Advertisment

জোড়া অণুগল্প: লালন-ফকির

দিল্লিনিবাসী চিকিৎসক সরিৎ চট্টোপাধ্যায় প্রথমত নাট্যকার হলেও তাঁর আর এক মুন্সিয়ানা অণুগল্পে। এখনও পর্যন্ত প্রকাশিত বইয়ের সংখ্যা সাত, প্রকাশিত অণুগল্পের সংখ্যা দেড়শোর ওপর। আজ তাঁর দুটি অণুগল্প।

author-image
IE Bangla Web Desk
New Update
NULL

ছবি- অরিত্র দে

Advertisment

লালন

তখনও 'চাকু' জিনিসটার কদর ছিল ঝারিয়াতে। 'রাজা' সূরজভান সিং সেবার প্রথম বিধানসভার টিকিট পেয়েছেন। সত্তরের ধানবাদ শহরে তখনও আগ্নেয়াস্ত্রের রমরমা হয়নি।

কদর ছিল 'সিল্পি-লালন'-এরও। সবাই বলত বশিরচাচার হাত পেয়েছে ছোকরা। ছুরিহাতে চার-পাঁচজনের একা মহড়া নেবার ধক আছে ছেলেটার। আর একটা ব্যাপার ছিল; লড়াইয়ের সময় অদ্ভুত সুরেলা শিস দিত ও।

বশির বড়ো যত্ন নিয়ে শিখিয়েছিল। শোনা যায়, বর্ষার এক রাত্রে ওকে একা পেয়ে বারোজন আক্রমণ করেছিল। অন্ধকারে সেদিন বসির দেখেছিল সবজি দোকানীর বছর আঠেরোর ছেলেটা বাপের এঁচড়কাটার ছুরিটা হাতে নিয়ে ওর পিঠে পিঠ ঠেকিয়ে কেমন লড়ে গেছিল।

বসির বলত, শোনো লালনমিঞা, মন দিয়ে শোনো। বলেই উদার গলায় গান ধরত ... 'ভরসা আমার শ্যামাচরণ!' বলত, মনে রাখিস ছুরি খেলায় সবচেয়ে জরুরি হলো, ভরসা, বা ব্যালান্স। পাদুটো এই এতটা ... এতটা তফাতে রাখবি।

দ্বিতীয় হলো, আ-মার। প্রতিপক্ষকে আঘাত করতে দিবি। তখনই সে হলো সবচাইতে কমজোর।

শ্যামামায়ের রং দেখেছিস? মনে রাখবি, কালী কালি তিমির ক্ষপা ঘোর ... অন্ধকারই বন্ধু তোর। আর সবসময় চোখ রাখবি ওই হারামজাদার চরণযুগলের দিকে।

'শ্রীহরির চরণ বিনে, পরম তত্ত্ব আর পাবিনে!'

চোখ বন্ধ করে গাইত বশির। খাসা গানের গলাখানা ছিল ওর।

সেই গলা কেটে লাশটাকে পেট্রল ঢেলে জ্বালিয়ে দিয়েছিল সূরজভানের লোক। লালনের তখন বাইশ চলছে।

ঝারিয়া স্টেশন-ইয়ার্ডে শেষ লড়াইটা লড়েছিল লালন। ওরা পাঁচজন আর সামনে প্রায় পঞ্চাশ। চল্লিশমিনিট পর যখন পুলিস আসে তখনও রক্তাক্ত দেহে লালন দাঁড়িয়ে ছিল।

পরে অবশ্য জেলের ভেতর লালন হাসত। বলত, শালারা সেদিন আর চারমিনিট পরে আসলে হাফসেঞ্চুরিটা করেই ফেলতাম মাইরি!

বিহার পুলিস আর কোনও ঝুঁকি নেয়নি। চাবিটা ফেলেই দিয়েছিল। জেলার সাহেব যদিও হেসে বলতেন, তুই তো সত্যিই 'সিল্পি' রে!

অন্তত ধানবাদে, ওই কয়লা মাফিয়াদের অন্দরমহলে নামটা কিন্তু এখনও মনে রেখেছে লোকে, 'সিল্পি-লালন'।

আরও পড়ুন, ছোট গল্প: গণপিটুনির পরের দিন

ফকির

শবনম বিয়ের পর থেকেই খুব একটা সহ্য করতে পারে না এই ফকির লোকটাকে। কেমন যেন গার্জেন গার্জেন হাবভাব। কিন্তু পুরনো লোক, আর শাশুড়ির অবর্তমানে প্রথম প্রথম ওকে ছাড়া চলতোও না, এটাও সত্যি। শ্বশুরমশাই আর আশরাফ দু'জনেই চোখ বন্ধ করে বিশ্বাস করে ওকে। আর এখন ছোট্ট আব্দুল তো ফকিরনানু ছাড়া চোখে অন্ধকার দেখে।

শবনম প্রথম প্রথম জিজ্ঞাসা করত, ফকির, তুমি এখানে কী করে এলে?

