Advertisment

সিপিএমের ১০০ বছর, সংকট যতটা মার্ক্সবাদীদের ততটা বামপন্থীদের নয়

গত একশো বছরে সিপিএম এক ধরনের বামপন্থার চর্চা করেছে। আজ সময় এসেছে, যখন তাদের আরও প্রসারিত বামপন্থা নিয়ে ভাবতে হবে। তাতে মার্ক্সকে একশো ভাগ মানা হল না সাতাশ দশমিক তিন ভাগ মানা হল, এই অবান্তর তর্ক থেকে তাদের বেরিয়ে আসতে হবে।

author-image
IE Bangla Web Desk
New Update
NULL

প্রতীকী ছবি

কংগ্রেসের ১০০ হয়ে গিয়েছে ১৯৮৫ সালে। তাতে যে কংগ্রেসের কোনও বাড়তি ডানা গজায়নি, আজ সেকথা দেশের লোকসভার ৫৪৩ আসনের মধ্যে মাত্র ৫২টি আসনের মালিক কংগ্রেসের থেকে বেশি আর কে-ই বা জানে!  আরএসএসেরও একশো বছরের বেশি দেরি নেই। স্বাধীনতা আন্দোলনে কুটোটি না নাড়ায়, প্রথম ৯০ বছর তাদের তেমন সুবিধে না হলেও এখন তো দেখা যাচ্ছে ভগবান মুখ তুলে চেয়েছেন। অনেকেই প্রশ্ন করছেন: ওদের পানে কেন চেয়ে আছো গো মা বলে! মা অবশ্য নিরুত্তর। তাছাড়া গোমাতা যদি উত্তর দেনও, তার ট্র্যানস্লেটর পাওয়া বেজায় কঠিন। সিপিএম বলছে ২০১৯-এর ১৭ অক্টোবর তাদেরও একশো হল। সিপিআই অবশ্য বলছে- না, এখনও কয়েক বছর নাকি বাকি আছে। এ হল দুলালের তাল মিছরির কেনার থেকেও কঠিন কাজ। ছবি সই মিলিয়ে কিনেও তর্ক থামবে না। সে যাই হোক, সিপিএম যখন বলছে তাদের ১০০ হল, তখন তা নিয়ে কিঞ্চিত আলোচনায় দোষ কোথায়। ১৯৬৪ সালে পার্টি ভেঙে দু’ভাগ হওয়ার পর, ১৯৭১ সালে সিপিএম সিদ্ধান্ত নেয়, ১৯২০ সালের ১৭ অক্টোবর তাসখন্দে প্রবাসী ভারতীয়রা যে কমিউনিস্ট পার্টি তৈরি করেছিল সেটাই তাদের ডেট অফ বার্থ। জন্মপত্রিকা বা কুষ্ঠি ওই তারিখ ধরেই করতে হবে। সেই কুষ্ঠি কাকে দিয়ে করানো হয়েছিল, তার নাম পাওয়া যায়নি, কিন্তু ঘটনা হলে কুষ্ঠিতে যা যা বলা হয়েছিল তার প্রায় কিছুই মেলেনি।

Advertisment

গ্যালিলিও থেকে ধার করে বলি, হতভাগ্য সেই দেশ যে দেশের নেতা ছাড়া চলে না। স্লোগান ওঠে দেশকা নেতা কৈসা হ্যায়, ... জৈসা হ্যয়। এর থেকে আমরা বেরোতে পারিনি, কবে পারব কেউ জানে না। যুক্তি, জ্ঞান, বক্তব্য, স্বপ্ন কিছুই মানুষকে আকর্ষণ করে না, করে শুধু নেতার জনমোহিনী শক্তি। ‘মেসমেরাইজ’ করার ক্ষমতা। এর ফল সব সময় ভালো না-ও হতে পারে। মহাত্মা গান্ধীর যে ক্ষমতা ছিল, তেমন নেতার দেখা পাওয়ার সৌভাগ্য বিশ্ববাসীর ক্বচিৎ হয়। তাঁকে বাদ দিলে স্বাধীনতার পর ইন্দিরার পর নরেন্দ্র মোদী, মানতেই হবে ‘হ্যামলিনের বাঁশীওয়ালার’ পিতা। অন্য ধরনের নেতৃত্ব তৈরি যে হচ্ছে না তা অবশ্য নয়। রাজ্যস্তরে জ্যোতি বসু যেমন ছিলেন, মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের নামও এই তালিকায় শুরুর দিকেই রাখতে হবে, শত সমালোচনা সত্ত্বেও। যেমন অরবিন্দ কেজরিওয়াল। তরুণ প্রজন্মের মধ্যে কানহাইয়া কুমার, শেহলা রশিদ, উমর খালিদ, জিগ্নেশদের দিকে আমাদের নজর রাখতে হবে, ভবিষ্যৎ তাদের জন্য কী ভূমিকা ভেবে রেখেছে তা দেখার জন্য।

