পর্ণকুটির প্রান্তে বিষণ্ণ চিত্তে বসে আছেন উপকোশল কমলনয়ন। বাইরে অঝোর বারিধারা। সন্ধ্যা নেমে আসছে বনস্থলীতে। বর্ষাকাশের অন্তরালে থাকা সূর্যদেব পাটে গেছেন আগেই। রয়ে গেছে পাণ্ডুর ম্লান আলোর সামান্য রেশ। বনস্থলীর ঘন সবুজে আঁধারের প্রলেপ ক্রমশ গাঢ় হচ্ছে। পর্ণকুটিরটি সুপরিসর। আশ্রমিকদের পরিচ্ছন্ন পরিচর্যায় বেড়ে উঠেছে ফুলশোভিত কিছু লতাগুল্ম। নিবিড় বনানীর মাঝে অবস্থিত এই গুরুকুল। আচার্য সত্যকাম এর প্রতিষ্ঠাতা। কুটিরগৃহের তিনদিকে তিনটি অগ্নিস্থল। আচার্য সত্যকাম গৃহস্থ ঋষি। অতএব যে কোনও অবস্থায় এই অগ্নিস্থল তিনটিকে প্রজ্জ্বলিত থাকতে হবে। আশ্রমিক ছাত্রদের হাতেই এর দায়িত্ব। বর্ষাকাল। তাই অগ্নিস্থল তিনটি ছাউনিতে ঢাকা এবং তিনদিক ঘেরা। আশ্রমিকদের প্রত্যেকে পালা করে অগ্নিস্থল লক্ষ্য রাখছে। সারাদিন এবং সারারাত। উপকোশল এই ছাত্রদের শীর্ষস্থানীয়। কুটির প্রান্তে সমাসীন সেই ছাত্রশ্রেষ্ঠ উপকোশল কমলায়ন অবশ্য এখন বৃষ্টি ধারার দিকে তাকিয়ে আছে। কিন্তু তার দৃষ্টি অপলক নয়, অশান্ত। কী যেন অন্বেষণ করে চলছে সেই অস্থির দৃষ্টি।
আরও বাংলা ছোট গল্প পড়তে ক্লিক করুন এই লিংকে
২
গুরু সত্যকামের শিক্ষাগৃহে তখন চলছে রাত্রিকালীন ভোজনের প্রস্তুতি। রন্ধন করছেন গুরুমাতা। তাঁকে সাহায্য করছে আশ্রমিক সহপাঠিনীরা। এরা সত্যবাদিনী নামে পরিচিতা। পঞ্চদশ অথবা ষোড়শ বর্ষকাল অবধি এরা বিদ্যাশিক্ষা করবে। শিক্ষান্তে ফিরে যাবে নিজগৃহে। এরপর বিবাহসূত্রে আবদ্ধ হয়ে আরম্ভ করবে গার্হস্থ্য জীবন। উপকাশলের পার্শ্বে উপবিষ্ট তার সহপাঠীরা হাস্য পরিহাসে মগ্ন কিংবা অনর্থক বার্তালাপে। সে একটি দীর্ঘনিশ্বাস ছাড়ে। সে এই গুরুকূলের জ্যেষ্ঠতম ছাত্র।উপরন্তু ব্রাহ্মণকুলজাত। মেধায়, মননে এবং কুলগৌরবে সকলের চেয়ে উত্তম। গুরু তাকে অত্যন্ত স্নেহ করেন বলেই মনে হয়। এইসব কারণে সে সহপাঠীদের সঙ্গে অধিক মেলামেশায় অভ্যস্ত নয়। ইতিমধ্যে কুটিরদ্বারে একটি সন্ধ্যাপ্রদীপ জ্বালিয়ে দিয়ে যায় এক আশ্রমবালা। প্রদীপের আলোকশিখা মৃদু মৃদু কাঁপছে বাতাসের দমকে। কম্পিত হচ্ছে কুটিরের সম্মুখভাগে সমাসীন অবয়বগুলোর প্রতিচ্ছবি। ওই প্রদীপ শিখাটির দিকে তাকিয়ে কমলায়ন তার বিক্ষিপ্ত মনটিকে বিন্যস্ত করবার প্রচেষ্টা করে। স্মরণে আনে তার এযাবৎ অধীত বিদ্যা।
