এক
হাত আর পায়ের মধ্যে যে ইচ্ছেটা সুড়সুড়িয়ে উঠছে আজকাল, ওরা দুজন তার দুপাশে নৈশপ্রস্তাবের মতো বসেছিল। অথচ কেউ কোনো কথা বলতে পারেনি বহুক্ষণ। অকাঙ্ক্ষিত সন্তানের মতো রাত্রি এসে পড়েছিল ওদের না-বলা কথার তলপেটে। আর তখনই ওরা বুঝতে পারে, এই যে আবহ, এই পশ্চাদপট, এর কোনোটাই ওদের জন্য নয়। আর বোধহয় সেই কারণেই, একজন উঠে দাঁড়ায়। আঁচলের প্রান্ত তুলে নেয় মেঝে থেকে। সেখানে চাবির বদলে একখানা আস্ত পেন, গিঁটবাঁধা। সস্তা ও পুরনো, কিন্তু সক্ষম।
সন্ধেটা দিয়ে আসি, বলে সে চলে যায়।
আরেকজন বসে থাকে। তার মুখের পেশীতে অন্যমনস্ক কুঞ্চন। আলো জ্বলে না ঘরে। আর সর্বত্র আলো জ্বলে। নৈশদীপ। আকাশের লক্ষ লক্ষ তারার মধ্যে সবচাইতে অনুজ্জ্বলটি এসে দাঁড়ায় তার সামনে। ফলে, সেও উঠে পড়ে। ওড়না তুলে নেয় অবিকল সেভাবেই। খোলা সুতো ঝুলছে সেখানে।
আমি কি অক্ষম? - এ কথা সে ভাবে না, তার অবচেতন তাকে ভাবায়। - কী করব আমি? কী হবে এবার? - এইসব প্রশ্নের মধ্যে দিয়ে বিস্তৃত হতে হতে অবশেষে সে চেতনায় পৌঁছোয়।
দুই
অদৃশ্য টিলার ওপর জেগে থাকা একটিমাত্র দৃশ্যমান গাছের মতো বাড়িটা। সামনে লাল সুরকির রাস্তা। প্রতিবেশী আছে অথচ নেই। অর্থাৎ কৈফিয়ত নেই কিন্তু কৌতূহল আছে। আর এই থাকা না-থাকার মাঝখানে ওরা আছে। ওদের মতো করে। অবশ্য দেখার মতো করে না দেখলে আছে কিনা বোঝা যায় না।
ওদের মেশামেশি বহুদিনের। একরকম জন্ম থেকেই বলা যায়। অথচ ওদের মধ্যে ছোটটির, এই 'জন্ম' কথাটায় ঘোর আপত্তি। 'জন্ম' এলেই, তার পেছন পেছন নোংরা আর কালো পায়ে, সিকনি মুছতে মুছতে, 'বাস্টার্ড' কথাটাও এসে পড়ে। অবশ্য এ্রর থেকেও একটা সারাগায়ে গু-মুত মাখিয়ে দেওয়া কথা তার মনে ধরে বেশি। বেজন্মা।
বেজন্মা। জন্মের পর এই প্রথম মেয়ে এমন একটা ভাব পেল যার কোনো তুলনাই হয় না। অনুভূতি, অথচ তার নাম নেই। যেন গন্ধহীন গন্ধরাজ। সে হাসল। সে কাঁদল। অথচ সে কিছুতেই তোমার চোখের মণির রঙ মনে করতে পারল না। শুধু মনে পড়ল, গর্তভর্তি ধোঁয়া। খানিকটা লোভ। লালা। থুতু আর বীর্য। অসম্ভব খিদে পেল তার।
তেলের প্রদীপের বিষণ্ণ হলুদ মায়া আর শাঁখের মুখের ওম নিয়ে যে এসে দাঁড়ালো, তার উদ্দেশ্যে সে ছুঁড়ে দিল সেই রাত্রির প্রথম সম্পূর্ণ বাক্যটি, মুড়ি-টুড়ি কিছু আছে?
