ভারতীয় ক্রিকেট এবং ক্রিকেটাররা ২০১৯-কে এক মিশ্র ফলাফলের বছর হিসাবেই দেখবে। ঠিক এক বছর আগে, ২০১৮-র বক্সিং ডে টেস্ট ম্য়াচে, অস্ট্রেলিয়াকে তাদের নিজেদের মাঠে হারিয়ে ইতিহাস সৃষ্টি করে বিরাট কোহলির টিম ইন্ডিয়া। সত্তর বছর পর প্রথম ভারত অধিনায়ক হিসেবে অস্ট্রেলিয়ার মাটিতে টেস্ট জয়ের নজির গড়েন কোহলি। বর্ডার-গাভাস্কর ট্রফিতে চার ম্যাচের টেস্ট সিরিজ কোহলি অ্যান্ড কোং ২-১ ছিনিয়ে নেয়। তারপর ২০১৯-এর গোড়াতে একই ব্যবধানে একদিনের সিরিজ জিতে ভারত তাদের শ্রেষ্ঠত্ব প্রমাণ করে।
এর আগে যদিও ভারত মহেন্দ্র সিং ধোনির নেতৃত্বে ত্রি-দেশীয় সিরিজ জিতেছিল। শচীন তেন্ডুলকর পরপর তিনটি শতরান করে অবিশ্বাস্য় ব্য়াটিংয়ের দৃষ্টান্ত রেখেছিলেন সেবার।
অস্ট্রেলিয়ার পর ওয়ানডে সিরিজে নিউজিল্যান্ডকে পর্যুদস্তু করে ভারত হারায় তাদের মাঠেই। এবং অস্ট্রেলিয়ার বিরুদ্ধে ফিরতি সিরিজ হারলেও ভারত বিশ্বকাপকে সামনে রেখে বেশ কিছু পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে।
ভারতের বিশ্বকাপ অভিযান
ইংল্যান্ডের মাটিতে ভারত বিশ্বকাপ অভিযান শুরু করে দুর্দান্তভাবে। অপরদিকে নিউজিল্যান্ড, ইংল্যান্ড ও অস্ট্রেলিয়া (নিজেদের মাটিতে) অসাধারণ ক্রিকেট উপহার দিচ্ছিল দর্শকদের। এই চারটি দলই সেমিফাইনালে পৌঁছয়। এর মধ্য়ে ভারত গ্রুপ/ লিগ স্টেজে অপরাজিত থেকে চলে যায় সেমিফাইনালে, নিউজিল্যান্ডের বিপক্ষে। কিন্তু ম্যাঞ্চেস্টারে নির্ধারিত দিনের শেষে বৃষ্টি পড়াতেই ঘটে বিপত্তি। সেদিন খেলা না হওয়ায় পরের দিন ভারী আবহাওয়ায় নিউজিল্যান্ডের পেস বোলারদের, মূলত ম্য়াট হেনরি এবং মিচেল স্যান্টনারের কাছে ভারত আত্মসমর্পণ করতে বাধ্য় হয়। তৃতীয়বারের মতো ভারতের বিশ্বজয়ের স্বপ্ন ভেঙে চুরমার হয়ে যায়। ধোনিকে চারে খেলানো নিয়ে ওঠে বিরাট আলোড়ন।
আইসিসি-র ইভেন্টে ভারতের ট্রফির খরা
বিশ্বকাপের পর বেশ কিছু দ্বি-পাক্ষিক সিরিজে ভারত জয়লাভ করে শীর্ষস্থানে বিরাজমান। তা সত্ত্বেও সদ্য় শেষ হওয়া ওয়েস্ট ইন্ডিজের বিরুদ্ধে সিরিজের পর কোহলি এক সাক্ষাৎকারে ফের তুলে আনেন বিশ্বকাপ সেমিফাইনালে হারের স্মৃতি। প্রায় সাত বছর কোনও আইসিসি ট্রফি জেতে নি ভারত। সেটা তাঁকে ও তাঁর দলকে যে আজও কুরে কুরে খাচ্ছে, তা কোহলির বক্তব্যেই বারবার স্পষ্ট। ভারত এখন একটি আইসিসি ট্রফির জন্য় মরিয়া। বিশ্বের এক নম্বর টিম এতগুলো বছর আইসিসি-র ট্রফি হীন। তা কোহলির কাছে কখনই গ্রহণযোগ্য় হতে পারে না।
আইপিএল নিলামে যা দেখলাম
সদ্য়ই কলকাতায় হয়ে গেল আইপিএল নিলাম। সবাই তাদের সাধ্য়মতো (পড়ুন পকেটের জোর অনুযায়ী) দল গুছিয়ে নেওয়ার চেষ্টা করেছে। কলকাতা নাইট রাইডার্স সাড়ে ১৫ কোটি টাকা দিয়ে দলে নিয়েছে বিশ্বের এক নম্বর টেস্ট বোলার প্য়াট কামিন্সকে। মিডল অর্ডার শক্তিশালী করার জন্য় বিশ্বকাপজয়ী ব্রিটিশ অধিনায়ক ইয়ন মর্গ্য়ানকে ৫.২৫ কোটি টাকায় দলে নিয়েছে কেকেআর। কিছুটা হলেও তাঁর অধিনায়কত্বের অভিজ্ঞতা দীনেশ কার্তিকের সঙ্গে ভাগ করে নেওয়ার জন্য়ও বটে। এই নিয়ে দ্বিতীয়বার দুর্দান্ত ফর্মে থাকা মর্গ্য়ান এবং কামিন্স খেলবেন কেকেআর-এর হয়ে।
