Advertisment

নবনীতা দেবসেন, খারাপ ছাত্রের কথন

একদিন বললেন, "হোস্টেলে (বিশ্ববিদ্যালয়ের হোস্টেলে) থাকিস, ভালো কিছু খাস না, আজ সন্ধ্যায় আমার বাড়িতে আসবি।" গেলুম। নানা পদের খাবার, নিজেরই রান্না।

author-image
IE Bangla Web Desk
New Update
nabaneeta dev sen, নবনীতা দেবসেন

ধর্মীয় নয়, বাঙালি হিন্দুর লৌকিক কালচারে 'ভাইফোঁটা' নিতান্তই ঘরোয়া, পারিবারিক। ভাইয়ের কপালে ফোঁটা দেন ছোট বা বড় বোন, বিশ্বাস এই, যম ছুঁতে পারবে না, মারবে না। বাংলায় ছড়া আছে, 'ভাইয়ের কপালে দিলাম ফোঁটা/ যমের দুয়ারে পড়ল কাঁটা'। এই ছড়া নিয়েও নানা রসিকতা। প্যারোডিও আছে। সম্প্রতি একটি প্যারোডি বহুল প্রচারিত। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের তৃণমূল ছেড়ে অনেকেই বিজেপিতে যোগ দিয়েছেন, মমতা যাঁদের 'আপন ভাই' বলতেন। মমতাকে নিয়েই ছড়া-কার্টুন। সোশ্যাল মিডিয়ায় ব্যাপক ভাইরাল। মমতা দলের 'ভাইদের' ফোঁটা দিচ্ছেন, বলছেন, "ভাইয়ের কপালে দিলাম ফোঁটা/ দল ছাড়লে মারব ঝ্যাঁটা!"

Advertisment

আমাদের পাবনার গ্রামে কয়েকঘর হিন্দু প্রতিবেশী ছিলেন (এখন নেই, দেশভাগের পর ভারতে চলে গেছেন। বাকি যাঁরা ছিলেন, ১৯৬৪ সালের দাঙ্গায় এবং ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধের সময়)। চমৎকার সদ্ভাব ছিল। আত্মীয়তুল্য। সুখদুঃখে যাতায়াত ছিল এবাড়ি-ওবাড়ির। হিন্দু-মুসলিম বোধ ছিল না। আমরা পুজোয় সামিল, ঈদে ওরা ঘরে। কিন্তু হিন্দু মেয়েরা কখনোই আমাদের ভাইফোঁটা দেন নি। অথচ বোন/দিদি, ভাই/দাদা সম্বোধন সর্বত্রই। তাহলে কি সম্পর্ক ছিল মুখে-মুখে, অন্তরে নয়? তাই বা কী করে? ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধের সময় পশ্চিমবঙ্গ, ত্রিপুরা, আসামে বাংলাদেশের (তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তান) মুসলিম উদ্বাস্তু ঠাঁই দিয়েছে বাড়িতে। প্রশ্ন করেনি, কে মুসলিম, কে নয়। মানবিকতার খাতিরে অবশ্যই, তবে এও হতে পারে, যারা দেশত্যাগী, জানে উদ্বাস্তু এবং দেশত্যাগের যন্ত্রণা কী। রবীন্দ্রনাথের ভাষায়, 'দূরকে করিলে নিকট'।

এই নৈকট্যে ধনী হই কলকাতায়। বলা ভালো 'নৈকট্য' নয়, আপন। বাংলাদেশ থেকে নির্বাসিত (১৯৭৪ সালে), আশ্রিত কলকাতায়। থাক সেসব কাহিনি। ইনিয়ে বিনিয়ে এসব লেখা সাহিত্য নয়। বিশ্বজুড়ে আজ উদ্বাস্তু, দেশে দেশে। উদ্বাস্তু মানেই দেশছাড়া, নির্বাসন।