আলগোছে সেই শব্দটুকু কুড়িয়ে নিয়ে, মা, পাশের ঘরে চলে গেল।
তিন
মণিমামা নামের যে লোকটা রোববার করে আসে এ বাড়িতে, সে কিছুতেই মণিমামা হতে পারে না, উনিশ বছর বয়েসে এ কথা প্রথম মনে হয়েছিল দোলনের।
কুড়ি বছর বয়েসে সে প্রথম এ কথা তার মাকে বলে।
একুশ বছর বয়েসে, মা প্রথম ও শেষবার এ কথা মণিমামাকে বলে। আর বাইশের অনেক আগে, মণিমামার আসা ঠিক সেভাবেই বন্ধ হয়, যেভাবে একদিন শুরু হয়েছিল রোববারের এক শোরগোল পড়ে যাওয়া সকালে। যেদিন চোর-ঠ্যাঙানোর মতো বেশ একটা জ্বলজ্বলে ঘটনা ঘটেছিল এ পাড়ায়। মেটে সিঁদুরের রঙের সুরকিমাখানো পাঁচজোড়া জুতোর ছাপ বারান্দায় ফেলে সটান সোফায় এসে বসেছিল। কাউকে ডাকেওনি। ঘরে ঢুকে ওরা তো অবাক।
এই এলাম আর কী, ভালো তো সব? মানুষটার বিভ্রান্ত হাসি আজও মনে আছে দোলনের। যদিও বয়েস তখন তার দশও পেরোয়নি। আরও মনে আছে, টাকা দেবার সময় আঙুলে আঙুলে ঝলসে ওঠা একটি অকাট্য ও নিখুঁত স্পর্শবিদ্যুৎ। সে যা দেখেও দেখেনি।
এসব কথা আর আরও অনেককিছু, উনিশ বছর বয়েসে দোলন প্রথম মনে করতে পারে। কারণ সেই বিদ্যুৎ, ন'বছর ধরে ছুটে আসা অযুত আলোর কম্পাঙ্ক পার হয়ে, দ্বিতীয়বারের জন্য ঝলসে ওঠে। আকাশটাই যা আলাদা রকম। ধোঁয়া ধোঁয়া, অথচ কী রঙ কিছুতেই আজ আর মনে পড়ে না।
চার
এটা কি আপনার চশমা?
আলাপের প্রথম খেজুরটি এভাবেই খসে পড়েছিল গাছ থেকে। এত কাছ থেকে লোকটাকে দেখে হাসতেও ভুলে গিয়েছিল দোলন। নাম শুনেছিল। আর গান। অনেকটা নামগানের মতোই।
না, মানে আমারটা ঠিক -
ওহো আপনার চোখ দেখে তো চশমা আছে বলে মনে হয় না। - সুনন্দ নিখুঁত। সুনন্দ ভুল করে না। ভুল করলে আর দেখতে হত না। ছারেখারে যেত সব।
যাওয়ার আর বাকিটা কী? দোলন মনে মনে ভাবে। সুনন্দর অমন গলা, অমন সব ছাত্রী, যেমন ছিল তেমনটি রইল। শুধু দু'দণ্ড দাঁড়িয়ে গেল সে। দু'মুঠো পাখার হাওয়া বয়ে গেল শরীর দিয়ে। নাহয় ফর্সা আর মাখন-মাখন চামড়া মার্বেলের টালির মতো আঁটোসাঁটো বসানো ছিল দোলনের গায়ে। সামনে আর পেছনে সে ততটাই চওড়া করে ছড়ানো ছিল, যতটা সুনন্দ চেয়েছিল। দোলন যে কী চেয়েছিল, ঠিক কী, আজ সেভাবে মনেই পড়ে না তার। প্রেমের কখগঘ-র সম্পূর্ণ বিপরীতগামী পাঠ তো সুনন্দর কাছেই। আপাদমস্তক বোরখায় মুড়ে, প্রথম সুতোটি ধরে টান মেরেছিল, সে সুনন্দ ছাড়া আর কেউ নয়। আর একজন পুরুষকে দোলন চিনত। ঘন লোডশেডিংয়ের মধ্যে ছুরির মতো জিভের ডগা দিয়ে যে তার অন্ধ নগ্ন ঠোঁট স্পর্শ করে। তার মণিমামা। উনিশ বছরের হতে তখনও কিছু দেরি তার।
দোলন মুখ খোলে এবং অপেক্ষা করে। দোলন কামড়ে দেয়।
আরও অনেকের বাংলা ছোট গল্প পড়তে ক্লিক করুন এই লিংকে
পাঁচ
গুরু বিন জ্ঞান ম্যায় না পাঁউ।
শীৎকার আর আর্তনাদের ওপর দিয়ে জলতরঙ্গের মতো বয়ে যেতেন আমীর খাঁ সাহেব। খাটের ক্যাঁচকোঁচ-বশত মাটিতেই যুযুধান দুই লড়িয়ে মোরগের রক্তক্ষয়ী ঘুমিয়ে পড়ার আবহকে জাগিয়ে রাখতেন তিনি। গান গাইতে গাইতে, কখনও কি মনে এসেছে তাঁর এসব সম্ভাব্য অপপ্রয়োগ? ঘুণ অথবা জলের অক্ষরেও?