আচার্য বলেন আর্যরা নাকি বহির্দেশীয়। তবুও এই সিন্ধু দেশের জল হাওয়ায় সিঞ্চিত হয়ে এই সভ্যতা ধারণ করেছে তার নিজস্ব রূপ। কথিত আছে বহুবছর আগে পারশনি নদীর তীরে প্রধান দশটি আর্য উপজাতির ভয়ানক যুদ্ধ হয়। এই যুদ্ধে বিজয়ী হন ভারত উপজাতির রাজা সুদাস। ক্রমে ভারত এবং পুরু উপজাতির সংমিশ্রণে গড়ে ওঠে শক্তিশালী কুরু জনপদ। অবশেষে অতিবাহিত হয়েছে আর্য সভ্যতার সেই উষাকাল। ধীরে ধীরে গ্রামজ এই সভ্যতার ব্যাপ্তি সপ্তসিন্ধুর সীমানা পেরিয়ে; যমুনা শতদ্রু অববাহিকা ছাড়িয়ে বিস্তৃত হচ্ছে গঙ্গা যমুনা দোয়াব অভিমুখে।মধ্যদেশে বেদ ক্রমশ সমৃদ্ধ হচ্ছে। শ্রুতি মাধ্যমে ব্যাপ্ত হচ্ছে প্রজন্ম থেকে প্রজন্মান্তরে। প্রতি প্রজন্মেই ঘটে চলেছে নবীন সমাহার। বহু চিন্তাবিদ নানা ভাবে ব্যাখ্যা করছেন এই জগৎ ও জীবন। জ্ঞান বহু ধারায় নানা অভিমুখে বয়ে চলেছে। তবে একই সঙ্গে সামাজিক জীবনেও আসছে বহুবিধ পরিবর্তন। আর্যদের দখলীকৃত অংশ থেকে হটে যাচ্ছে আদিম অধিবাসীদের দল। আশ্রয় নিচ্ছে দুর্গম অরণ্যে, গিরিকন্দরে। তাদের প্রতি আর্যসমাজ পোষণ করছে ঘৃণা। কিছু উপজাতি অবশ্য নতমস্তকে আর্য সভ্যতার প্রভুত্ব স্বীকার করেছে। অঙ্গীভূত হয়েছে বর্ণপ্রথায়। তারা অবশ্য শূদ্র অথবা দাস। বর্নপ্রথাও ধীরে ধীরে কঠোর হচ্ছে। নারীদের অধিকারও অনেক হ্রাস পেয়েছে তুলনামূলকভাবে। আগে নারী ছিল স্বেচ্ছা বিহারিণী। যথা গাব স্থিতাঃ, স্বতন্ত্র, স্বেচ্ছাবিহারিণী।এখন পুরুষ হস্তের পুত্তলিকা মাত্র। খাদ্যাভ্যাসেও অনেক পরিবর্তন এসেছে। যাযাবর কৌম এখন থিতু হয়েছে নির্দিষ্ট স্থানে। চাষ আবাদ হচ্ছে বহুলভাবে। শিক্ষায় নারী ও পুরুষ সকলের সমান অধিকার থাকার কথা। কিন্তু নারীদের শিক্ষাজীবন সঙ্কুচিত হয়েছে। সম্ভবত আরও হবে। সমাজ সম্পূর্ণভাবে পুরুষের অধিকৃত।
এই পরিবর্তনগুলো কতটা যথার্থ তা জানেনা কমলায়ন। সংশয় জাগে তার মনে। আরও বহু বিষয় নিয়ে তার মনে সন্দেহ জাগে। আচার্যও কিছু বলেননা। প্রশ্ন করলে আজকাল তিনি স্মিত হেসে এড়িয়ে যান। কিন্তু কমলায়ন জানে গুরুবাক্য অপ্রতীম। গুরু যা বলবেন তাই অভ্রান্ত। সে আচার্য সত্যকাম জাবালের গৃহে অধ্যয়নরত এক শিষ্য। আচার্য সত্যকাম এক ক্রান্তদর্শী ঋষিবর। তার গৃহে অন্ত্যেবাসীরূপে পাঠরত আছে বহু তরুণ প্রতিভা। সে স্বয়ং এই গুরুগৃহে দ্বাদশ বর্ষ ব্যাপী অবস্হান করছে। এই কথাটি মনে পড়তেই আবার তার মনোযোগ বিচ্ছিন্ন হল। পুনরায় সে আক্রান্ত হল বিষাদে। দীর্ঘকাল