আরও পড়ুন, দরিদ্র অর্থনীতি- নোবেল লরিয়েটদের বই ও দারিদ্র্য দূরীকরণের নয়া দিগন্ত

তিতুমীর নেতা ছিলেন। সিপাই বিদ্রোহের ভিতরের নেতৃত্ব সম্পর্কে খুব বিস্তারিত জানা যায় না। তবে নীল বিদ্রোহের নেতাদের নাম অনেকটাই পাওয়া যায়। গান্ধী প্রথম আমাদের শেখালেন আন্দোলনে গরিব মানুষকে সঙ্গে নিতে হবে। তিনি না চাইলেও, জন্ম হল গান্ধীবাদের। পৃথিবী প্রতিবাদের এক নতুন পথের সন্ধান পেল। রক্তপাতহীন সেই কঠিন পথের কথা, সংখ্যায় অল্প হলেও, পৃথিবী জুড়ে  বিস্ময়ের সঙ্গে তা নিয়ে আলোচনা আজও চলেছে।  আরও বহুকাল চলবে। রক্তপাতময় ফরাসি বিপ্লব তার অনেক আগের ব্যাপার, কিন্তু সাম্য, মানবিকতা, ভালোবাসার কথা এত বড় করে এর আগে কেউ বলেনি। জন্ম হল কমিউনিস্ট ম্যানিফেস্টোর। জন্ম নিল মার্কসবাদ। যা নিয়ে মার্কস একবার মন্তব্য করেছিলেন, ‘ঈশ্বরকে ধন্যবাদ যে আমি মার্ক্সবাদী নই’। তার পর এল মার্ক্সবাদ-লেনিনবাদ। তার পর এল মার্ক্সবাদ-লেনিনবাদ- মাও জে দংয়ের চিন্তাধারা। ধীরে ধীরে শ্রদ্ধেয় নেতা, অন্তরের নেতা এসব শব্দও শোনা গেল, শোনা গেল মার্ক্সবাদ সত্য কারণ ইহা বিজ্ঞান, এমন কথাও। কিন্তু শেষ পর্যন্ত কী হল? সিপিএমের ভোট একসময় পশ্চিমবঙ্গে যা ৫৪ শতাংশ পর্যন্ত উঠেছিল, তা এখন ১০-এর বেশ নীচে। এক টানা ৩৪ বছর তারা ক্ষমতায় ছিল। ক্ষমতায় থাকলে যেসব অসুখ বিসুখ করে তা একটা সময় সিপিএমের মধ্যে বেশ প্রবল হয়ে ওঠে। মায়ের দয়া, ওলাওঠা, সান্নিপাতিক, কালাজ্বর, রক্তাল্পতা সবই প্রকট হয়ে উঠল। বিষ তখন মাথায়, বাঁধন দেওয়ার জায়গা নেই। ৩৪ বছর রাজত্বের পর এখন তারা টিম টিম করছে। যে কোনও প্রবল প্রতাপান্বিতকে এই ভাবে ছেঁটে ফেলার অধিকার গণতন্ত্রে মানুষের আছে।

তারপর যারা এল, ১০ বছর না পেরোতেই তাদের নিজেদের বিশ্বাসেই যে চিড় ধরেছে তা স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে। এখন হিন্দুত্ববাদীদের নিঃশ্বাসের শব্দ শোনা যাচ্ছে পশ্চিমবঙ্গেও। হিন্দুত্ববাদীরা সারা দেশে আরও ক্ষমতাশালী হলে সংবিধানের মৌলিক কাঠামো বদলে দিতে পারে, এই ভয় অনেকেই মনে করেন অমূলক নয়। মমতার সরকার অনেক কাজ করেছে। কিন্তু সে সব চাপা পড়ে যায় ক্রমাগত এই সরকারের অসহিষ্ণু আচরণে। কখনও কার্টুন পোস্ট করার জন্য অধ্যাপককে গ্রেফতার, কখনও ফেসবুক পোস্টের জন্য কংগ্রেসের মুখপাত্রকে মাঝরাতে তুলে নিয়ে যাওয়া, বিরোধীশূন্য পঞ্চায়েত গড়ার পালোয়ানি আকাঙ্ক্ষা, কখনও অপছন্দের কাগজে বিজ্ঞাপন বন্ধ করে দেওয়া, কখনও অপছন্দের প্রশ্নে সাংবাদিককে ধমক, কখনও পছন্দের সাংবাদিককে সাক্ষাৎকার দেওয়া এবং বাকিদের দূর ছাই করা, ক্রমাগত এই সব করে করে, অনাবশ্যক পচা বিতর্কের জমা জলে মমতার অসংখ্য ভালো কাজ ডুবে গিয়েছে। বিরোধীশূন্য বাংলা গড়তে গিয়ে বেশ গুছিয়ে হিন্দুত্ববাদীদের জায়গা তৈরি করে দেওয়া হয়েছে। টনক যখন নড়েছে, তখন বেশ দেরিই হয়ে গিয়েছে। প্রশান্তকিশোরবটিকা মধু দিয়ে মেড়ে দু’বেলা খেলেও কতটা কাজ হয়, তা ভবিষ্যতই বলবে।

