ঋতুপর্ণা ভট্টাচার্য
‘দ্য ওল্ড ম্যান এন্ড দ্য সি” উপন্যাসে আর্নেস্ট হেমিংওয়ে বলেছেন,“লেট হিম থিঙ্ক দ্যাট আই অ্যাম মোর ম্যান দ্যান আই অ্যাম এন্ড আই উইল বি সো”। অন্যের প্রত্যাশাকে ছাপিয়ে গেছেন বারবার নিজেই। তাঁকে লেখক, নাবিক, সৈনিক কোন আখ্যায় মেপে নেওয়া যায় আদ্যোপান্ত, তার খোঁজ চলেছে বছরের পর বছর। সম্প্রতি হার্পার কলিন্স থেকে প্রকাশিত একটি বই হাতে আসায় দেখা গেল সেই অনুসন্ধানের বেশ খানিকটা জুতসই জবাব মিলেছে এইবার। নিকোলাস রেনল্ডস রচিত “রাইটার, সেলর, সোলজার, স্পাই: আর্নেস্ট হেমিংওয়ে’স সিক্রেট অ্যাডভেঞ্চারস, ১৯৩৫-১৯৬১” (Writer, Sailor, Soldier, Spy: Ernest Hemingway's Secret Adventures, 1935-1961)। হার্ভার্ডের ডক্টরেট নিকোলাস নিজে ছিলেন আমেরিকার সিআইএ অফিসার এবং সিআইএ মিউজিয়ামের ইতিহাসবিদ। তবে ছোট থেকেই তিনি হেমিংওয়ের আগ্রাসী পাঠক এবং অনুসরণকারী। তাঁর লেখায় ফেলে আসা সময়ের বিবরণ যে নিছক অতীতের দলিল না হয়ে রামধনুর মত সাবলীল শব্দে মনোগ্রাহী হয়ে উঠবে, সেকথা বলার অপেক্ষা রাখেনা।
বিংশ শতকের আমেরিকান সাহিত্যের পুরোধা হেমিংওয়ে যতই ‘আ ফেয়ারয়েল টু আর্মস’ লিখুন না কেন, সেই যুগে যুদ্ধক্ষেত্রে তাঁর সক্রিয় ভূমিকা ছিল। লেখকের সেই জীবন নিয়ে আগে অনেক বই লেখা হলেও এই বইতে প্রথম ঐতিহাসিক নথি, ‘ডি ক্লাসিফায়েড ইন্টেলিজেন্স’ এবং ব্যক্তিগত যোগাযোগের ভিত্তিতে তাঁর দিনলিপি ফিরে দেখা হয়েছে। তাঁকে ক্রিপ্টো কমিউনিস্ট বলা চলে কিনা এই নিয়ে বিতর্কে না গিয়ে বরং নিকোলাস সুন্দরভাবে ব্যাখ্যা করেছেন সোভিয়েত এবং তাঁর পারস্পরিক অনুরাগের কারণ। প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পর মাতেকাম্বে দুর্যোগ এবং পরবর্তী সময়ে হ্যারিকেনে আমেরিকার ভূমিকা নিয়ে বামপন্থী ম্যাগাজিনে একটি কঠোর প্রবন্ধ লিখেছিলেন বীতশ্রদ্ধ হেমিংওয়ে। সেটাই হয়ত তাঁর সোভিয়েত যোগের সূত্রপাত। তিনি ১৯৩৭ সালে স্প্যানিশ সিভিল ওয়্যারে আংশিক সময়ের যোদ্ধা যেমন ছিলেন, তেমন ছিলেন সাংবাদিকও। এই বইটির লেখক সমসাময়িক তার্কিক, যোদ্ধা, লেখক, রাজনৈতিক পরামর্শদাতা ইত্যাদি সকল বামপন্থী ভাবধারার মানুষজনের সম্বন্ধ বিশ্লেষণ করে হেমিংওয়ের মতবাদ তুলে ধরেছেন। কমিউনিস্ট জরিস ইভেন্স আর সোভিয়েত ইন্টেলিজেন্সের রিক্রুটার অরলভের সাথে হেমিংওয়ের সুন্দর সখ্যের বিবরণ আছে বইতে। নাৎসি জার্মানি যখন স্পেনে ফ্যাসিস্টদের সমর্থন করছিল, তখন তিনি স্পেনে। আমেরিকা আর ব্রিটিশদের নিরপেক্ষ মতবাদে ব্যথিত হেমিংওয়ের মনে হয়েছিল ফ্যাসিবাদের বিরুদ্ধে লড়াই করার একমাত্র শক্তি হচ্ছে সোভিয়েত ইউনিয়ন। নিজের এই মনোভাবকে বর্ণনা করে পরবর্তীতে তিনি নিজেকেই বলেছিলেন, “প্রিম্যাচিওর অ্যান্টিফ্যাসিস্ট”। প্রবন্ধ, গল্প, নাটক এবং বক্তৃতার মাধ্যমে ফ্যাসিবাদের বিরোধিতা করে রিপাব্লিকান স্পেন আর সোভিয়েত পন্থী মনোভাবে নিজেকে ক্রমাগত “এজেন্ট অফ ইনফ্লুয়েন্স” হিসেবে তুলে ধরছিলেন তিনি।