সে আচার্যের ঐকান্তিক সেবা করেছে। বহুবছর ধরে পালন করেছে আচার্য গৃহের অগ্নিস্হানসমূহ। তবুও আচার্য বিগলিত হননি। শিক্ষাজীবন সমাপ্ত হয়নি তার। শ্রেষ্ঠ ছাত্র হিসেবে ব্রহ্মজ্ঞানের সর্বোত্তম দাবিদার সে। কিন্তু সেই জ্ঞান আজও তার অধরা। গুরু তাকে সেই অরূপরতনের স্বাদ দেননি। কিন্তু কেন! হয়তো আজও তার কায় এবং চিত্ত সম্পূর্ণরূপে পরিশুদ্ধ নয়। হয়তো পূজাচার সম্পূর্ণ হয়নি তার। হয়তো জাগতিক কামনা বাসনা আজও নিবৃত্ত হয়নি তার। এ তার চিত্তবৃত্তির দোষ। কমলায়ন আরও বেদনাহত হয়ে ওঠে। সঙ্গে সঙ্গে তার কপালের মধ্যে কয়েকটি ভাঁজ ফুটে ওঠে। কিছু চিন্তা দখল করে নেয় তাকে।
গুরু সত্যকাম ভ্রমণ করতে বেরিয়েছেন। বিভিন্ন স্থান পরিভ্রমণ করবেন তিনি। তারপর ফিরবেন গৃহে। ত্রি মাসাধিককাল প্রায় অতিক্রান্ত। কবে ফিরবেন তার ঠিক নেই। এই উপযুক্ত সময়। এর মধ্যেই কঠোর কৃচ্ছ্রসাধন করে ব্রহ্মবিদ্যা লাভের ক্ষেত্র প্রস্তুত করতে হবে।
সেদিন রাতে খাদ্য পরিবেশনের সময় গুরুমাতা দেখলেন অনুপস্থিত সেই তীক্ষ্মধী ঋষিকুমার। এতবছরেও গুরুদেব যাকে মুক্তি দেননি। সেই অমোঘ বিদ্যা, যাকে সকলে বলে ব্রহ্মবিদ্যা,এখনও তার করায়ত্ত হয়নি। কী করে শিক্ষা সম্পূর্ণ হবে তার!শোকে দুঃখে অথবা তীব্র জেদে খাদ্য পর্যন্ত ত্যাগ করেছে বাছাটি। শুরু করেছে কঠোর কৃচ্ছ্রসাধন। কি তার মনে আছে কে জানে! গুরুপত্নীর হৃদয় আশঙ্কিত হয়ে ওঠে। তিনি মাতা। সন্তানসম এই পুত্রটির এত কষ্ট তিনি সহ্য করতে পারেন না। কি সেই বিদ্যা কে জানে! তিনি নিরুপায় বোধ করেন। নিজের অজান্তেই একটি দীর্ঘনিশ্বাস পড়ে তাঁর।
৩
যমুনা নদীর তীর থেকে কিছু দুরেই অবস্থিত গুরু সত্যকাম জাবালের আশ্রম। তিন মাসাধিক কালের ভ্রমণ সম্পন্ন করে তিনি ফিরছেন নিজ আশ্রমে। এই পুণ্যশীলা যমুনা নদী এক সময়ে পবিত্র সরস্বতী নদীর একটি শাখা ছিল। বিধাতার অদ্ভুত খেয়ালে দিক পরিবর্তন করে সে গঙ্গানদীর সাথে মিশে গেছে। আর সরস্বতী নদী হয়ে যাচ্ছে ক্ষীণকায়া। যমুনা নদীর মধ্যগতিতে পার্শ্বে কুরুদেশ এবং নিম্নগতিতে পার্শ্ববর্তী পাঞ্চালদেশ। সুদূর উত্তরে হিমবন্ত পর্বতমালা। যমুনার তীরবর্তী অরণ্যপ্রদেশের মাঝখান দিয়ে ফিরছেন ঋষিবর। এই বর্ষায় অরণ্যপথ দুর্গমতর; অরণ্যের ঘন সবুজের নিবিড় আবহে নাম না জানা এক রক্তবর্ণ পুষ্পের মদমত্ত শোভা। আকাশে প্রমত্ত মাতঙ্গের মতো কৃষ্ণ মেঘরাশি। চতুর্পার্শ্বে