'আপনতার' কথা বলছিলুম। ভর্তি হয়েছি যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ে, তুলনামূলক সাহিত্য বিভাগে, বিএ পর্বে। ভর্তি হয়েই শুনলুম, ভারতে প্রথম তুলনামূলক সাহিত্য বিভাগ যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ে। পরে অন্যান্য বিশ্ববিদ্যালয়ে। যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের তুলনামূলক সাহিত্যের অধ্যাপককুল বহুমান্য পণ্ডিত, দেশি ও বিদেশি সাহিত্যে। বিদেশি ভাষাও জানেন। এও শুনলুম, ছাত্রছাত্রীরা অধ্যাপকদের 'স্যার' সম্বোধন করেন, অধ্যাপিকাদের নয়। তাঁরা 'দিদি'। বিশ্বভারতীতে উল্টো। উপাচার্য থেকে শুরু করে সব অধ্যাপকই 'দা' বা 'দাদা'। অধ্যাপিকা 'দিদি'।

অতএব নবনীতা দেবসেন 'দিদি', ছাত্রীদের যত আবদার 'দিদি'র কাছে। লক্ষ্য করি, ছাত্র নয়, ছাত্রীদের প্রশ্রয় দেন। কন্যা তুল্য। হতে পারে, তাঁর পুত্রসন্তান নেই, দুই কন্যার জননী, কন্যাকুলই প্রিয়। 'কন্যাদের' সুখদুঃখ সঠিক বোঝেন নারী হয়ে, 'পুত্রদের' নয় হয়তো।

তুলনামূলক সাহিত্যে ভর্তি হওয়ার আগেই, ঢাকায় থাকাকালীন, নবনীতা দেবসেনের প্রথম কাব্যগ্রন্থ 'প্রথম প্রত্যয়' পড়েছি। গদ্যও পড়েছি। তাঁর কবিতার চেয়ে তাঁর গদ্য (বিশেষত প্রবন্ধ এবং ছোটগল্প) অনেক বেশি সুপাঠ্য, বুদ্ধিদীপ্ত।

জানা ছিল, নবনীতা দেবসেনের পিতা নরেন্দ্র দেব, মা রাধারানী দেবী কবি। কবি দম্পতি কলকাতার এলিট-ঘরানা। রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে সম্পর্কিত। রাধারাণী দেবী একদা অপরাজিতা দেবী নামে খ্যাত, ওই নামে রবীন্দ্রনাথ, শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের সঙ্গে পত্রালাপ, বাংলা সাহিত্যে বহুল আলোচিত। বাংলা সাহিত্যে গত শতকের ত্রিশের দশক আধুনিক যুগ বলে কথিত। এই যুগের নবনীতার বাবা-মা নরেন্দ্র দেব, রাধারাণী দেবী। তাঁদের কন্যা নবনীতা অধিকতর আধুনিকতায় দীপ্ত হবেন, খুব স্বাভাবিক। রক্ত পরম্পরায় উজ্জীবন।

নবনীতার ছাত্র ছিলাম পাঁচ বছর (বিএ, এমএ), যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ে, তুলনামূলক সাহিত্যে। যখন পড়াতেন, পড়ানোর মাঝখানে, "যা পড়ালাম, এতক্ষণ কথা বললাম, কী বুঝেছ?" প্রশ্নে ছাত্রছাত্রী দিশেহারা। উত্তর না পেয়ে, "তোমরা বোঝো নি, আচ্ছা," বলে আবার ব্যাখ্যা। এবং ব্যাখ্যা এতই পুঙ্খানুপুঙ্খ, নোট নেওয়ার দরকার নেই। সবটাই গল্পচ্ছলে। ভিন্নতর 'মাস্টারনির শিক্ষা'। এই শিক্ষা হয়তো পেয়ে থাকবেন তাঁর দুই শিক্ষকের কাছে। দুই শিক্ষক, বুদ্ধদেব বসু ও সুধীন্দ্রনাথ দত্তর কাছে। দুজনই ত্রিশের দশকের আধুনিক বাংলা কবিতার অন্যতম পুরোধা।

