Advertisment

গুপ্তচরদের রাজপুত্রের ইতিহাস নাকি জীবনের রূপকথা?

বিবিসির স্বনামধন্য সাংবাদিক, লেখক এবং নেতাজির জীবনীকার মিহির বসুর বই ‘সিলভার: দ্য স্পাই হু ফুলড নাৎসিজ’ (Silver: The Spy Who Fooled the Nazis) আগাথা ক্রিস্টির থ্রিলারের চেয়েও বেশি রোমাঞ্চকর।

author-image
IE Bangla Web Desk
New Update
NULL

অলংকরণ- অরিত্র দে।

সিলভার: দ্য স্পাই হু ফুলড নাৎসিজ’

Advertisment

মিহির বসু

আলেফ বুক কোম্পানি

তাঁর ব্যক্তিত্বে আর জীবনে পরতে পরতে লেগে আছে নানান অধ্যায় আর রং! আদতে তিনি “গুপ্তচরদের রাজপুত্র” নাকি নেতাজির সংগ্রাম আর স্বদেশী বিপ্লবের তথ্য ব্রিটিশকে পাচারকারী এক “বিশ্বাসঘাতক” সেই নিয়ে তর্ক বহুদূর। সেই ভগত রাম তলওয়ার থুড়ি ইংরেজদের প্রিয় ‘সিলভারে’র বর্ণিল জীবনের গল্প লিখতেই প্রথম কলম ধরেছিলেন চেকোস্লোভাকিয়ার ইতিহাসবিদ মিলান হাউনার তাঁর বই ‘ইন্ডিয়া ইন অ্যাক্সিস স্ট্র্যাটেজি’তে। সেই পথে আরো এগিয়েই এবার লিখলেন বিবিসির স্বনামধন্য সাংবাদিক, লেখক এবং নেতাজির জীবনীকার মিহির বসু তাঁর ‘সিলভার: দ্য স্পাই হু ফুলড নাৎসিজ’ (Silver: The Spy Who Fooled the Nazis) বইটি। আগাথা ক্রিস্টির থ্রিলারের চেয়েও বেশি রোমাঞ্চকর অথচ কল্পকাহিনী তো নয়, বরং বইটির আদ্যোপান্ত নিটোল সত্য আর তথ্য দিয়ে ভরপুর। বিভিন্ন দেশের সংগ্রহশালায় রক্ষিত নথি থেকে রীতিমতো গবেষণা করে তুলে আনা প্রতিটি লাইন! এই সংবেদনশীল অথচ গুরুত্বপূর্ণ বিষয়টিকে লেখার বিষয়বস্তু হিসেবে নির্বাচন করার জন্য লেখকের প্রতি পাঠক হিসেবে কৃতজ্ঞতা জানাতেই হয়।

কে এই ভগতরাম? কখনো তিনি ত্রাতা, কখনো আবার বানচাল করে দিয়েছেন স্বদেশীদের সমন্ত হিসেব। সুভাষচন্দ্র বসুর মহানিষ্ক্রমণে শিশিরকুমার বসুর ভূমিকা ভগতরামের কারণেই ইংরেজ গোয়েন্দারা জেনে যায় এবং শিশিরবাবু লাহৌর ফোর্টে বন্দিও হয়েছিলেন। পেশওয়ারে গ্রেপ্তার হন মিয়া আকবর শাহ, আবাদ খান। কিন্তু ভগতরামই ছিলেন পেশওয়ার থেকে কাবুল যাত্রায় ও তার পর চল্লিশ দিনের বেশি কাবুলে নেতাজির সঙ্গী।

অক্ষশক্তির গার্বো, সোভিয়েত ইউনিয়নের জোর্গ কিম্বা জার্মানির সিসেরোর মত তাবড় তাবড় গুপ্তচরদের সাথে একই সারিতে উচ্চারিত যার নাম, এই হিন্দু পাঠানের হাতিয়ার বলতে ছিল ভাঙ্গা ইংরিজি, সাধারণ ছোটখাটো নজরে না আসার মত চেহারা আর ক্ষুরধার বুদ্ধি। ইতালি, জার্মানি, ব্রিটেন, জাপান আর সোভিয়েত ইউনিয়নের মত পঞ্চপান্ডবের জন্য “কুইন্টুপুল এজেন্ট” হিসেবে চরবৃত্তি করেও বেঁচে গিয়েছিলেন ভগতরাম। তবে এই প্রতিটি দেশের প্রতি একইরকম অনুগত তিনি ছিলেন না।

