একবার কলকাতায় সিনেমার উৎসবে দেখা হয়েছিল খ্যাতিময়ী হাঙ্গারিয় পরিচালিকা মার্তা মেসজারোসের সঙ্গে। কথায় কথায় আমি এই বর্ষীয়সী শিল্পীর কাছ থেকে চাই তিনি যে একদা জগদ্বিখ্যাত মিকলস ইয়াঞ্চোর সঙ্গে ঘর বেঁধেছিলেন তাতে চিত্রনির্মাণে কোনও সংকট তৈরি হয়নি! আমার প্রশ্নের অন্তরালের সত্যটুকু চট করে ধরে ফেলেছিলেন শ্রীমতী মেসজারোস। তাঁর উত্তর ছিল একটি নিমন্ত্রণ অনুষ্ঠান থেকে ফিরে এলেই বোঝা যায় নারী ও পুরুষের জগৎ কত পৃথক- আমি ভেবেছি অন্দরমহল আর ইয়াঞ্চো ভেবেছে সময়ের গতিছন্দ।
সদর ও অন্দরের এই ইতিবৃত্ত, ইতিহাসে আলাদা আলাদা দিক থেকে আলো ফেলে। নষ্টনীড়ের কথাই বলি। ভূপতি ইংরেজিতে কাগজ সম্পাদনা করে ভাবত লবণ কর কমবে, আর চারুলতা স্বর্ণলতা পড়ত। ভূপতির সদরে রাজনীতি আর চারুলতার অন্দরে সাহিত্য। প্রথমজনের আলঙ্কারিক ইংরেজি তো দ্বিতীয়জনের আটপৌরে বাংলা। অথচ দুজনেই ইতিহাসের অংশ, দুজনের সঙ্গেই ইতিহাস সংলাপ বিনিময় করেছে। আমাদের যা বিবেচ্য তা দেখার রকমফের। ফরাসি দেশে আটষট্টি সালের বিখ্যাত যুববিদ্রোহের অভিঘাতে আমাদের মনোজগতে যেসব বদল ঘটে তার অন্যতম হল ইতিহাসের বড় সড়কের বাইরে যে সব গলি-উপগলি তার হদিশ করা।
মনোরঞ্জন ব্যাপারী ও অরুন্ধতী রায়, শেষ পর্যন্ত দুজনেই…
আর যা আপাতভাবে পাঁচালীর কানাগলি ছিল কিংবা ছিল অসম দ্বিপ্রাহরিক স্মৃতিমন্থন বা কথোপকথন তাও ক্রমেই হয়ে উঠতে থাকে আদ্ধেক আকাশের ছবি ও আবহাওয়া বার্তা।
সিজনস অফ বিট্রেয়াল বইটি লিখিত ইতিহাসের বদলে জনস্মৃতিকে আশ্রয় করেছে। মৌখিক, পথচলতি আখ্যান লা অভিজ্ঞতার এক ধরনের স্মৃতিপুঞ্জ সংরক্ষণ করতে চেয়েছেন দময়ন্তী। কিন্তু এই বইটির নাম ইংরেজিতে হল কেন তা বোঝা দায়। আমার তো মনে হয় না আমাদের মাতৃভাষা এতদূর অনভিজাত যে বইয়ের নাম তাতে দেওয়া যায় না। লেখক ভূমিকাতেও যে সব বইয়ের উল্লেখ করেছেন, তার সব কটির ভাষাই ইংরেজি। বাংলা ভাষাতেও এমন স্মৃতিকথা বা রচনা পাওয়া যায় - লেখক তার উল্লেখ করেননি বোধহয় ঔপনিবেশিক কৌলীন্যচ্যুতির আশঙ্কায়। তবু স্বীকার করা ভাল যে তাঁর উদ্দেশ্য ছিল শুধু বর্ণহিন্দুর উদ্বাস্তু হওয়া নয়, বরং প্রায় চল্লিশ লক্ষ হিন্দু-মুসলমান-শিখ-হরিজনের রক্তসিক্ত, দগ্ধ কাহিনি। আর এই বিবরণ দিতে গিয়ে তিনি যে শুধু বাঙালির দুর্ভাগ্যের কথা মাথায় রেখেছেন তাও নয়, রাওয়ালপিন্ডির উপান্তে কীভাবে পারিবারিক সম্মানরক্ষার তাগিদে শিখ পরিবারের নারীদের মুণ্ডচ্ছেদ হয় সে কাহিনিও শুনিয়েছেন। এইরকম