আরও পড়ুন, ঠিক যেন এক অগ্নিবর্ণ পক্ষীরাজ
নিকোলাস তাঁর বইতে সোভিয়েত ইন্টেলিজেন্সে যোগ দেওয়ার কারণ হিসেবে পুরোপুরিভাবে হেমিংওয়ের এই ফ্যাসিবাদের বিরুদ্ধতাকেই দেখিয়েছেন। এমনকি সেই যোগদানের সরকারী বার্তার উল্লেখ আছে এই বইতে। এরপর অবশ্য অন্য গুপ্তচরদের মতই ক্রিপ্টোনিম দিয়ে বোঝান হত হেমিংওয়েকে। তাঁর নাম ছিল আর্গ। “দ্য সিক্রেট ফাইল” চ্যাপ্টারটিতে হেমিংওয়ের যোগদান সংক্রান্ত বিভিন্ন ঘটনার কথা আছে। তবে এই যোগদানের পরবর্তী অধ্যায়ে বইটিতে বিস্তারিত গবেষণার মাধ্যমে নিকোলাস দেখিয়েছেন হেমিংওয়ে যা ভেবে সোভিয়েতে যোগ দিয়েছিলেন এবং সোভিয়েতের তাঁর থেকে যা আশা ছিল, দুটো হয়ত সেভাবে এক বিন্দুতে মিশ খায়নি। এরপর হেমিংওয়ে সাংবাদিক হিসেবে চিনে চলে গেলে সোভিয়েতের সঙ্গে যোগাযোগ আরও অনিয়মিত হয়ে পড়ে। কিউবায় থাকার সময় আমেরিকার নৌসেনার সাথে যুক্ত হয়ে ফ্যাসিবাদের প্রতিবাদের নতুন পথ খুঁজে পান লেখক। সেই সময়েই এফবিআইয়ের সাথে মতান্তর, কিউবার স্থানীয় রাজনৈতিক দ্বন্দ্ব সবকিছুতেই জড়িয়ে গিয়েছিলেন হেমিংওয়ে। এই দ্বন্দ্বই যে আসলে লেখকের গঠনগত উপাদানগুলির অন্যতম। এমনকি “দ্য ক্রুক ফ্যাক্টরি” নামে নিজের ইন্টেলিজেন্স ব্যুরো খুলেছিলেন তিনি, যারা হাভানা আর কিউবা জুড়ে সন্দেহজনক লোকদের ওপর লক্ষ্য রাখত। নিজের মাছ ধরার নৌকো চড়ে জার্মান সাবমেরিনের ওপর নজর রাখতেন তিনি। পরবর্তীতে ইউরোপে ফ্রান্স-জার্মানির যুদ্ধে প্যারিসের মুক্তিতে আমেরিকার তরফে তিনি নিছক সংবাদদাতা নাকি “ইনফরম্যাল” যোদ্ধা ছিলেন সেই নিয়ে অবশ্য মতভেদ আছে বরাবর। এই বইটিতে লেখক গভীর চর্চা করেছেন সেই নিয়ে। বইটির অন্তিম দিকে হেমিংওয়ের জীবনের শেষ ষোল বছরের খতিয়ানও লিপিবদ্ধ করেছেন নিকোলাস । তখন আস্তে আস্তে কিউবান গৃহযুদ্ধ ঘনিয়ে আসছে। অন্যদিকে বাজারে ভাল বিক্রি হবে এমন লেখা লিখতে কষ্ট হচ্ছে হেমিংওয়ের। শারীরিক এবং মানসিকভাবে জর্জরিত হয়ে আছেন। বাইপোলার ডিজঅর্ডার, সাইকোসিস, ডিপ্রেশন, ব্রেন ইনজুরি তাঁর সঙ্গী । অথচ তখনই প্রকাশিত হচ্ছে কিউবাকে কেন্দ্র করে তাঁর কালজয়ী লেখা “দ্য ওল্ড ম্যান এন্ড দ্য সি”। নোবেল কড়া নাড়ছে দোরগোড়ায়। যে বইয়ের জন্য তিনি পেয়েছেন পুলিৎজার পুরস্কারও। সেইসময়ে তাঁর বিভিন্ন চিঠির সূত্র ধরে নিকোলাস দেখিয়েছেন সোভিয়েত সম্পর্কের কথা জানাজানি হয়ে যাওয়ার ভয় তখন কুরেকুরে খাচ্ছে তাঁকে। পাবলো নেরুদার মতই কমিউনিজমপ্রীতির জন্য জীবনভর অনেক মূল্য দিয়েছেন তিনি। তাঁর “ফর হুম দ্য বেল টোলস” বইটির জন্য পুলিতজারে মনোনীত হয়েও প্রত্যাখ্যাত হয়েছিলেন যার পরোক্ষ কারণ হিসেবে দেখান হয় স্প্যানিশ সিভিল ওয়্যারে ফ্যাসিবাদের ভূমিকার “আপত্তিজনক” মূল্যায়ন। এমনকি সেই বছর আর কাউকেই ফিকশনের পুলিৎজার দেওয়া হয়নি।
