Advertisment

ঠিক যেন এক অগ্নিবর্ণ পক্ষীরাজ

পাবলো নেরুদার জন্মদিন আজ। মাত্র বছর দুয়েক আগে তাঁর কিছু অপ্রকাশিত কবিতা বই হয়ে বেরিয়েছে। মার্কিনপ্রবাসী সাহিত্যপ্রেমী ঋতুপর্ণা ভট্টাচার্য জন্মদিনে মনে করলেন কবি নেরুদাকে।

author-image
IE Bangla Web Desk
New Update
neruda

‘‘জীবন তাঁকে বাঁধতে পারেনি কোনওদিন, কিন্তু তীক্ষ্ণ বিশেষণে অনুভূতিকে বেঁধে ফেলেছেন নেরুদা।’’

ঋতুপর্ণা ভট্টাচার্য

Advertisment

কবিতাকে যাঁরা নির্মাণশিল্প বলেন, কবিতা লেখার বর্ণপরিচয় খুঁজে বেড়ান ইতিউতি, তাঁদের কাছে একটি লাইন বেশ অস্বস্তিকর চিরকাল। লাইনটি নিয়মকে দুরমুশ করে নিজের পথ তৈরি করে চলা পাবলো নেরুদার, নিজের নোবেল অ্যাক্সেপ্টেন্স লেকচারে তিনি বলেন, “I did not learn from books any recipe for writing a poem”.