নানা ছোট ছোট নুড়িপাথর জোড়া দিয়েই গড়ে ওঠে বিভাজনের অট্টালিকা। বাংলা সাহিত্যের বাস্তুহারাদের নিয়ে যত আবেগবিধুরতা চোখে পড়ে, যত নস্টালজিয়া ইন্ডাস্ট্রির পত্তন হয়, তত আন্তরিক পর্যবেক্ষণ পদ্ধতি চোখে পড়ে না। দময়ন্তী অন্তত নিচের তলার উপকথা খুঁজেছেন মুখের কথায়, গল্পে আর স্মৃতিতে। তাঁকে ধন্যবাদ। ইতিহাস আর উপন্যাসের মধ্যে সীমারেখা যে কত পলকা দময়ন্তীর কলমের স্বচ্ছন্দ চলাচল তা আমাদের জানায়।
অবোধমাঝি: ধুলামাটির বাউল
অন্য পুস্তিকাটি জনপ্রিয় লক্ষ্মীর পাঁচালিকে নবীন নারীচেতনার বাতায়ন দিয়ে সম্পাদিত করতে চায়। যে পাঁচালি কোনও বীরাঙ্গনা কাব্য নয়, যার নায়িকা বিষয়ে কিছুতেই বলতে পারা যাবে না -দুলিয়ে বেণী চলেন যিনি এই আধুনিক বিনোদিনী, মহাকবির কল্পনা ও ভাষাপ্রকরণে যার কোনও প্রতিকৃতিই ফুটে ওঠে না, পিতৃতন্ত্রের নৈতিক নির্দেশনামা সেই প্রতিমার নির্মাণে কতটা কূট কৌশলের আশ্রয় নিয়েছে তা নিয়ে এখানে অল্পবিস্তর প্রতিপ্রস্তাব নিয়েছেন কয়েকজন লেখক যাঁরা, সুখের কথা, পুরুষ নন।
ছোট ভূমিকা থেকে জানা যাচ্ছে যে লক্ষ্মীপুজোই সেই পুজো যেখানে মহিলারা পুজোর অধিকার পেয়ে ও নিজেদের মধ্যে গল্পগাছা করে ভাববিনিময়ের সুযোগে এক ধরনের অনুমিত স্বাধীনতার পরিসর পান। সামন্ততন্ত্র এই প্রথার পৃষ্ঠপোষকতা করে, অন্যথা নারী স্বাধীন চলাচলের অধিকারিণী হয়ে পতিনিন্দা ও পরচর্চাকে পারিবারিক সীমারেখার বাইরে নিয়ে যেতে পারেন। তাঁদের বিচরণভূমি স্নানের ঘাট বা রান্নাঘর যেহেতু পুরুষের নজরদারি সুতরাং সুশীল নারী গঠনের লক্ষ্যে প্রস্তুত করা হল লক্ষ্মীর ব্রতকথা। লক্ষ্মীর পাঁচালি যে পরিবারের স্থিতাবস্থা বজায় রাখার জন্য পুরুষের সামাজজিক হাতিয়ার একথা প্রমাণ করার সূচনায় মিশেল ফুকোর সাহায্যও নেওয়া হয়েছে। আমাদের অবচেতনায় আমরা যে ধনদাত্রীকে অন্নদাত্রী বলে ভাবতে শিখেছি ও আজকের লক্ষ্মীব্রত যে ততটা ধর্মীয় প্ররোচনাজাত নয় যতটা সাংস্কৃতি চিহ্নায়ন - তা মনে করিয়ে দেবার জন্য আমরা কৃতজ্ঞতা বোধ করি। যারা পাঁচালীর পুনর্বিন্যাস করেছেন, তাঁরা স্ব-স্ব ভূমিতে দৃঢ়প্রোথিত কাজেই নতুন বয়ানটি যে সুলিখিত তা বলাই বাহুল্য।
ছোট এই পুস্তিকাটি কিন্তু প্রত্যাশা জাগায় সম্প্রসারণশীল এক সন্দর্ভের। রচয়িতারা যদি সেদিকে মনোযোগী হতে শুরু করেন তবে আমাদের অনেক অচলায়তনই ঝুরঝুর করে খসে পড়বে।
সিজনস অব বিট্রেয়ালস- দময়ন্তী- গুরুচণ্ডালি, ১১০ টাকা
লক্ষ্মীর পাঁচা৯- সংকলন- গুরুচণ্ডালি, ৬০ টাকা