বুদ্ধদেব বসুরই প্রচেষ্টায় যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ে তুলনামূলক সাহিত্য বিভাগ প্রতিষ্ঠিত। নেপথ্যে ছিলেন তৎকালীন কেন্দ্রীয় শিক্ষামন্ত্রী হুমায়ুন কবীর। যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয় যেহেতু ভারত সরকারের আর্থিক আনুকূল্যে, কেন্দ্রীয় শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের সহায়তা আবশ্যক। হুমায়ুন কবীর নিজে বহুমান্য সাহিত্যিক (কবিতা-গল্প-উপন্যাস লিখেছেন), বাংলা-ইংরেজি ভাষায় লিখতেন। বুদ্ধদেবের বন্ধুকুলে একজন। হুমায়ুন কবীর বরিশাল জেলার (এখন বাংলাদেশে)। মওলানা আবুল কালাম আজাদের সচিব ছিলেন।

তুলনামূলক সাহিত্য বিভাগ শুরু পাঁচজন ছাত্রকে নিয়ে। একমাত্র ছাত্রী নবনীতা দেবসেন। কলকাতার প্রেসিডেন্সি কলেজে পড়াকালীনই, পড়া শেষ না করে ভর্তি হন তুলনামূলক সাহিত্যে।

যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয় যেহেতু 'ইঞ্জিনিয়ারিং ইউনিভার্সিটি', আর্টস বিভাগ পরে, আরো পরে তুলনামূলক সাহিত্য, এই বিভাগে একজনই ছাত্রী, নবনীতা দেব (অমর্ত্য সেনের সঙ্গে বিয়ের পর 'সেন' যুক্ত)। তাঁকে নিয়ে ছাত্রকুলে কৌতূহল। নবনীতা দেখতে অসাধারণ সুন্দরী, নবনীতার কথায়, "বহু ছাত্র কলা বিভাগের সামনে ঘুরঘুর করত। কাউকে পাত্তা দিই নি। কেউ কাছে ঘেঁষলে বকে দিতাম।"

বকতেন ছাত্রছাত্রীকেও। যারা লেখাপড়ায় অল্পবুদ্ধি, অমনোযোগী। বকলেও, আদর করতেন মায়ের স্নেহে। মনে আছে, এমএ প্রথম পর্বে, একবার পড়াতে পড়াতে প্রশ্ন করলেন, এবং প্রশ্ন করলেন এই খারাপ ছাত্রকেই। সঠিক উত্তর দিই নি, বকলেন, ভাষা, "তোমার দ্বারা কিছু হবে না।" সঠিক ভবিষ্যদ্বাণী।

নবনীতার মতো ভারতের অন্য কোনো লেখক-অধ্যাপক বহু ভাষায় আত্মস্থ কিনা, অজানা। অবাক হয়ে শুনতুম, ক্লাসে, উদ্ধৃতি দিচ্ছেন কোনো লেখা থেকে, মূল ভাষায়। জানতেন সংস্কৃত, ফরাসি, জার্মান, হিব্রু, হিন্দি, অসমিয়া, ওড়িয়া। বাংলা এবং 'ইংরেজি' তো মাতৃভাষা। পড়েছেন কলকাতার গোখেল মেমোরিয়াল গার্লস স্কুলে, লেডি ব্রেবোর্ন কলেজে। প্রেসিডেন্সি কলেজে। যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ে। হার্ভার্ডে। কেমব্রিজে। পিএইচডি ইন্ডিয়ানা বিশ্ববিদ্যালয়ে। পোস্ট-ডক্টরেট ক্যালিফোর্নিয়ার বার্কলি বিশ্ববিদ্যালয়ে। রিসার্চও ওখানে। ছিলেন আমেরিকার কলোরাডো কলেজের তুলনামূলক সাহিত্যের 'মেট্যাগ প্রফেসর'। নবনীতাই প্রথম ভারতীয় মহিলা, যিনি অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ে রাধাকৃষ্ণন স্মারক লেকচারার।

