জানা ছিল না, কলকাতায় ভ্যালেন্টাইন্স ডে একটি নয়, একাধিক। পুজোর দিন কয়েক তো আছেই ঠাকুর দেখার নামে। বুড়োবুড়ি আর কতজন যান ভিড়ভাট্টায়! পুজো যেন তরুণ-তরুণীর। হাতে হাত। কোমর জড়িয়ে আগলে রাখা। এটা এখন জায়েজ, সহনীয়। কারোর কিছু বলার নেই। সবই পুণ্য, পবিত্র। পঁচিশে বৈশাখ (নন্দন চত্বরে), বইমেলা পীঠস্থান, আরও বেশি ঘনিষ্ঠতা। বাবামায়ের ধারণা, ছেলে বা মেয়ে 'কালচার' করতে গেছে, কালচারে মত্ত। অতএব সাতখুন মাফ। ইদানীং সরস্বতী পুজোও ভ্যালেন্টাইন্স ডে। দেখলুম পাড়ায় পাড়ায়। দেখে আনন্দিত। খুশিতে ঝলমলে, মনে মনে রবীন্দ্রসঙ্গীতের কলি আওড়ালুম, "বাঁধ ভেঙে দাও..."
আমাদের যৌবনে এরকম ছিল না। বুড়ো হয়েছি, সত্তর ছুঁইছুঁই। এখন দেখার চোখ, দেখে হিংসে হয়, আফসোস। হলেও তরুণ-তরুণীর দিকে চোখ মেলে উজ্জীবিত, ফিরে পাই তারুণ্য। অন্নদাশঙ্কর রায় বলতেন, "তারুণ্যই জীবন। তারুণ্যই জীবনচালক। তারুণ্য বরবাদ হলে বাঁচা অর্থহীন।" নব্বুই বছর বয়সেও একই কথা অন্নদাশঙ্কর রায়ের মুখে। আরও বলতেন, "বাঙালি তথা উপমহাদেশের মানুষ পঞ্চাশেই বুড়ো, তারুণ্য মৃত।"
ইউরোপে বলা হয়, "পঁয়তাল্লিশ বছরের পর থেকেই জীবনযৌবন।" একথা অবশ্য পুরুষদের প্রচার, নারীকুল চুপ। প্রত্যেকে নয়। ইদানীং নানা ওষুধ-টষুধ বাজারে সুলভ, খেয়েটেয়ে পঁয়তাল্লিশের সুন্দরী বলছেন, "হাম কিসিসে কম নহি।" সত্তরের বুড়োরা কুর্নিশ করে বলছেন, "ইশ বিন য়্যুং (জার্মান ভাষায়, 'আমিও তরুণ')।"
তারুণ্যের নানা রূপ বইমেলাতেও। পৃথিবীর নানা দেশের বইমেলা দেখার অভিজ্ঞতা, এই নিয়ে বিশদ বলা মানে উলুবনে মুক্তো ছড়ানো। ঢাকার বইমেলা কখনও দেখি নি, শুনেছি একমাসব্যাপী। একমাসে হরেক কাণ্ড হয় তো। এও শুনেছি, বইমেলায় হাজারাধিক বই প্রকাশিত। কবিতার বই বেশি। কারা কবিতা পড়ে? পাঠকের সংখ্যা কত? পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে বিচরণ, সাহিত্য উৎসবে (লিটারেরি ফেস্টিভ্যালে) যোগদান, দেখি কবিতাপাঠের আসরে শ্রোতার সংখ্যা সামান্য, হোক তা বহুমান্য কবির কবিতাপাঠের অনুষ্ঠান।
জার্মানির পয়লা নম্বর কবি (হালের) হান্স মাগনুস এন্সেনসবার্গার, বার্লিন আন্তর্জাতিক সাহিত্য উৎসবে, ওঁর কবিতাপাঠের অনুষ্ঠানে মেরেকেটে পঞ্চাশজন শ্রোতাও নয়। মাগনুসকে বললুম, "কলকাতা/বাংলাদেশে গেলে শ্রোতার সংখ্যা শতাধিক, তোমার পদ্যপাঠের অনুষ্ঠানে।" শুনে বিস্মিত। বললুম, "তোমার কবিতার বই অনূদিত, কলকাতার যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের তুলনামূলক বিভাগের অধ্যাপক মানবেন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায় অনুবাদ করেছেন।" শুনে চিৎকার করে বললেন (যদিও ওঁর কণ্ঠস্বর মৃদু, অনেকটাই মেয়েলি স্বর), "ট্যাগোরের (রবীন্দ্রনাথ) দেশে আমার কবিতা অনূদিত!"
