Advertisment

যুদ্ধের দর্শন, যুদ্ধের রাজনীতি

আলোচনা করতে গিয়ে বামপন্থী ভাবনার বেশ কিছু জনপ্রিয় সন্দর্ভকে তুলে এনেছেন গৌতম নওলাখা। এবং এ প্রসঙ্গে দার্শনিক বিন্যাসের স্বভাবজ পূর্বপক্ষ খণ্ডনের কাজটিও সেরেছেন।

author-image
IE Bangla Web Desk
New Update
Gautam Navlakha War and Politics Book Review

অলংকরণ- অরিত্র দে

কাশ্মীরে সৈন্যরা সেখানকার সাধারণ মানুষের উপর অত্যাচার চালাচ্ছে, যা অত্যন্ত নিন্দনীয়- এরকম একটা বিবৃতি বহু মানুষের মনের কথা হিসেবে পরিচিত। কাশ্মীরে যে সেনা ও আধাসেনারা কর্মরত, তাঁরা ঠিক কী ভাবে নিজেদের ভূমিকাকে দেখেন, সে কথা সাধারণভাবে এই মতাবলম্বী মানুষজনকে চর্চা করতে দেখা যায় না। বেশি নয়, সামান্য একটু তলিয়ে ভাবলেই দেখা যাবে- তাঁরা মনে করেন, কাশ্মীরে যা চলছে, তা ভারতের পক্ষে উপদ্রবের শামিল- এবং এতে পাকিস্তানের হাত রয়েছে। পাকিস্তান যে ভারতের পয়লা নম্বর শত্রু - এ কথা তাঁরা বিশ্বাস করেন, সৌজন্য ভারতের সংবাদমাধ্যমের বড় অংশ, জনপ্রিয় মাধ্যম (পপুলার মিডিয়া) এবং তার ফলে জনপ্রিয়তম ভারতীয় সংস্কৃতিও বটে। ঘৃণার এই সংস্কৃতি শুধু সেনা-আধা সেনা সহ নিরাপত্তাকর্মীদের মধ্যেই আছে তেমন নয়, কিন্তু তাঁরাই সরাসরি উপত্যকারা চলমান ঘটনাবলীর সঙ্গে যুক্ত। উল্টোদিকে কাশ্মীরের বহু মানুষের কাছে, তাঁদের যুদ্ধ আত্মনিয়ন্ত্রণের, স্বাধীনতার। তাঁরা ভারত সরকার এবং তার বাহিনীকে স্বাধীনতার শত্রু হিসেবে ভাবতে অভ্যস্ত। এভাবেই গোটা এলাকা চলমান এক যুদ্ধ পরিস্থিতির মধ্যে থাকে। যেখানে রাষ্ট্র তার নিজের দেশের নাগরিকদের, এবং দেশের নাগরিকরা তাদের নিজেদের সরকারের সঙ্গে চলমানে সংঘাতে লিপ্ত থাকে- এই এলাকা আবিশ্ব পরিচিত হয়ে ওঠে সংঘাতপূর্ণ, সংঘাতপ্রবণ বলে।

Advertisment

পড়া বই বিভাগে আরও পড়ুন,  অন্য দেশ: মধ্যমেধায় সুখী মধ্যবিত্ত এবং আরও

যুদ্ধকে এরকম ভাবেই দেখাতে চাইছেন গৌতম নওলাখা। গৌতম নওলাখার নাম সম্প্রতি সংবাদমাধ্যমে বারবার উঠে এসেছে, তাঁর গ্রেফতারি, জামিন, মাওবাদীদের সঙ্গে তাঁর যোগাযোগের বিষয়গুলিকে কেন্দ্র করে। এবং গৌতম নওলাখার পক্ষে ও বিপক্ষে মতামত তৈরি হয়েছে, খুব স্বাভাবিক ভাবেই। গৌতম নওলাখা এবং তাঁর সঙ্গীরা নগর নকশাল (আর্বান নকশাল) নামে পরিচিত হয়ে উঠেছেন সরকারের দায়িত্ববানদের সৌজন্যে। কিন্তু অভিজ্ঞতাসঞ্জাতভাবে প্রায় নিশ্চিত করেই বলে ফেলা যায় যে গৌতম নওলাখার ভাবনাচিন্তা, যা লিখিত আকারে বিধৃত রয়েছে, বই হিসেবেই, তা তাঁর সমর্থক বা বিরোধী কোনওপক্ষই তেমন করে দেখে ওঠার সুযোগ পাননি।