সপ্তপর্ণী, অশোক এবং মহাভুজ শাল বৃক্ষাদি। সবই বর্ষাজলে সজীব। মাঝে মাঝেই কেতকী, কামিনী ও যূথিকার উন্মনা করা সুগন্ধ। পথে চলতে চলতে গুরু সত্যকাম জাবাল তার মায়ের কথা ভাবছিলেন। মাতা তার অস্তিত্বের সাথে সম্পৃক্ত। তার পরিচয়েই তিনি পরিচিত। নিজের পিতৃ পরিচয় জানেন না সত্যকাম। মনে পরে যায় দীন পর্ণকুটিরে মাতার সাথে দিনযাপনের প্রতিটি মুহূর্ত। শূদ্রা দাসী মাতা অপরের গৃহকাজে ব্যস্ত থাকতেন সর্বদা। তিনি একে শূদ্রাণী, তায় দাসী। অতএব তিনি প্রভুদের আদেশ পালনে বাধ্য ছিলেন। সমস্তরকম আদেশের। তিনি গণিকা ছিলেন না, ছিলেন না রূপোপজীবীনীও। স্বৈরিণী তো অবশ্যই নম। তাঁর একমাত্র অপরাধ ছিল তার দাসত্ব। অতএব সত্যকামের পিতৃপরিচয় ছিল অজানা। প্রথম যেদিন মেধাবী কিশোর সত্যকাম তার মাতাকে নিজের পিতার নাম ও গোত্র শুধিয়েছিল,মাতা অপ্রতিভ হয়ে যান। তারপর নিজেকে গুছিয়ে নিয়ে ভাবতে বসেছিলেন সত্যকামের পিতৃপরিচয়। কে হতে পারে? কে তার পুত্রের পিতা! ওই নিয়মের পরাকাষ্ঠা স্বল্পক্ষম ব্রাহ্মণ, রমণকালে যার মুখ থেকে লালা নিঃসৃত হত। নাকি ওই উদ্দাম ক্ষত্রিয় কুমার, পেলব সুশীলা স্ত্রী যাকে সন্তুষ্ট করতে পারেনি কখনও। দাসীর ক্রোড়ে সন্তোষ খুঁজে বেড়াতেন তিনি। অথবা ওই রাজকুলজাত যুবা যিনি চুম্বনে বিশেষ পারঙ্গম ছিলেন, অথচ যার আশ্লেষ সময়ের পূর্বেই শিথিল হয়ে যেত। কিংবা সেই বৈশ্যকুমার যিনি কোনোরূপ ভূমিকা ছাড়াই লিপ্ত হতেন রমণকার্যে। তীব্র চিন্তায় দীর্ঘাঙ্গী মাতার সশক্ত তাম্রাভ শরীরটি নুয়ে পড়েছিল তখনই।
নাহ্, গুরু গৌতমের কাছে সে তার কোনও পরিচয় দিতে পারেনি। মাতার পরিচয় নিয়ে সে হয়ে গিয়েছিল সত্যকাম জাবাল। জবালা তার মাতা। কিন্তু তার বহুভোগ্যা মাতা পুত্রের পরিচয়দানে কোনও শঠতার আশ্রয় নেননি। আশ্চর্যের বিষয় যে গুরু গৌতমও তার পরিচয়কে শিক্ষার শর্ত হিসেবে গণ্য করলেন না। সত্যকাম এবং তার মাতা জবালার সত্যবাদিতাকে মর্যাদা দিয়ে তাকে শিষ্যত্বে বরণ করলেন।
এইসব ভাবতে ভাবতে তার মনে পড়ল শিষ্য কমলায়নের কথা। কমলায়ন অতি মেধাবী এক ব্রাহ্মণ যুবা। কুলগৌরবে অভিমানী। ব্রহ্মবিদ্যা অন্বেষণ করে চলেছে। আচার্যের মুখটি অতি বিচিত্র এক হাসিতে ভরে যায় তখনই। হাসতে হাসতেই সাবধানে পা চালান তিনি। অতি শীঘ্রই গৃহে পৌঁছনো প্রয়োজন। বর্ষাকাল অরণ্য প্রানীদের প্রজননের সময়। তিনি বিশ্বাস করেন এই