যাঁর বইয়ের ব্লার্বে লেখা হত, ‘সতেরোয় শুরু, পচিঁশে প্রতিষ্ঠিত, তিরিশের আগেই বিখ্যাত লেখক’, তিনি রমাপদ চৌধুরী। বাংলা সাহিত্যে এক শ্রদ্ধেয় নাম। জন্মেছিলেন রেলশহর খড়্গপুরে, সেই ১৯২২ সালে। প্রথম গল্প ‘উদয়াস্ত’ প্রকাশিত হয় ‘যুগান্তর’ পত্রিকায়। তখন তাঁর বয়স ১৭-১৮। তারপর খুব বেশি লেখেননি, কিন্তু যা লিখেছেন তা এক একটি হীরক খণ্ড। ‘আমি, আমার স্বামী ও একটি নুলিয়া’, ‘ভারতবর্ষ’, ‘ফ্রীজ’, ‘একটি হাসপাতালের জন্ম ও মৃত্যু’, ‘বিনু, পালা’র মতো সব ছোটগল্প, ‘খারিজ’, ‘বাড়ি বদলে যায়’-এর মতো উপন্যাস। এতেই বাজিমাত। বুঝে গিয়েছিলেন আর দরকার নেই। তাই হয়ত খুব সচেতন হয়েই তাঁর সোনার কলমটি তুলে রেখেছিলেন।
উপন্যাসের চাইতে ছোটগল্পের ওপর তাঁর দরদ ছিল বেশি। তাই তো তিনি ‘আনন্দ’ থেকে প্রকাশিত নিজের ‘গল্প-সমগ্র’র ভূমিকায় লিখেছিলেন, “ রণক্ষেত্রের দামামা বেজে উঠলো। লক্ষ লক্ষ সিপাহী, সান্ত্রী, অশ্বারোহী সৈনিক ছুটে এলো উন্মত্ত আক্রোশে। বিপরীত দিক থেকেও ঝাঁপিয়ে পড়লো লক্ষ লক্ষ যোদ্ধা। এক দেশের সঙ্গে আরেক দেশের যুদ্ধ, এক জাতির সঙ্গে আর এক জাতির। ঔপন্যাসিক তখন কোনো মিনারের চূড়ায় উঠে নোটবুকে টুকে নেবেন সমস্ত দৃশ্যটা। রাজার অঙ্গে লাল মখমলের পরিচ্ছদ, মাথার মুকুটে মণিমুক্তাহীরের জ্যোতি, সেনাপতির দুঃসাহসিক অভিযান, সৈন্যদের চিৎকার, এসবের একটা কথাও বাদ দেবেন না ঔপন্যাসিক। লিখে নেবেন কতগুলো হাতি, কত ঘোড়া ... । খুঁটিনাটি প্রত্যেকটি কথা, প্রত্যেকটি বর্ণনা ইনিয়ে বিনিয়ে লিখে নেবেন তিনি। যুদ্ধ জয়ের পর সৈন্যদল দেশে ফিরবে যখন, তখনও পিছনে পিছনে ফিরবেন ঔপন্যাসিক। শঙ্খধ্বনি আর সমারোহের আনন্দ ছিটিয়ে আহ্বান জানাবে গ্রামীণা আর নগরকন্যার দল। তাও লিখবেন ঔপন্যাসিক, বর্ণনা দেবেন তাদের, যারা উলুধ্বনির আড়ালে কলরব করে উঠলো।
তারপর?
তারপর তিনি ছোটগল্প লেখককে দেখতে পাবেন পথের ধারে, একটি গাছের ছায়ায় বসে আছেন উদাস দৃষ্টি মেলে। এ কোন উন্নাসিক লেখক? – মনে মনে ভাববেন ঔপন্যাসিক। কোনো মিনারের চূড়ায় উঠল না, দেখল না যুদ্ধের ইতিবৃত্ত, শোভাযাত্রার সঙ্গ নিল না, এ কেমনধারা সাহিত্যিক! হয়ত এমন কথা বলবেনও তিনি ছোটগল্প-লেখককে। আর তখন, অত্যন্ত দীর্ঘ একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে চোখ চেয়ে তাকাবেন ছোটগল্পের লেখক, বলবেন হয়ত, না বন্ধু, এসব কিছুই আমি দেখিনি। কিছুই আমার দেখার নেই। শুধু একটি দৃশ্যই আমি দেখেছি। পথের ওপারের কোনো গবাক্ষের দিকে অঙ্গুলিনির্দেশ করবেন তিনি, সেখানে একটি নারীর শঙ্কাকাতর চোখ সমগ্র শোভাযাত্রা তন্নতন্ন করে খুঁজে ব্যর্থ হয়েছে, চোখের কোণে যার হতাশার অশ্রুবিন্দু ফুটে উঠছে- কে যেন ফেরেনি, কে একজন ফেরেনি। ছোটগল্পের লেখক সেই ব্যথাবিন্দুর, চোখের টলোমলো অশ্রুর ভেতর সমগ্র যুদ্ধের ছবি দেখতে পাবেন, বলবেন হয়ত, বন্ধু হে, ঐ অশ্রুবিন্দুর মধ্যেই আমার অনন্ত সিন্ধু।”
এ হেন লেখকের মৃত্যু সংবাদ পেয়ে অরুণদা (চক্রবর্তী) লিখেছেন- ‘রমাদা (রমাপদ চৌধুরী) চলে গেলেন। আনন্দবাজারে ওঁর কাঠের ঘেরা ঘরে ঢুকলেই মনে হত, সামনে এক অপূর্ব স্থাপত্য। নীরবতায় থমকে যেতাম!’ এটা পড়ে যেন মনে হচ্ছে, আমিও এখন সেই স্থাপত্যের সামনে দাঁড়িয়ে। কেননা, আমিও একদিন সেই ঘরে ঢুকেছিলাম। কোনও কথা বলতে পারিনি। মন্দিরে ঢুকে ভক্তেরা যেমন ঠাকুর প্রণাম করে বেরিয়ে আসেন, আমিও তাঁকে প্রণাম করে বেরিয়ে এসেছিলাম।
তাছাড়া আর কী-ই বা করার ছিল আমার! ততদিনে যে আমি তাঁর চোখ দিয়ে আমি আমার ‘ভারতবর্ষ’কে দেখে ফেলেছি। দেখে ফেলেছি আমাদের অন্তঃসারশূন্য মধ্যবিত্ত বাঙালির জীবন, আর ‘বিনু, পালা’ গল্পের বিনুর মতো আমিও সবসময় অনুভব করছি সেই ভয়কে- “এক্ষুণি হয়তো পিঠের ওপর একটা হাতের স্পর্শ পাবো। এক্ষুণি হয়তো কেউ পিঠে হাত দিয়ে ঝট করে বলে উঠবে, বিনু, পালা।
অমনি সঙ্গে সঙ্গে আমি হয়ত ছুটতে শুরু করবো।
তুমি যতই নিজেকে চেনো না কেন, তুমি জানো না কে কখন তোমার পিঠে হাত দিয়ে বলে উঠবে, বিনু, পালা। আর তখন তুমি আমার মতোই ছুটতে শুরু করবে। সাবধান, সাবধান।”
এভাবে সাবধান করার মানুষটি চলে গেলেন। তাঁকে আমার প্রণাম।