গৌতম নওলাখা সম্পর্কে যে কথাটা না বললেই নয়, যে তিনি, ইংরেজিতে যাকে বলে ওপিনিয়নেটেড, তাই। আমাদের চালু ভাবনায় সাংবাদিকতার যে অবজেক্টিভ নিরপেক্ষতার ধারণা রয়েছে, গৌতম নওলাখা সে অর্থে নিরপেক্ষ নন, এমনটা প্রাথমিক ভাবে মনে হতে পারে বটে। আলোচ্য বইটিতে তিনি লিখছেন যুদ্ধ নিয়ে। কাটা ছেঁড়া করতে চাইছেন যুদ্ধের ধারণাকে।

কেন হঠাৎ যুদ্ধই তাঁর আগ্রহের বিষয়- এরকম একটা প্রশ্ন ওঠা স্বাভাবিক। গৌতম, যিনি ওপিনিয়নেটেড- তিনি গেরিলা যুদ্ধকে বুঝতে চেয়েছেন এই বইটিতে। যার নাম ওয়ার অ্যান্ড পলিটিক্স- আন্ডারস্ট্যান্ডিং রেভলিউশনারি ওয়ারফেয়ার।

উত্তর ঔপনিবেশিক ভারতে, ভারতে অসংখ্য অতীত এবং চলমান যুদ্ধের কথা বলছেন লেখক, যে যুদ্ধের এক পক্ষে রয়েছে রাষ্ট্র, অন্য পক্ষে ভারতের নাগরিকরা। গৌতম মনে করছেন, এ যুদ্ধ রাষ্ট্র চাপিয়ে দিয়েছে তার নাগরিকদের উপরে। তিনি বলছেন, সেনা বাহিনী, ভারতীয় সেনাবাহিনী- আগে বিদেশি রাষ্ট্রের হয়ে এ কাজ করত, এখন করে ভারতীয় রাষ্ট্রের হয়ে। আজাদ হিন্দ ফৌজের উদাহরণ তুলে তিনি বলছেন, আইএনএ- যারা ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রামে লিপ্ত ছিল, তাদেরই সঙ্গে লড়েছে ব্রিটিশ রাজের ভারতীয় সেনা।

পড়া বই বিভাগে আরও পড়ুন, গরু-ঘোড়া-ঘোড়ার ডিম এবং বাঘ: জঙ্গল নয়, রাজনীতির গল্প

গৌতম নওলাখা এ বইয়ের পয়েন্ট অফ ডিপার্চার গেরিলা যুদ্ধ। ভারতের গেরিলা যুদ্ধ। উত্তর ঔপনিবেশিক ভারতে যে যুদ্ধ মূলত সংঘটিত হচ্ছে রাষ্ট্র ও মাওবাদীদের মধ্যে। এ প্রসঙ্গে আলোচনা করতে গিয়ে বামপন্থী ভাবনার বেশ কিছু জনপ্রিয় সন্দর্ভকে তুলে এনেছেন তিনি। এবং দার্শনিক বিন্যাসের স্বভাবজ পূর্বপক্ষ খণ্ডনের কাজটিও সেরেছেন।

বইয়ের শুরুতেই আলোচনায় নিয়ে আসা হয়েছে প্রথম যুদ্ধ তাত্ত্বিক বলে পরিচিত ক্লসউইৎজ-এর ধারণাকে। গোটা বই জুড়েই বিভিন্ন সময়ে তাকে কাজে লাগাবেন গৌতম। তৃতীয় পরিচ্ছেদের শুরুতেই আভাস দেওয়া হয়েছে যে,  ভারতীয় গণতান্ত্রিক আন্দোলন যুদ্ধ বিষয়টিকে বুঝতে অসমর্থ হচ্ছে। মার্ক্সীয় তত্ত্বে কি যুদ্ধের কথা রয়েছে, এমন একটা সম্ভাব্য প্রশ্নের উত্তর দিতে গিয়ে লেখক বলছেন, না- যুদ্ধ নিয়ে কোনও মার্ক্সীয় তত্ত্ব নেই। একই সঙ্গে, প্রায় একই নিঃশ্বাসে তিনি বলছেন, মার্ক্স নিজে তো যুদ্ধ নিয়ে প্রচুর লেখালিখি করেইছেন, একই সঙ্গে এঙ্গেলসের প্রকাশিত লেখার মধ্যে সামরিক বিষয়ক লেখালিখির সংখ্যাই বেশি।