সঙ্গমের সময় গান। আর সঙ্গমের পরে স্নান। অভ্যেস থেকে জন্ম নেওয়া ক্যামোফ্লেজ। সঙ্গম সুনন্দর অভ্যেস। গান সুনন্দর অভ্যাস। সুনন্দ স্নান করতে বাথরুমে গেল। দোলন নামের মেয়েটি পড়ে রইল তলপেট বীর্যে মাখামাখি হয়ে। সে ঘৃণা বুঝল না। সে ভালবাসা বুঝল না। স্নায়ু আর সরণীর মাঝখানে দাঁড়িয়ে, মাথা চুলকে ঘা করে ফেলল। ক্রমে পিঁপড়ে ধরল তার শরীরে। অণু অণু পুরুষরস, পিঁপড়ে-বাহিত হয়ে চলে গেল সম্পূর্ণ আলাদারকম এক পূর্ণতার দিকে। সুনন্দ স্নান করে বেরোলো নতুনটি হয়ে। আয়না দেখল। অন্যদিনের মতো এবারেও তার বয়েস বোঝা গেল না।
এখনও কুড়ি বছর কমসে কম। সুনন্দ ভেবেচিন্তে হাসল। আয়নায় আরেকটি ছায়া। হাতে চা। আঁচলের খুঁটে গিঁটবাঁধা আস্ত একখানা পেন। সস্তা ও পুরনো, অথচ...। সুনন্দ আবারও হাসল। হ্যাঁ, বেশ ভেবেচিন্তেই।
ছয়
হাসি আর আক্কেল দাঁতের সম্পর্ক ভাবতে ভাবতে লাল সুরকি ভেঙে এগোচ্ছিল দোলন। পুকুর আর আমবাগানের সাবলীল শূন্যতার পাশ দিয়ে এই হেঁটে যাওয়া, তাকে ক্রমশই বাড়ির কাছাকাছি এনে ফেলেছিল। ইচ্ছে করেই সে আজ রিকশ নেয়নি। জাড্যের সঙ্গে ভাবনার একটা গলাগলি আছে - দোলন আজ ভাবতেই চেয়েছিল। সে ভাবতে চেষ্টা করছিল তার বাবাকে আর অতি স্পষ্টভাবে, প্রায় সিনেমার মতোই, বারবার এসে পড়ছিল মণিমামার মুখ। ভাবনাচিন্তা ছেড়ে দিয়ে দোলন শাড়ির প্যাকেট আঁকড়ে ধরে বুকে। তার প্রথম মাইনের টাকার।
গত একমাস ধরে যা পাখির চোখের মতো দেখে এসেছে। ফলস্, পিকো, সায়া, ব্লাউজ - এইসব একচোখো ভাবনার হুড়োহুড়িতে দোলন আবার মায়ের তলপেটের মধ্যে ঠাণ্ডা হাত সেঁকে নেয়। মা-র বুকের গন্ধ পায় সে। গুঁড়ো গুঁড়ো পাউডার, পদ্মরেণুর মতো ছড়িয়ে পড়ে তার মুখে। অনেকখানি শৈশব অতিক্রম করে দোলন বাড়ি পৌঁছোয়। নিজের পাঁচ নম্বর চটি খুলে রাখে ন' নম্বরের দুটি মেগা সাইজের পাশে। দেয়ালজোড়া কান পাতে। আমীর খাঁ বাজছেন। মারোয়া। গুরু বিন জ্ঞান। দ্রুতের অন্তরা।
মানে, বিলম্বিত শেষ। দোলন বসে পড়ে বারান্দায়।
সাত
এবং উঠে পড়ে। দরজায় হাত রাখে। চাপ দেয়। ঘরে কেউ নেই। টিভিতে প্রসেনজিৎ। ভাবছে। মানে ভাবতে গেলে যেটুকু ভুরু কুঁচকোতে হয়, ঠিক ততটুকুই। সঙ্গে আরেকটু ম্যানারিজম। চাদর খুলে আবার গায়ে দেওয়া, চশমা মোছা ইত্যাদি। একা দোলন আর একা প্রসেনজিৎ। রিমোট হাতে নেয় সে। প্রসেনজিতের মুখ ভাবতে ভাবতে কালো হয়ে যায় ক্রমশ। তারপর আর কিছু থাকে না। ঘরের বিচ্ছিরি গুমোট অন্ধকার তার ওপর আছড়ে পড়ে।
