নেচে ওঠে লাল হলুদ শিখা। মা সেদিকে তাকিয়ে বলে, “এখানেই আজ আমাদের পিকনিক। আমি গাইব। তুই নাচবি।”
ছেলে ভাবে মা-ও আজ লাল সোয়েটার মাসির মতো করছে। যেন তারা সমবয়সী দুই বন্ধু।
ততক্ষণে গান ধরেছে মা—
“যাব ইবার কাঁসাই ধারে টুসু পরবে,
বেটা হামার লাচবে গাবে কেমন গরবে।”
ছেলেটাও আগুন ঘিরে কোমরে হাত দিয়ে নাচতে লাগে ঘুরে ঘুরে। যেন সে একা নয়, গোটা রাঢ় বাংলা তার সঙ্গে নাচছে হাতে হাত ধরে।