মিহির বসুর কথা অনুযায়ী, নেতাজির জীবনী ‘লস্ট হিরো’ লেখার সময়েই তিনি ভগতরাম সম্পর্কে সন্দিহান ছিলেন। নেতাজির মহানিষ্ক্রমণের সকল সঙ্গী কারাগারে নির্যাতিত ছিলেন, অথচ একমাত্র ভগতরাম কখনো জেলে যাননি। কারণ হিসেবে ভগতরাম যদিও দাবী করেছিলেন যে তিনি জনজাতি অঞ্চলে ছিলেন বলে ইংরেজরা তাঁকে ধরতে পারেনি। আকবর শাহ বলেছিলেন, নেতাজির পেশওয়ার থেকে কাবুল যাওয়ার সব ব্যবস্থা যখন হয়ে গেছে তখন ভগতরাম দেখা করতে আসেন। নেতাজির যাত্রাসঙ্গী হওয়ার জন্য খুব পীড়াপীড়ি করতে থাকেন। এ রকম বিপজ্জনক যাত্রায় তিনি যেতে চান দেখে খুশিও হয়েছিলেন শাহ। ভগতরাম শহিদ পরিবারের ছেলে। তাঁর দাদা হরিকিষানকে ইংরেজরা ফাঁসি দিয়েছিল। তাই ভগতরামকে ভরসা করে সঙ্গী করতে কারো অসুবিধে হয়নি তখন। অথচ সুভাষচন্দ্র যখন তাঁকে একান্ত বিশ্বাস করে নানা রকম খবর দিতেন, ভগতরাম তাঁর সঙ্গে ছলনা করে যেতেন ক্রমাগত। তিনি সবচেয়ে বেশি বঞ্চনা করেছেন জার্মানদের| নেতাজির সঙ্গী হিসেবে ছদ্মনামধারী ‘রহমত খান’কে বিশ্বাস করে জার্মানরা আজকের হিসেবে প্রায় ২.৫ মিলিয়ন অর্থমূল্য এমনকি ‘আয়রন ক্রস’ নামে জার্মানির সর্বোচ্চ মিলিটারি সম্মানও দিয়েছেন ভগতরামকে । কিন্তু তিনি জার্মানদের দেওয়া শক্তিশালী ট্রান্সমিটার নিয়ে দিল্লির বড়লাট সাহেবের বাড়ির বাগানে বসে বার্লিনের সিক্রেট সার্ভিসকে নানা ভুল তথ্য পাঠিয়ে বিভ্রান্ত করেছেন। মিহির বসু লিখছেন, ভগতরাম তলওয়ার ছিলেন কমিউনিস্ট, তাঁর আনুগত্য ছিল সোভিয়েত রাশিয়ার প্রতি। নেতাজি তাঁকে বিশ্বাস করে যে সব খবর পাঠাতেন তা প্রথমেই চলে যেত রাশিয়ার হাতে। পরে ‘সিলভার’ নামধারী এজেন্ট হয়ে সেই খবর পাচার করতেন ব্রিটিশদের।

হাউনার প্রথম তলওয়ারের বিশ্বাসঘাতকতার হদিশ দিলেও দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে তাঁর ভূমিকা, গুপ্তচরবৃত্তি এবং নেতাজিকে ধোঁকা দেওয়ার বিস্তারিত বিবরণ মিহির বসুর এই বইটি ছাড়া পাওয়া সম্ভব ছিলনা। কারণ ভগতরাম নিজে যে বইটি লিখেছিলেন “দ্য তলওয়ার্স অফ পাঠানল্যান্ড এন্ড সুভাষ চন্দ্র’স গ্রেট এসকেপ” নামে, তাতে তিনি সত্যকে অনেক বেশি দুমড়ে মুচড়ে দিয়েছিলেন । নিজের আসল স্বরূপ কখনই প্রকাশ করেননি।

মিহির বসুর বইটির ভাঁজে লুকিয়ে আছে ভগতরামের জীবনীর পাশাপাশি ভারতে কমিউনিস্ট আন্দোলনের গোড়ার দিকের কথা। এমনকি যে ভগতরামের ভাই ব্রিটিশবিরোধী শহীদ, তিনি নিজে কি করে তাঁদেরই গুপ্তচরে পরিণত হয়েছিলেন সেই অভিজ্ঞতা এবং টানাপোড়েনের খতিয়ান তীক্ষ্ণ বিশ্লেষণে লিপিবদ্ধ করেছেন লেখক। অন্যদিকে স্বাধীনতা আন্দোলনের স্বরূপ বিচারে মিহির বলেছেন, গান্ধীজির জাদুকাঠি হেলানোয় ব্রিটিশ চলে গিয়েছিল ভারত ছেড়ে এমনটা না ভেবে বরং আরো গভীর কারণের অনুসন্ধান করা উচিত। ইতিহাসের বাঁক নিয়ে আলোচনায় মিহিরের কলমে উঠে এসেছে চার্চিলের হিন্দুবিরোধী মানসিকতার ছবিও, “Eventually, the Moslems will become master, because they are warriors, while the Hindus are windbags”।