ঢাকার বইমেলা দেখি নি, কী হয়, জানি নে। কলকাতার বইমেলা ১৯৭৬ সালে শুরু, ভিক্টোরিয়া-সংলগ্ন মাঠে। শুরু থেকেই তার সঙ্গে যুক্ত। এম সি সরকার প্রকাশনার কর্তা সুপ্রিয় সরকার বললেন, "ঘণ্টায় পাঁচ টাকা পাবে, কাউন্টারে গিয়ে বিক্রি করলে।" চার ঘণ্টায় কুড়ি টাকা পেলুম। মিনার্ভা প্রকাশনীর সুশীল মুখার্জি ছাব্বিশ টাকা দিয়ে বললেন, "তুমি ভালো সেলসম্যান।" টাকা দিচ্ছেন, গুনে গুনে, তখনই ঘোষণা, "মেলায় বক্তৃতারত আনন্দবাজার পত্রিকার সম্পাদক অশোককুমার সরকার হার্ট অ্যাটাকে মৃত।" অশোকবাবুকে চিনতুম, গৌরকিশোর ঘোষ পরিচয় করিয়ে দিয়েছিলেন।
পৃথিবীর নানাদেশে ইদানীং বইমেলার হিড়িক। কোনও দেশে পাঁচদিন, কোনও দেশে সাত বা দশদিন। সবচেয়ে পুরোনো জার্মানির লাইপজিগ, ৩০০ বছরের বেশি। আন্দাজ ৮০০ বছর আগে লাইপজিগ ছিল ইউরোপের বাণিজ্য কেন্দ্র। লাইপজিগে রাজায়-রাজায় যুদ্ধ বহুবার। বছরের পর বছর।
লাইপজিগ বইমেলার চরিত্র একেবারেই ভিন্ন। বিশাল বিশাল হলঘরেই শুধু বইয়ের প্রদর্শনী নয়, শহরের নানা জায়গায়, পাঠাগারে, ছোটবড় ক্লাবে। লেখক বই থেকে পাঠ করেন। শ্রোতার প্রশ্ন, লেখকের উত্তর। লেখা নিয়ে আলোচনা, তর্ক। লাইপজিগের বইমেলায় ছোটদের জন্য বিশেষ আয়োজন। শিশু-কিশোর সাহিত্য থেকে পাঠ। লেখক স্বয়ং উপস্থিত। যদি না থাকেন, স্কুলের শিক্ষক- শিক্ষিকা পাঠ করেন। স্কুলের ছাত্রছাত্রীদের জন্য বিনামূল্যে প্রবেশ। জার্মানির বিভিন্ন স্কুল থেকে হাজির। কিশোরকিশোরী 'মাঙ্গা' (জাপানি) সাজে সজ্জিত। আনন্দে মত্ত।
ফ্রাঙ্কফুর্ট বইমেলাকে 'বইয়ের মক্কা' বলা হয়। বিশ্বের সবচেয়ে বড় বইমেলা। দুনিয়ার প্রায় প্রত্যেক দেশই অংশ নেয়। কোনও বিক্রিবাটা নেই, কেবল প্রদর্শনী। শুধুমাত্র কপিরাইট বিক্রি, কপিরাইটের চুক্তি, অনুবাদের চুক্তি। হাজারাধিক সেমিনার, ছোটদের জন্য নানা অনুষ্ঠান, পুরোনো (অ্যান্টিক) বইয়ের প্রদর্শনী।
ঢাকা বা কলকাতার বইমেলায় এত কিছু নেই, বই বিক্রিই মুখ্য। বইমেলার নামে বাণিজ্য। ঢাকা-কলকাতার প্রকাশক, প্রকাশক সংস্থার নেতারা (পাবলিশার্স গিল্ডের) ফ্রাঙ্কফুর্ট বইমেলায় আসেন, দেখেন বইমেলায় কী হয়, কতরকম আয়োজন, দেখেও শেখেন না, বইমেলা শুধু বইমেলা নয়, পাঠকের মনোরঞ্জনে কী কী করণীয়। বইমেলার কালচারও যেন ভ্যালেন্টাইন্স ডে। কালচারে তরুণ-তরুণীর প্রেম কালচারাল। বই কিনবে, না কিনলেও স্টলে স্টলে ঘুরে বই দেখবে। কোয়েলি সেন (বিয়ের পর ঘোষ) বললেন, "বই প্রেমে, বই দেখে আত্মহারা। বইমেলার এটাই আশ্চর্য।"