এই ঘর। সীমা ও কালের সম্পর্কহীন এই ঘর পার হতে শতাব্দী লেগে যায় দোলনের। মার্বেলের টালি ফুটিফাটা হয়ে ছিটকে পড়ে এদিক সেদিক। শিরদাঁড়া ভেঙে যায়। দাঁত পড়ে যায় সব। স্তন ঝুলে যায়। শুকিয়ে কিশমিশ হয়ে যায় তার ফুল্লকুসুম বৃন্ত। জন্তুর মতো চার হাতেপায়ে ভর দিয়ে, সে বেডরুমে পৌঁছোয়। দরজা খোলা। বিছানা ঝাড়ছে মা। গা থেকে ধোঁয়া উঠছে। কয়লার উনুনে জল পড়লে যেরকম হয়। ঘরে সুনন্দ নেই। বাথরুমে।
যতবার জল ঝেড়ে উঠে আসে সুনন্দ, হাঁসের মতো, ততবারই মনে হয়েছে বয়েস তাকে ছুঁতে পারবে না কোনোদিন। তবু আজ, একটু বেশিই খুশি হল কি? দোলনও হাসল, হাসতে গিয়ে ঠোঁট বেঁকে গেল তার। সে দেখতে পেল, বাইশ বছর বয়েসটা আবার গুটিগুটি ফিরে আসছে তার কাছে।
কী সুনন্দদা? চান হয়ে গেল?
আট
সুনন্দ ভাবতে পারেনি। কখগঘ-র পর, ঙ-টা তার জানা ছিল না হয়তো। সেই যে ঙ নৌকো আর মাঝি ব্যাঙ। মাঝখান থেকে চিতাবাঘের সরু আর তৎপর ঠ্যাঙটি তুলে, যাবতীয় ক্যালাসনেসের মুখে হেগে দিয়ে পালিয়ে গেল সুনন্দ। দরজা খোলা পড়ে রইল। পাতলা আর ঘন অন্ধকার, কাড়াকাড়ি করে খেয়ে নিল বাড়িটাকে।
উগড়ে দিল যখন, কালো বমি আর লালাসমেত, দোলন খুব খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখছিল সবকিছু। তখন ভোর হয় হয়। উনুন নিভে আসছিল ক্রমশ। তার আগুন, তার দাহ, তার ধোঁয়া, এই সবকিছুর থেকে নিজেকে তুলে নিয়ে, সর্বাঙ্গের ছাই ঝেড়ে, খাট থেকে নেমে পড়ে দোলন। চা বসায়। সে মনে করতে পারে তার নাম, তার অবস্থান।
কেন? কেন? কেন? কেন? কেন?
দেয়ালে মাথা ঠুকতে ভুলে যায় দোলন। ছুঁড়ে ফেলা শাড়ির প্যাকেট কুড়িয়ে নিতে ভুলে যায়। পায়খানায় ঢুকে সে গান গেয়ে ওঠে ভুল করে। ভুল, শুধুমাত্র ভুল করে সে নিরপেক্ষ হয়ে ওঠে।
দেখো না। করো না। বলো না। আহা একবার বলেই দেখো না।
খাটের বাজুতে হাত রেখে পিছিয়ে আসে। নতুন শাড়িতে জড়ানো লাশ, পড়ে আছে বিছানায়। ঠাণ্ডা। হাড়হিম। লাশটা নড়েচড়ে ওঠে। লাশটি কাঁদে।
নয়
আমি কি অক্ষম?
অবচেতনের এসব ভাবনা দোলন ভাবতে বসে? আমি কি অফল? হাত-পা ছড়িয়ে সে ভাবে। ম্যানারিজম সহকারে। শরীরের ছোটবড় অন্ত্র দিয়ে জরায়ুকে ধাক্কা মারে এবং মারতেই থাকে, যতক্ষণ না সমস্ত ডিম্বাণু পদ্মরেণুর মতো ছড়িয়ে পড়ে হাওয়ায়।
কী করব আমি? কী হবে এবার?