সময়ে কোনওরূপ বিঘ্ন হওয়া উচিত নয়। এর পরেই গর্ভাধান করবে তারা। শ্যামলিমা পৃথিবীর বুকে নতুন প্রাণের সঞ্চার হবে। কিশোর বয়সে বহুদিন সত্যকাম কাটিয়েছেন আচার্য গৌতম প্রদত্ত গাভীকুলের সাথে। অরণ্যবাসে। গুরু গৌতম তাকে গাভী পালনের দায়িত্বে নিযুক্ত করেছিলেন। সে এক আশ্চর্য সময়। দীর্ঘদিন গাভীদের সাথে থাকতে থাকতে সত্যকাম বিস্মৃত হয়েছিলেন তাঁর ন্যূনতম আত্মবোধটিও। নিজেকে মনে হত অপর এক গাভীমাত্র; মস্তিষ্ক ছিল শূন্য, এক অতলান্ত গহ্বরসম। বোধহীন।
৪
অরণ্যে ঘোর বরিষণ। হাওয়ার বেগে মাতাল হয়েছে বৃক্ষরাজি। কমলায়ন এই দুর্যোগের রাতেও অগ্নিস্থল পর্যবেক্ষণ করছে। সাথীরা সব নিদ্রাতুর। সে অগ্নির পাশে দণ্ডায়মান। কয়েকদিনের অনশন তাকে শীর্ণকায় করে তুলেছে। শরীরও অতিশয় দুর্বল। মাথায় ভেতরে তীব্র কোনও বাদ্যের দ্রিমিদ্রিমি রব। চোখের তলায় কালিমা। এদিকে ধিকিধিকি জ্বলছে অগ্নিস্থল। তিনদিক ঘেরা থাকায় আড়াল পেয়েছে পর্যাপ্ত। প্রতিটি অগ্নিস্থল পর্যায়ক্রমে টহল দিচ্ছে সে। এ এক গুরুদায়িত্ব। বারিধারা ভিজিয়ে দিচ্ছে তার শীর্ণ অবয়ব। তবু সে কর্তব্যে তিলমাত্র ফাঁক রাখেনা। দমকা হাওয়া অক্ষম ক্রোধে ঘুরে বেড়ায় চারিধার। পবনদেবের সঙ্গে খেলতে খেলতে অগ্নিদেব মুচকি হাসেন বুঝিবা। তিনদিকের অগ্নি আরও উজ্জ্বল হয়ে ওঠে। মনে হয় যেন তিন দিকের অগ্নি ক্রমশ এগিয়ে আসছে তার দিকে। চোখ ধাঁধিয়ে যায় সেই তীব্র আলোকে। কমলায়নের হৃদয়ে এক অদ্ভুত বোধের উৎপত্তি হতে শুরু করে। মনে হয় সেই অগ্নি যেন সাক্ষাৎ সূর্য দেব। তিনি পৃথিবীর ভাগ্যনিয়ন্তা, খাদ্যভাণ্ডারের উৎসলোক। সূর্য, পৃথিবী, উদ্ভিদ ও প্রাণিজগৎ সমস্ত এক সারিবদ্ধভাবে নেচে ওঠে সেই লেলিহান অগ্নিশিখার ভেতরে। অগ্নির দিকে আকুল দৃষ্টিতে তাকায় সে। সেই অগ্নিশিখায় ভেসে ওঠে চন্দ্র, তারকা এবং বিপুল জলরাশির প্রতিচ্ছবি। অগ্নিও জ্বলছে লেলিহান। সেই অগ্নিশিখায় জেগে ওঠে আকাশ, মৃত্তিকা, সমগ্র ব্রহ্মাণ্ড কিংবা বিপুল এ চরাচর। জারিত হয় সমস্ত প্রাণরস। প্রজ্জ্বলিত হয় তীক্ষ্ম বিদ্যুল্লেখা। এই কী ব্রহ্ম! এই কী তার স্বরূপ! এ তো ইহ জগতের প্রতিচ্ছবি! কিছু মাত্র পরাবাস্তব নয়! কমলায়ন স্তম্ভিত হয়ে যায়। মিথ্যা নয় এ মাটির পৃথিবী। ব্রহ্ম কিছুমাত্র অলৌকিক নয়। সমস্ত বস্তুতেই তার অধিষ্ঠান।
৫