তাঁর জীবন থেকে মৃত্যু সবটুকু বর্ণিল, তেজি আকাঙ্ক্ষায়  ভরপুর। তাঁর কবিতা আর জীবন খুঁড়ে যেমন উঁকি দেয় “dialectical” ঘূর্ণাবর্ত, কাঠবেড়ালির অস্থিরতা, খরস্রোতা প্রেম আর কুচিকুচি কষ্টরা, তেমনি তাঁর মৃত্যুর বহুবছর পড়ে হঠাৎ কবর খুঁড়ে উঠে আসে গহীন অন্ধকারের মত মনকেমনের সত্যিগুলো। জুলাই মাসের ১২ তারিখ তাঁর জন্মদিন। মৃত্যুর এতদিন পরে আজও তাঁর মৃত্যুকে ঘিরে অমোঘ রহস্য, বিস্তারিত অনুসন্ধান প্রাসঙ্গিক! ঠিক যেমন প্রাসঙ্গিক হঠাৎ আলোর ঝলকানির মত খুঁজে পাওয়া তাঁর অপ্রকাশিত কবিতাগুচ্ছ, যারা বই হিসেবে প্রকাশিত হল  ২০১৬ সালে, “দেন কাম ব্যাক: দ্য লস্ট নেরুদা”! মৃত্যুর মত তাঁর কবিতাও যেন প্রত্যাবর্তন করে অহরহ।
কানাঘুষো চলছিল অনেকদিন ধরেই। ১৯৭৩ সালে প্রস্টেট ক্যান্সারে আক্রান্ত হয়ে মারা যাননি নেরুদা এমনটাই দাবি উঠছিল রাজনৈতিক এবং বিজ্ঞানী মহলে। ২০১৩ সালে নেরুদার ড্রাইভার ম্যানুয়েল বলেন যে কবি হাসপাতাল থেকে অধীর হয়ে ফোনে বলেছিলেন তাঁকে ঘুমন্ত অবস্থায় পেটে ইন্জেকশন দেওয়া হয়েছে । এরপরেই চিলির বিচারপতি মারিও ক্যারজার হাত ধরে শুরু হয় তদন্তের । শেষমেশ সাম্প্রতিক অতীতে ষোলোজন খ্যাতনামা বিজ্ঞানীর দল তাঁর মরণোত্তর দেহাবশেষের পরীক্ষার পর জানান দিলেন ডেথ সার্টিফিকেটের মত অনুযায়ী “cancer cachexia” তাঁর মৃত্যুর কারণ ছিল না । কারণ তাতে অবাঞ্ছিত ওজনহ্রাস ঘটে, অথচ মৃত্যুর সময় নেরুদা ছিলেন রীতিমতো ওবিস। তাঁর মৃত্যুর কারণ ক্যান্সার নয় এর সপক্ষে পাওয়া অনেকগুলি অন্য প্রমাণের মধ্যে এটিও একটি।  তাঁর মৃত্যুর কারণ ছিল ব্যাকটেরিয়ার সংক্রমণ। বিজ্ঞানীরা আরো আশঙ্কা করছেন ব্যাকটেরিয়াটি অনেক পুরনো গোছের । তবে এই নিয়ে শেষ সিদ্ধান্ত জানানোর জন্য প্রয়োজন আরো পরীক্ষা ।
কী হয়েছিল ঠিক তাঁর মৃত্যুকে ঘিরে? সালভাদরের কমিউনিস্ট সরকার তখন মিলিটারি হস্তক্ষেপে টলে গেছে পুরোপুরি। মৃত্যুর ঠিক দুদিন আগে তাঁর সুরক্ষার জন্য মেক্সিকান প্লেন তৈরি ছিল সান্তিয়েগ এয়ারপোর্টে। কিন্তু নেরুদার মত সংঘটিত এবং প্রভাবশালী ব্যক্তিত্ব যদি মেক্সিকো চলে যান তবে হয়ত চিলির মিলিটারি আগ্রাসনের সমূহ বিপদ ডেকে আনবেন একদিন। তাই নেরুদা যখন মানুষের ওপর আস্থা রেখে চিলিতে থেকে যেতে চেয়েছিলেন আরো দুটো দিন, তখনই হয়ত তাঁর মৃত্যুর পরোয়ানা লেখা হচ্ছিল ষড়যন্ত্রে। সেই মানুষটাকে শেষমেশ পরদিনই চলে যেতে হল। কখনো প্রেম, কখনো রাজনৈতিক আদর্শ তাঁকে ছুটিয়ে নিয়ে গেছে দেশ থেকে দেশান্তরে । কিন্তু এইবার অনেক দূরে তারার ওপারে চলে গেলেন তিনি, যেখান থেকে নিজদেশে আর কোনদিন ফেরা হলনা তাঁর । ফেরা হলনা নিজের তিনটে প্রিয় বাড়ির কাছে ।
তিনটি বাড়ির একটি হল লা চাস্কোনা, যা আসলে তাঁর একান্ত প্রেমিকা এবং প্রিয়তমা স্ত্রী মাতিলদে উরুতিয়ার আদরের ডাকনাম। তাঁরই জন্য বানানো। বিখ্যাত গায়িকা মাতিলদের ছিল লতানো লাল চুলের বাহার । সেই কেশবিন্যাসের জালে তখন জড়িয়ে আছেন নেরুদা। লিখছেন, I love you without knowing how, or when, or from where... so close that your eyes close with my dreams”। উরুতিয়াকে একটা শতাব্দী উপহার দিতে চেয়েছেন, কারণ নেরুদার কাষ্ঠল সনেটে পেলব প্রাণদাত্রী তিনি। নিজের একের পর এক বই উৎসর্গ করেছেন তাঁকেই । উজ্জ্বল রঙে সাজানো এই বাড়িতেই আছে মাতিলদের একটি দুমুখো পোর্ট্রেট, যেখানে তাঁর অবিন্যস্ত ঝাঁকড়া লাল চুলের ফাঁকে আবছা দেখা যাচ্ছে নেরুদার ছবি। যেন আত্মগোপন করে আছে প্রেমিক! উরুতিয়ার সঙ্গে প্রেমপর্বে যে প্রেমিক বহুদিন অবদি বিবাহিত ছিলেন তাঁর দ্বিতীয় স্ত্রী ডিলিয়ার সাথে। এইসব ভালবাসার গোপনীয়তায় ভরা কবি আর তাঁর আদরিনী স্ত্রীর অভিসার এবং সংসারের মিশেলটির মহিমা তাজমহলের চেয়ে কোনভাবেই হয়ত কম নয়।
নিজের ঘরবাড়ি নিজেই সাজাতে ভালবাসতেন পাবলো। এক নারীতে যেমন থিতু হতে পারেননি, তেমনি বসতি গেড়েছেন নতুন নতুন। চেয়েছেন একটা বাড়ি যেটা বাতাসে ভাসমান হবে অবলীলায়, কিন্তু যার ভিত গেঁথে থাকবে শক্ত মাটিতে। তৈরি হয়েছে প্যাসিফিকের ধারে লা সেবাস্তিয়ানা। তাতে “ক্যাপ্টেন্স বার” নামের একটি উজ্জ্বল গোলাপী রঙের প্রাইভেট বার। রঙিন কাঁচের নানান বোতল জমিয়েছেন যত্নে জানলার গা ঘেঁসে। বড় বড় জানলার ফাঁকে ফুটে উঠত অনাবিল সমুদ্রের চেহারা, ঝাপটা মারত নোনা হাওয়া। নাবিকের অস্থিরতায় প্রেমকে ছুঁয়ে দেখেছেন বলেই বারবার সমুদ্র তাঁকে টেনেছে। বানিয়েছেন আইলা নেগ্রার মত জাহাজের আদলে একটি বাড়ি। কখনো সেখানে ক্যাপ্টেনের পোশাকে অভ্যর্থনা করেছেন অতিথিদের । সেইখানেই তাঁর প্রাইভেট বারটি বেশ অভিনব। যখনই কোনও প্রিয় বন্ধু মারা যেতেন, তিনি খোদাই করে রাখতেন বারের ছাদের সাপোর্ট বিমে সেই বন্ধুটির নাম । এই বাড়িটিতেই মাতিলদের পাশে ঘুমিয়ে আছেন মানবতার জাগরণের জাদুকর। যিনি বলেছেন, If you die, I shall go on living।
মার্কেজ যাঁকে বলেছিলেন বিংশ শতকের শ্রেষ্ঠ কবি, তিনি লেখা শুরু করেছেন পাবলো নেরুদা ছদ্মনামে, স্রেফ বাবার চোখ এড়াতেই। কারণ বাবা ছেলের লেখালিখি পছন্দ করতেননা। অথচ মাত্র কুড়ি বছরে ছেলে তখন সেলেব কবি এবং কবিতার “ইরোটিক আর সেনসুয়াল” প্রেক্ষাপটের জন্য বিতর্কিত বটে । তাঁর “টোয়েন্টি লাভ পোয়েমস অ্যান্ড আ ডেসপারেট সং” (Veinte poemas de amor y una canción desesperada)” এখনো অবদি স্প্যানিশ ভাষার সর্বাধিক বিক্রিত বইগুলোর একটি । সাম্য আর স্বাধীনতার পক্ষে সোচ্চার লোকটি স্প্যানিশ সিভিল ওয়ারের সময় যে কমিউনিজমে দীক্ষিত হয়ে আজীবন তাকে লালন করেছেন হৃদয়ে, লেনিনকে বলেছেন “গ্রেট জিনিয়াস অফ সেঞ্চুরি”, সেই বামপন্থার জন্য মাশুলও গুনেছেন নানাভাবে । বিশ্বের নানা ভাষায় তখন অনূদিত হচ্ছে তাঁর লেখা। অথচ মার্কিনি পৃষ্ঠপোষকতায় পালিত “কংগ্রেস ফর কালচারাল ফ্রিডম” টার্গেট বানিয়েছে সংস্কৃতির স্তম্ভ নেরুদাকেই । তাঁর স্ট্যালিনীয় প্রভাবের জন্য ১৯৬৪ সালে নোবেল পুরস্কারের যোগ্য হয়েও পেলেন না। সার্ত্রেকে দেওয়া হয়েছিল নোবেল, যদিও তিনি সেটি প্রত্যাখান করেছিলেন। বছর দুয়েক পরেই আমেরিকার পেন কনফারেন্সে যাওয়া আটকে যাচ্ছিল প্রায়। আর্থার মিলারের মধ্যস্থতায় শেষমেশ আমেরিকায় যান নেরুদা। দেরিতে হলেও স্বীকৃতি পেয়েছিলেন নেরুদা, ১৯৭১ সালে নোবেল পেয়ে। নাকি নোবেল তাঁকে পেয়ে ধন্য হল?