আরও পড়ুন, প্রান্তিক মানুষের ইতিহাস ও এক বিস্মৃত বই
“আইসবার্গ থিওরি” বা “থিওরি অফ ওমিশন” দিয়ে গল্পের মোচড়কে কখনও দিনের আলোর মত স্পষ্ট হতে দেননি হেমিংওয়ে, বরং সব লেখাতেই অন্তর্নিহিতভাবে বয়ে গিয়েছে এক নিবিড় অর্থ। সেই লোকটির জীবনেও হয়ত হিমশৈলের মত অনেক গভীরে প্রোথিত ছিল ব্যথার শিকড়। আমরা শুধু ডগাটুকু দেখতে পেলুম একদিন। বন্দুক আর কলম একইরকম দক্ষতায় চালাতে পারতেন যিনি, একদিন বেছে নিলেন বন্দুককেই। নিজেরই বন্দুকের ট্রিগার টেনে দিলেন নিজেকে তাক করে, হতাশার চরম কোন মুহূর্তে। “দ্য সান অলসো রাইজেস” বইটির লেখকের জীবনে সূর্য নিভে এল হঠাৎ। অথচ তাঁর সৃষ্ট সান্তিয়াগো কতই না আশার রঙিন বুদবুদ চারিয়ে দিয়েছে আমাদের মধ্যে। যুদ্ধের সাথে ওতপ্রোত জড়িয়ে ছিলেন বলেই হয়ত লেখায় বারবার উঠে এসেছে সেই রণক্ষেত্রের ছোঁয়া। কিন্তু মানবতা আর আশার সাঁঝবাতিও জ্বালিয়ে রেখেছিলেন পাশেই কোথাও। একদিকে যেমন মদের নেশা করেছেন তুমুল, কখনো আবার তলিয়ে গেছেন বল্গাহীন প্রেমে। অনেক সম্পর্কের মধ্যে সম্প্রতি “ ‘অটাম ইন ভেনিস- আর্নেস্ট হেমিংওয়ে অ্যান্ড হিজ লাস্ট মিউজ’ বইটিতে উঠে এসেছে ৩০ বছরের ছোট এক কিশোরীর সাথে তাঁর গোপন সম্পর্কের ইঙ্গিত। মনে পড়ে যায় রানু আর ভানুদাদার কথা।
সে যাইহোক, তাঁর গভীর অনুরাগী মার্কিন অফিসারটির হাত ধরে আবার তিনি উঠে এলেন শিরোনামে। বইটির বিষয়বস্তুর কথা বলা হল, তেমনি সুন্দর তার পরিবেশনা। তেরটি অধ্যায়ে ভাগ করে দেওয়া আছে বলে ঘটনার খেই হারিয়ে যায়না। পাঠকের জন্য শুরুতেই রয়েছে চরিত্রগুলির সংক্ষিপ্ত পরিচয়। রেফারেন্সের উল্লেখও বেশ গুছিয়ে রাখা। বইটিতে রয়েছে কিছু দুষ্প্রাপ্য ছবি। প্রচ্ছদে হেমিংওয়ের শান্ত আর উদাস চোখদুটি যেন পাঠককে টেনে নিয়ে যেতে প্রস্তুত বইটির মলাটের ভেতরে। যেহেতু কিছু তথ্য পূর্বপ্রকাশিত অনেক বইতে জানা হয়ে গিয়েছে, তাই দৈর্ঘ্য নিয়ে মাঝেমাঝে একটু সংশয় দেখা দেয় বটে। কিন্তু লেখকের অসম্ভব সুচারু গল্প বলার ঢংয়ে একঘেয়ে লাগেনা। হয়ত অত বর্ণিল আর কর্মময় একটি জীবনের অনেকগুলি অধ্যায়কে ঠিকমত বোঝাতে এতগুল শব্দের সত্যিই প্রয়োজন ছিল। যাকে নিকোলাস বলেছেন, “দ্য গ্রেট আমেরিকান রাইটার, হু হ্যাড ফট সো হার্ড ফর হোয়াট হি বিলিভড ইন”। লেখকের গুণমুগ্ধ সকলের কাছে তো বটেই, সমঝদার পাঠকের কাছেও এই বইটি চিরদিন স্মরণীয় হয়ে থাকবে।
রাইটার, সেলর, সোলজার, স্পাই: আর্নেস্ট হেমিংওয়ে’স সিক্রেট অ্যাডভেঞ্চারস, ১৯৩৫-১৯৬১
নিকোলাস রেনল্ডস
হার্পারকলিন্স পাবলিশার্স