আরও পড়ুন, এক চিমটে বিরোধিতা

এই পরিপ্রেক্ষিতে সিপিএমের ১০০ বছরকে দেখতে হবে। প্রয়োজন ফুরিয়ে গেলে অনেক রাজনৈতিক দল অতীতেও উঠে গিয়েছে, ভবিষ্যতেও যাবে। অখিলেশ, মায়াবতী, চন্দ্রবাবু, লালুপ্রসাদ, এআইএডিএমকে, এনসিপি সহ পশ্চিমবঙ্গের বামফ্রন্টের বেশ কিছু শরিকদল আগামী দিনে হয় থাকবে না আর থাকলে স্থান হবে জাদুঘরে। পলিটিক্যাল টুরিজমের বিষয় হয়ে উঠবে। আগমার্কা মার্ক্সবাদী পার্টি, যা আসলে প্রকৃত বিচারে আর এক ধরনের মৌলবাদী সংগঠনই প্রায়, তারাও ইতিমধ্যেই বহু দেশে অপ্রাসঙ্গিক হয়ে গিয়েছে। কিন্তু বামপন্থা বিলীন হয়নি, বাড়ছে। সারা পৃথিবীতে তাদের উপস্থিতি যথেষ্ট সম্মানজনক ভাবেই স্বীকৃতি পেয়ে চলেছে। কোনও নির্দিষ্ট একটি বা দু’টি মার্ক্সবাদী কমিউনিস্ট পার্টি ভবিষ্যতে টিকে থাকবে কি থাকবে না সেটা বড় কথা নয়। যতদিন ফ্যাসিবাদ  থাকবে, গণতন্ত্র-বিরোধী শক্তি থাকবে, অসাম্য থাকবে ততদিন বামপন্থাই একমাত্র আশ্রয় হবে মানবাতাবাদী, গণতন্ত্রে বিশ্বাসী, সাম্যে বিশ্বাসী অগণিত মানুষের।

গত একশো বছরে সিপিএম এক ধরনের বামপন্থার চর্চা করেছে। আজ সময় এসেছে, যখন তাদের আরও প্রসারিত বামপন্থা নিয়ে ভাবতে হবে। তাতে মার্ক্সকে একশো ভাগ মানা হল না সাতাশ দশমিক তিন ভাগ মানা হল, এই অবান্তর তর্ক থেকে তাদের বেরিয়ে আসতে হবে। আর তারা যদি তাদের ভাবনা না পাল্টায়, অন্য কোনও দল, শক্তি সেই শূন্যস্থানের দখল নেবে। আমরা এখন ঠিক এই রকম একটা চৌমাথায় দাঁড়িয়ে। ফ্যাসিবাদের বিরুদ্ধে লড়াই একমাত্র বামপন্থীরাই লড়তে পারে। এমন অসংখ্য উদাহরণ ইতিহাসের পাতা ওল্টালে বার বার পাওয়া যাবে। গরিব মানুষের অধিকারে জন্য মরণপণ লড়াই করে চলেছে বামপন্থীরা যুগ যুগ ধরে। ‌কোনও একটা দল থাকল কি থাকল না সেটা ইতিহাসের বিচারে বড় কথা নয়, কিন্তু যতদিন একজনও অভুক্ত মানুষ থাকবে, বামপন্থার বিনাশ নেই। রাজনীতি আসলে এক ধরনের ক্ষমতা দখলের প্রক্রিয়া, ফলে ক্ষমতার বিপরীতে বামপন্থী শক্তির জন্মও একটি অতি স্বাভাবিক অ্যান্টি থিসিস। সিপিএমের একশো বছরে এইটুকুই বলা যায়, বামপন্থীদের হতাশ হওয়ার কোনও কারণ নেই। বামপন্থীদের প্রয়োজন ফুরিয়ে যায়নি, বেড়েছে। একটু বেশিই বেড়েছে, অন্তত এই মুহূর্তে এ কথা জোর গলায় বলাটা জরুরি।

(শুভাশিস মৈত্র বরিষ্ঠ সাংবাদিক, মতামত ব্যক্তিগত)

Left Movement Cpm
Advertisment