তবে সত্যি প্রশ্ন জাগে, রাজনৈতিক নেরুদা নাকি কবি নেরুদা কে কাকে অতিক্রম করে গেছে গুণগত মানে? রাজনৈতিক অস্থিরতা না থাকলে তিনি কি আরো সময় দিতেন তাঁর কবিতাকে? হয়ত নয়! হয়ত নেরুদার এই দুই ভিন্ন সত্তাই তাঁকে পরিপূর্ণতা দিয়েছে। করেছে স্বতন্ত্র। অবলীলায় তিনি তুলে এনেছেন মোহময়ী সব কবিতার শস্যকণা ।
অস্থির তাঁর কবিতারা গতিপথ বদলেছে বারবার। নেরুদা জীবনের সব রং  ছুঁয়েছেন আলাদা আলাদা করে। নিজের অস্তিত্বকে চ্যালেঞ্জ করে দুমড়ে মুচড়ে তুলে এনেছেন হাজার কবিতা। রূপক আর আধ্যাত্মিকতায় মুড়ে শব্দকে দিয়েছেন মৃত্যুঞ্জয়ী ভাবনা। বিস্তৃত মহাদেশের মত বিপুল অনুসন্ধিৎসা আর স্বপ্ন জীবন্ত হয়ে ওঠার যে মৌলিক ক্রিয়া অবিরাম বইছে তাঁর কবিতায় সে অপার্থিব। জীবন তাঁকে বাঁধতে পারেনি কোনওদিন, কিন্তু তীক্ষ্ণ বিশেষণে অনুভূতিকে বেঁধে ফেলেছেন নেরুদা। তাঁর কবিতা প্রকৃতি, প্রেম, জীবন, মৃত্যু সবকিছুকে মিশিয়ে আসলে যেন স্পর্শ করেছে আরো গভীর কোন সত্যকে। আর তারই পাশাপাশি রেখে গিয়েছে এক চরম ঔদাসীন্য, If suddenly you forget me/do not look for me/for I shall have already forgotten you”, যা কেবল এক আগলখোলা কবিকেই মানায় ।

Advertisment