খাইবার পাস হয়ে আফগানিস্তান যাওয়ার পথে ভগতরামকে নিয়ে দুশ্চিন্তায় থাকতেন ফ্লেমিং, যিনি তাকে ব্রিটিশদের গুপ্তচর হিসেবে নিয়োগ করেছিলেন। একবার একজনের পাল্লায় পড়লেন তলওয়ার যিনি তাঁর পরিচয় ফাঁস করে দিতে পারতেন যে কোন সময়ে। অথচ একটুও না ঘাবড়ে তাঁর সাথেই বন্ধুত্ব করে ফেললেন তলওয়ার। তারপর কাবুলে এক আহারসভায় তরকারিতে বাঘের ধারাল গোঁফ মিশিয়ে লোকটির ইহলীলা সাঙ্গ করে দিলেন তিনি। শিবাজীর সেই বাঘনখে আফজল খাঁকে ধরাশায়ী করার মত ব্যাপারখানা যেন ঠিক! নিজের কাজ নিয়ে এতটাই সতর্ক এবং হিংস্র ছিলেন তিনি।

ওয়ার স্পাইরা যেখানে সাধারণভাবে একই বেস থেকে কাজ করে থাকেন সেখানে সিলভার বারবার যাতায়াত করেছেন কাবুল আর ভারতের মধ্যে। সেখানেই তিনি আলাদা অন্যদের চেয়ে পেশওয়ার আর কাবুলের মধ্যে প্রায় বারোবার তাঁকে বিপদসংকুলভাবে যাতায়াত করতে হয়েছিল।

১৯৪৮ সালের পর থেকে তিনি কিন্তু চলে যান লোকচক্ষুর আড়ালে। সবাই যখন ধরেই নিয়েছে প্রায় যে তিনি মৃত, হটাত সত্তরের দশকে নেতাজিকে নিয়ে কলকাতায় সংঘটিত একটি সেমিনারে স্পিকার হিসেবে তাঁর পুনরাবির্ভাব ঘটে। তবে ১৯৮৩ সালে তাঁর কোথায় কিভাবে মৃত্যু হল সেই নিয়ে কোনো বিশদ খোঁজ মিহিরের বইটিতে পাওয়া যায়নি।
ছোট ছোট উপাখ্যান আর প্রমাণে সাজিয়ে চিরকালীন সুলেখক এবং গবেষক মিহির যেভাবে ইতিহাস খুঁড়ে তুলে এনেছেন বইয়ের পাতায়, অনবদ্য ভাষা এবং লেখনীর দক্ষতায় বুনে গিয়েছেন টানটান রচনা, তাকে গল্প নাকি প্রবন্ধ কি বলা উচিত দ্বন্দ্বে এবং ধন্ধে থাকেন পাঠক। শুরুর কিছু অধ্যায়ে দাঁড়িকমা এবং প্রুফরিডিংয়ের অবহেলাকে যদি প্রকাশকের গাফিলতি ধরে নেওয়া যায়, তবে বইটি নিয়ে লেখকের প্রতি সত্যিই অনুযোগের আর কোন কারণ থাকেনা । রয়েছে কিছু অনবদ্য ছবি । প্রচ্ছদে দ্বৈত মুখ আর যাত্রাপথের বাঁক যেন বুঝিয়ে দেয় সত্যিই ভগতরাম আর সিলভার একই মুদ্রার দুই পিঠ । যার জীবনে শুধু অন্তহীন পথচলা ।

বসু লিখছেন, “If anything, he had developed into an even more skilful liar, one willing to take on even those who had had well authenticated evidence to the contrary to prove that he had been one of the greatest deceivers in history”। এই শীর্ষখ্যাতি নিয়ে যতই তর্ক থাক, সিলভারের পরিচয় গরিমাবহুল হবে কিনা সেই নিয়ে দ্বিমত থাক, তাঁর কর্মপদ্ধতি এবং গুপ্তচরীয় স্বকীয়তা নিয়ে কোন দ্বিরুক্তি হওয়া উচিত নয়। মিহিরের নিখাদ গবেষণার আলোকে যে সিলভারকে আমরা চিনেছি, একজন স্বল্পশিক্ষিত এবং মধ্যবিত্ত মানুষের অত মেধা দেখে বিস্মিত না হয়ে উপায় থাকেনা, যতই সে হোক নিপাট মিথ্যেবাদী আর ধুরন্ধর।  বইটি যখন শেষ হয় একদিকে যেমন বেড়ে গিয়েছে মিহিরের লেখার প্রতি শ্রদ্ধা, অন্যদিকে দক্ষতায় জেমস বন্ডকে হার মানিয়ে দেওয়া সিলভারকে ঘৃণা করতে করতেও মুগ্ধতার স্বর্ণপদক দিতে ইচ্ছে করে। বিখ্যাত স্পাই লেখক জন লে কারে যেমন স্পাই নভেল নিয়ে বলে গিয়েছেন “harness it as a good story”..... মিহিরও হয়ত ঠিক সেই চেষ্টাই করেছেন তাঁর এই বইটিতে।

Book Review
Advertisment