এত লেখাপড়া, এত পাণ্ডিত্য, কখনোই ছাত্রদের কাছে খোলসা করেন নি, যেন নিতান্তই সাধারণ মানুষ, "ভালো করে মাতৃভাষা শেখো। ভারতীয় সাহিত্য সংস্কৃতি জানো।"

তিনি জানতেন। নানা দেশে, প্রতি বছর বিভিন্ন সময়ে বক্তৃতা দিয়ে, কলকাতায় ফিরে বলতেন, "আর ভাল্লাগে না।" না লাগলেও, তাঁরই ছাত্রী নূপুর চৌধুরি (বিয়ের পরে বিশ্বাস) একবার বলেন, "দিদির ভালো না লাগার কারণ স্বদেশ-টান, মাতৃভাষা।"

নবনীতার পায়ের নীচে সর্ষে ছিল। তাঁর মতো কোনো বাঙালি লেখক (সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ও নন) এত বিদেশ ভ্রমণ করেন নি। নিজের অর্থে নয়, আমন্ত্রণে। নবনীতাই একমাত্র বাঙালি লেখক (লেখিকা বললে নারীবাদীরা ক্ষিপ্ত হবেন) যিনি ভারতীয় নানা সাহিত্য পুরস্কার কমিটির বিচারক-সদস্য ছিলেন। জ্ঞানপীঠ, সাহিত্য অ্যাকাডেমির। বিশ্ববিদ্যালয় (কেন্দ্রীয়) গ্রান্টস কমিশনের সদস্য ছিলেন।

রবীন্দ্রনাথ বাংলা সাহিত্যের সব শাখায় একক। গান বাদে নবনীতার বিচরণ কবিতা, গল্প, প্রবন্ধ, নাটক, রম্যরচনা, ভ্রমণ, আত্মকথা, শিশু সাহিত্যেও অনন্য।

খারাপ ছাত্রকে মাস্টাররা খুব বকাঝকা করেন, শাসন করেন। আদরও করেন, অনাদরও। একদিন বললেন, "হোস্টেলে (বিশ্ববিদ্যালয়ের হোস্টেলে) থাকিস, ভালো কিছু খাস না, আজ সন্ধ্যায় আমার বাড়িতে আসবি।" গেলুম। নানা পদের খাবার, নিজেরই রান্না। অতিথি এক বিদেশিনীও। পরিচয় করিয়ে দিলেন, ভাষা এই, "আমার ছাত্র, খারাপ ছাত্র, ইংরেজি জানে না।" বিদেশিনীর কী কথা, সঠিক মনে নেই, একটি বাক্য কানে বাজে, "ইউ আর আ গুড টিচার, বাট ইয়োর স্টুডেন্ট ইজ নট, সো..."।

অন্য কোনো ছাত্রকে নয়, এই খারাপ ছাত্রকেই, "কাল সন্ধ্যায় বাড়িতে আসবি।" সেদিন ছিল ভাইফোঁটা। নবনীতার দুই কন্যা পিকোলো (অন্তরা দেবসেন) এবং টুম্পা (নন্দনা সেন) ভাইফোঁটা দিলেন। হয়ে গেলুম 'দাদা'। একবার ভাইফোঁটা দিলেই দাদা। পরের বছর আবার। তার মানে, পাকাপোক্ত 'দাদা' হয়ে গেলুম। নবনীতা মাস্টারনি নন, 'দিদি' নন, হয়ে গেলেন জননী।

বিদেশবিভুঁয়ে একজন নির্বাসিতের কাছে পরম জননী, জননীর স্নেহ, কতটা পাথেয়, কতটা সুখের, খারাপ ছাত্রের হাড়মজ্জায় জাগ্রত।

Advertisment