তাবৎ ইন্দ্রিয় দোলনের কান ধরে চেতনায় পৌঁছে দেয়। সে দেখতে পায়, সামনে ও পেছনে বাঁশের সাঁকো। মণিমামার হাত ধরে দোদুল্যমান মায়ের অনিশ্চিত পা ফেলা। স্কুলের গেট ধরে দাঁড়িয়ে থাকা বিষণ্ণ একটি মেয়ে, যার বাবা আসে না। সে দেখতে পায় অস্বচ্ছ শরীরের ওমের ভেতর বেড়ে ওঠা থকথকে মাংসপিণ্ড। তার হাত-পা-নাক-চোখ-মুখ, সমস্ত প্রত্যঙ্গের জন্ম টের পায় দোলন। প্রত্যেকটি জন্মের স্পন্দন অন্যটির থেকে আলাদা, সে বুঝতে পারে। শুধু সে ভেবে পায় না কী নামে ডাকবে, কী সম্পর্কে বাঁধবে মায়ের পেটের অথৈ সমুদ্রের মধ্যে ভেসে থাকা, সুনন্দর ঔরসজাত অ্যামিবাটিকে। এত দুঃখের মধ্যেও দোলনের হাসি পায়।
সে আর সময় নেয় না।
দশ
ছেচল্লিশেও যে গাছে ফল হয়, লোকে তো তার দিকে তাকাবেই। মা-র লজ্জা তখন তার লজ্জা। দুহাতে আড়াল করে দোলন গর্ভিনী কুকুরীর নির্লজ্জ পেট। সবে তো সাড়ে তিনমাস। দূরত্বকে সে মেরে আনে অতি দ্রুত। যে গলিতে ঢুকলে কেউ না কেউ আড়চোখে অথবা আড় ভেঙে তাকাবেই, তারা প্রায় ছুটতে ছুটতে ঢুকে পড়ে সেখানে। তারা ছুটতেই থাকে, যতক্ষণ না কাঙ্ক্ষিত সিঁড়িটি প্রায় স্বর্গের সিঁড়ির মতো নেমে আসে এবং দেবদূত টাইপ একজন আগলে দাঁড়ায় তাদের পথ। অবশেষে, কৌতূহল এবং ব্যালকনি বর্জিত, এক অলৌকিক হত্যাপুরীর ওয়েটিং রুমে পৌঁছতে পারে তারা। দোলনের কাঁধে মাথা রেখে ঘুমিয়ে পড়ে মা। সন্তানের মতো। দোলন মায়ের গালে গাল ছোঁয়ায়। ঠাণ্ডা। নিভে যাওয়া উনুন।
এগারো
কোনো এক জন্মদিনে, একসঙ্গে ফুটে উঠেছিল। অনেকগুলো রক্তজবা। যদিও একই রশ্মিজালে জন্ম, তাদের গঠন ছিল বিভিন্ন। তারা ছিল অপূর্ণ আর রক্তাক্ত। দেড়মাস, দু'মাস, এমনকী তিন-চার মাসের তালগোল পাকানো রক্তমাংস। তালগোল পাকানো ইচ্ছে অনিচ্ছে। লাল বলের মতো গড়িয়ে যাচ্ছিল তারা পরস্পরের দিকে। আবহসঙ্গীতের মতো একটিমাত্র কথার তালে তালে হেলেদুলে নাচছিল তারা। বেজন্মা। বেজন্মা। বেজন্মা হো বেজন্মা। হেঁইয়া ও হেঁইয়া বেজন্মা আ আ আ। গানটির সুর ছিল 'পাল্কি চলে'র মতো।
হেমন্তদা আর আমাদের মধ্যে নেই। - দেবদেবীরা বলে ওঠে ও পরবর্তী এক মিনিট নিঃশব্দে যাবতীয় সিক্রিয়েশন চেপে রাখে। দোলন তখন দিল্লিতে। সেই প্রথম এক টাকার লটারি কেটে পাঁচশো পাওয়া। তাছাড়া আর সবকিছু তো একইরকম। এই সব চলে যাওয়াগুলো।
আয় আমরা চলে-যাওয়া চলে-যাওয়া খেলি। - একটি লালটুস, তিন মাসের মোটাসোটা ভ্রূণ, অন্যদের বলে।
ছাড় তো, না-পাওয়া না-পাওয়া খেলব। - আড়াই মাসের মস্তান ভ্রূণটি ভিড় ঠেলে এগিয়ে আসে।
না-হওয়া না-হওয়া। - সাড়ে তিন মাসের নিউকামার গলা ফাটায়।
না-আসা না-আসা।
না-জন্ম।
না-আয়ু।
জরা। ব্যাধি। ক্ষয়। লোভ। মোহ। কাম। মায়া।
মৃত্যু্ও নয়।