ফকির হেসে বলত, সব কিসমত কা খেল হ্যায় বহুবেগম! কে, কেন, কোন জেলে বাঁধা পড়ে সে কি আর তা' জানতে পারে?

রিটায়ারমেন্টের একমাস বাকি থাকতে জেলারসাহেব কোয়ার্টার ছেড়ে পাঞ্চেত বাঁধের কাছে বাসা তৈরি করে সপরিবারে চলে এসেছেন। দামোদরের পাশে বেশ নির্জন জায়গাটা। আশরাফের অফিস যদিও অনেকটা দূর পড়ে তবুও ওরা এখানে এসে বেশ খুশি।

আব্দুলকে সকালে ইস্কুলে ছেড়ে আসে ফকির। ফেরার পথে বাজার নিয়ে আসে। এই ষাটপেরনো লোকটার চুল পাকলেও শরীর এখনও শক্ত। বাগানে ওর একটা এককামরার ঘর করে দিয়েছেন জেলারসাহেব। আজকাল জঙ্গল ঘেঁটে নানান গাছগাছালি নিয়ে এসে ও বাগানে করে ওর নিত্য সহচর আব্দুলকে সঙ্গে নিয়ে।

দুপুর বারোটা নাগাদ সেদিন রান্নাবান্না শেষ করে শবনম গা ধুয়ে বেরতেই কেউ ওর মুখটা চেপে ধরল। গলার মধ্যে দলাপাকানো চিৎকারটা থেমে যাওয়ার মুহূর্তে ও দেখল মুখে কাপড়বাঁধা আরও তিনজন এগিয়ে আসছে।

ছুরির ফলাটা ডানচোখের এক ইঞ্চি দূরে স্থির হয়ে ছিল। শাড়িটা খুলে ওরা ছুঁড়ে ফেলেছে। প্রথম শয়তানটা হাতদুটো চেপে ধরে আছে। দ্বিতীয়জন পাজামার দড়িটা আলগা করে এগিয়ে এল।

: অরে! ইতনা খুবসুরুৎ মাল হম সে ছুপাকর রখেঁ থে জেলারসাহব!

পরক্ষণেই দরজা থেকে একটা হিমশীতল কণ্ঠস্বর ভেসে এল।

: অম্মা বজরঙ্গি! তোহরে বাপকো ভুল গয়ে কেয়া?

চকিতে শবনমের বুক থেকে একলাফে উঠে দাঁড়ালো বজরঙ্গি। মুহূর্তে ঝলসে উঠল পাঁচইঞ্চি ফলার রামপুরিয়া! চারজনে ছুরিহাতে এগিয়ে গেল ফকিরের দিকে।

আর ঠিক তখনই ফকিরের মুখে ফুটে উঠল এক অনাবিল হাসি। শবনম হঠাৎ শুনতে পেল শিসের আওয়াজ।

শিস দিচ্ছে ফকির।

বজরঙ্গি ফকিরের রেহাইয়ের মাসচারেক আগে ওই জেলে এসেছিল। পক্ককেশ ষাটোর্ধ এই মানুষটাকে সেদিন পাত্তাই দেয়নি ও। কিন্তু 'সিল্পি লালন'-এর গল্প শুনে ও বড়ো হয়েছে কোলিয়ারির গলিগুলোতে।

চোখগুলোতে ভয়ের ছায়া! এ ছায়া চেনে লালন। নিজের মনেই সে হেসে উঠল, অনেক হলো রে লালন ফকিরগিরি। এবার জলকে চল!

দামোদরের তীরে শ্মশানঘাটটা নতুন। সূরজভান সিং-এর ছেলে উদ্বোধন করেছিল।

শবনম সেদিন সত্যিই যেতে চেয়েছিল। পারেনি। শুধু লালনের শেষ কথাগুলো কানে বেজেছিল ..

" ... বেলা যে পড়ে এল, জলকে চল।

কবে পড়িবে বেলা, ফুরাবে সব খেলা,

নিভাবে সব জ্বালা শীতল জল,

জানিস যদি কেহ আমায় বল।"

আরও পড়ুন, ছোট গল্প: ক্রায়োনিকস

Bengali Literature
Advertisment