কুটির দ্বারে প্রবেশ করলেন আচার্য। ছাত্ররা সব কার্য স্থগিত রেখে ছুটে এল। আচার্য দু হাত তুলে তাদের অভিবাদন জানালেন। এদিকে গৃহে প্রাত্যহিক কার্যান্তে গুরুমাতা উপকোশলকে স্বহস্তে খাদ্য পরিবেশন করেছেন। উপকোশল সেই খাদ্যগ্রহণ সম্পূর্ণ করেছে মাত্র। আচার্য মাধবীলতা মঞ্জরিত কুটির দ্বার হতে প্রবেশ করলেন ভিতরে। উপকাশলের মুখোমুখি হতেই তিনি এক প্রশান্ত হাসি হাসলেন। উপকোশলের শীর্ণ মুখখানি আজ অতিশয় উজ্জ্বল। চোখের তারায় আশ্চর্য এক শান্তি বিরাজিত। গুরুমাতা পাশে বসেছিলেন সন্তানটির। আচার্যকে দেখামাত্রই উভয়ে শশব্যস্ত হয়ে উঠে দাঁড়ালে। গুরু সত্যকাম গভীরভাবে শিষ্যকে পর্যবেক্ষণ করছেন। কিছুক্ষণ দেখবার পর তিনি স্মিত হাসলেন। তারপর বললেন, "বৎস তুমি আজ স্বশিক্ষিত, স্বয়ংসম্পূর্ণ। তোমার মুখমণ্ডলে সেই প্রসন্নতা। বোধ করি তুমি সেই পরম তত্ত্বের স্বরূপ অনুধাবন করতে পেরেছ।" উপকোশল ত্বরিৎগতিতে গুরুর পদতলে উপবেশন করল। তারপর মাথা তুলে বলল "আমি বুঝেছি ব্রহ্ম কী। আমার নিজের মত করে। কিন্তু আচার্য এই কি সত্য! আপনি বলুন গুরুবর। আপনি যা বলবেন তা অভ্রান্ত।" আচার্য এক অদ্ভুত দৃষ্টিতে শিষ্যের দিকে তাকালেন। বললেন, "বৎস, আমি অভ্রান্ত নই; ইহ জীবনে কেউ অভ্রান্ত নয়। অভ্রান্ত তোমার- আমার বিবেকবোধ, তোমার-আমার অন্তরাত্মার কণ্ঠস্বর এবং সত্যপ্রিয়তা। আচার- বিচার যুগে যুগে বদলায়, বদলায় সমাজ ও তার দৃষ্টিভঙ্গি, কিন্তু বদলায়না বিবেকের কষ্টিপাথরে উত্তীর্ণ সত্যের স্বরূপ। সেই বিবেককে হারিও না বৎস। সেই তোমার ব্রহ্ম। তাকে পাবার জন্য কঠোর কোনও পূজাচারের প্রয়োজন নেই বৎস। যাও, এই জগৎ সংসারের হিতে নিজের জীবন উৎসর্গ কর। নিজে যা অনুধাবন করেছ, অপরকে জানাও।
এই বলে তিনি স্তব্ধ হন। আশায় থাকেন সেই ব্রহ্মের উদ্ভাস ধীরে ধীরে আলোকিত করবে কমলায়নের অস্তিত্ব। যে ব্রহ্ম সত্য রূপে প্রকাশিত হয়েছিল তার অশিক্ষিতা, বহুভোগ্যা ,শূদ্রাণী মাতার অশ্রু বিজড়িত দুই চোখে, কিংবা উদ্ভাসিত হয়েছিল গুরু গৌতমের অক্ষি গোলকে, অথবা একজন বেজন্মা কিশোরের দু নয়নে।
আজ এক সুন্দর প্রভাত। বর্ষা থেমে গেছে বনস্থলীতে। মন্দাক্রান্তাগামিনী গর্ভিণী মেঘের আড়াল থেকে অর্কদেব বেরিয়ে এলেন প্রসন্নমনে। ধীরে ধীরে পাখির কলকাকলিতে ভরে যাচ্ছে অরণ্যপ্রদেশ। উচ্চকুলশীল কমলায়নের দু চোখে তখন অশ্রুপ্লাবন। সে লুটিয়ে পড়ে তার গুরু জারজ, কূলহীন, শূদ্রাসম্ভূত সত্যকাম জাবালের পদতলে।