এ প্রসঙ্গে আলোচনার বিস্তারে যেতে গিয়ে লেনিন ও মাও সে তুং-এর বিপ্লবী ও গেরিলা যুদ্ধে নিয়ে ধারণার কথা স্বভাবতই উল্লিখিত যেমন হয়েছে, তেমনই প্রায় অচর্চিত এবং অস্বস্তিকর প্রশ্ন তুলেছেন গৌতম। তিনি জিজ্ঞাসা করেছেন, সরকারের সৈনিক ও বিদ্রোহী সৈনিকদের মধ্যে তফাৎ কোথায়! উত্তর খোঁজার চেষ্টাও করেছেন তিনি। শহর ও গ্রামাঞ্চলে চাকরিহীনতা একদিকে যেমন বেড়েছে, তেমনই বাজেট বরাদ্দ বাড়তেই থেকেছে প্রতিরক্ষা খাতে। একটা সংখ্যাতাত্ত্বিক উদাহরণও দেওয়া হয়েছে ২০১৪ সালে প্রকাশিত এই বইটিতে। দেখানো হয়েছে, ২০১০ সালে দেশে সিআরপিএফ জওয়ানের সংখ্যা ছিল, ৮,৬৬,৩৬৯। ২০১২ সালে সংখ্যাটা বেড়ে দাঁড়ায় ৯,১৩,৮০১-এ। ২০১৩ সালে সে সংখ্যা হয় ১০,০৭,৯৬৬-তে। গৌতমের বক্তব্য, ক্রমবর্ধমান জওয়ানদের জন্য খরচ যেমন বেড়েছে, তেমনই তাদের সুরক্ষা এবং অস্ত্রশস্ত্রের জন্য খরচও তো বেড়েছে।

পড়া বই বিভাগে আরও পড়ুন, পাড়া-ক্রিকেট ও স্মৃতির যৌথভাণ্ডার

গৌতম বলছেন, মাইনে এবং অন্যান্য সুযোগ সুবিধে বাড়ানোর জন্য সশস্ত্র বাহিনীর মধ্যে থেকে যে নিয়মিত দাবি ওঠে তা সংগত। একই সঙ্গে তিনি আলোচনা করেছেন শহিদ বিষয়টি নিয়েও। সেনাবাহিনীর তরফ থেকে যে কোনও সংঘর্ষে মারা গেলে তাঁদের শহিদ পরচিতির যে দাবি ওঠে, তার পাল্টা প্রশ্ন তুলে তিনি জিজ্ঞাসা করতে চেয়েছেন, নিজের স্বাধীনতার দাবিতে বা জল জঙ্গল জমির অধিকার চেয়ে যুদ্ধরত যাঁরা রাষ্ট্রের বাহিনীর হাতে নিহত হন, তাঁরা কী পরিচিতি পাবেন রাষ্ট্রের কাছে!

রাষ্ট্রীয় সেনার বিরুদ্ধে যাঁরা লড়াই চালাচ্ছেন, তাঁদের একটি প্রচারপত্র উদ্ধৃত করেছেন গৌতম নওলাখা, যেখানে মাওবাদীরা বস্তার এলাকার যুবকযুবতীদের সেনাবাহিনীতে যোগ না দিয়ে তাদের গেরিলা সেনাবাহিনীতে যোগ দেওয়ার আহ্বান জানিয়েছে। যে প্রচারপত্রে বলা হয়েছে, রাষ্ট্র তাদের সেনাকে মানুষের মর্যাদা দেয় না। তাদের পশু বলে মনে করে। কখনও তারা কুকুর বলে অভিহিত হয় (গ্রেহাউন্ড), কখনও সাপ (কোবরা), কখনও বা বিড়াল (ব্ল্যাক ক্যাট)।

সমান্তরাল এক সন্দর্ভ আলোচনায় নিয়ে এসেছেন গৌতম নওলাখা, যিনি নগর নকশাল বলে অভিহিত, মাওবাদীদের সঙ্গে যোগসাজশে অভিযুক্ত। এ বইয়ের শুরুতেই তিনি বলে দিয়েছেন, শান্তি আসলে আমরা যেভাবে দেখতে ও ভাবতে অভ্যস্ত, তেমন কোনও পরিস্থিতি নয়। শান্তি আসলে যুদ্ধের অনুপস্থিতি।

সহজেই অনুমেয়, এ বই নিতান্ত পরিণতমনস্কদের জন্য। কঠোরভাবে পক্ষাবলম্বীরা এ বইয়ের যথাবিচার করতে অসমর্থ হবেন।

ওয়ার অ্যান্ড পলিটিক্স: আন্ডারস্ট্যান্ডিং রেভলিউশনারি ওয়ারফেয়ার

গৌতম নওলাখা

সেতু প্রকাশন

Book Review
Advertisment