চেন্নাই সুপার কিংস পীযূষ চাওলা, স্য়াম কারেনকে তুলে নিয়ে তাদের দলকে সমৃদ্ধ করেছে। সিএসকে এবং মুম্বই ইন্ডিয়ান্স সাধারণত তাদের কোর টিমকে খুব একটা ঘাঁটায় না। নেথান কুল্টার নাইল, শেরফান রাদারফোর্ডকে আগেই এক্সচেঞ্জ করে নিয়েছিল।
রয়্যাল চ্যালেঞ্জার্স ব্যাঙ্গালোর বিরাট কোহলি ও এবি ডিভিলিয়ার্সকে রেখে দলে বেশ কিছু পরিবর্তন এনেছে। হেড কোচ সাইমন ক্য়াটিচ, হেড অফ ক্রিকেট অপারেশনস মাইক হেসন দলে এনেছেন বেশ কিছু নতুন মুখ।
কিংস ইলেভেন পাঞ্জাব তাদের হেড কোচ ও ডিরেক্টর অফ ক্রিকেট হিসাবে নিয়ে এসেছে অনিল কুম্বলেকে। দলেরও খোলনলচে বদলে গিয়েছে। এবার দুরন্ত ফর্মে থাকা কেএল রাহুলের নেতৃত্বে খেলবে পাঞ্জাব। বিশ্বের অন্য়তম শ্রেষ্ঠ প্রতিভা নিকোলাস পুরান রয়ছেন। জোরে বোলিংয়ে শক্তি বাড়াতে এসেছেন ওয়েস্ট ইন্ডিজ পেসার শেলডন কটরেল (৮.৫ কোটি)। রয়েছে বাংলার যুব প্রতিভা ঈশান পোড়েল।
দিল্লি ক্য়াপিটালস বেশ কিছু পরিবর্তন এনেছে। আগেই বদলাবদলি করে তারা ঘরে তুলেছে অভিজ্ঞ রবিচন্দ্রন অশ্বিন ও অজিঙ্ক্য রাহানেকে। ওপেনিংয়ে দেখা যাবে ইংল্য়ান্ডের আক্রমণাত্মক ব্য়াটসম্যান জেসন রয়কে। বোলিংয়ে কাগিসো রাবাডা তো আছেনই। এসেছেন অজি অলরাউন্ডার মার্কাস স্টোইনিস ও ক্রিস ওকস। সদ্য় সমাপ্ত উইন্ডিজ সিরিজে দুরন্ত ফর্মে থাকা শিমরন হেটমায়ারকে ৭ কোটি ৭৫ লক্ষ টাকায় তুলে নিয়েছে রিকি পন্টিংয়ের দল।
রাজস্থান রয়্যালস অশ্বিন-রাহানেকে ছেড়ে তাঁদের জায়গায় এনেছে দক্ষিণ আফ্রিকার মারকুটে ব্য়াটসম্য়ান ডেভিড মিলারকে। রয়েছেন ওশেন টমাস, টম কারান ও অ্যানড্রিউ টাই। অভিজ্ঞ স্টিভ স্মিথ, রবিন উথাপ্পা, জস বাটলার নিশ্চিত ভাবে ব্য়াটিং বিভাগকে শক্তিশালী করবেন। এ কথা বলে দেওয়ার অপেক্ষা রাখে না।
সানরাইজার্স হায়দরাবাদ তাদের কোর টিম ধরে রেখেছে। দলে এসেছেন অনূর্ধ্ব-১৯ ভারত অধিনায়ক প্রিয়ম গর্গ। রয়েছেন অজি অলরাউন্ডার মিচেল মার্শ ও ওয়েস্ট ইন্ডিজের ফাবিয়ান অ্যালেন।
ধাওয়ানের প্রত্যাবর্তন ও ভারতের মাথাব্যথা
রোহিত শর্মা বিশ্রাম চাওয়ায় টিমের দরজা খুলে গিয়েছে শিখর ধাওয়ানের জন্য। রাহুলের সঙ্গে ওপেন করবেন তিনি। শ্রীলঙ্কায় ধাওয়ান রান করলে কিন্তু মিষ্টি মাথাব্য়থার উদ্রেক হবে ভারতীয় থিঙ্কট্যাঙ্কের। কারণ রঞ্জিতে সেঞ্চুরি হাঁকিয়ে ধাওয়ান বুঝিয়ে দিয়েছেন, ব্যাটিংটা ভুলে যান নি তিনি।
তিনজন ওপেনার ফর্মে থাকলে রোহিত শর্মার সঙ্গে কে ওপেন করবেন, সেটাই দেখার বিষয়। পরিভাষায় বলতে গেলে, "ইট ইজ আ গুড হেডেক টু হ্য়াভ"। এখনও চারে শ্রেয়স আয়ার, পন্থ ব্য়র্থ হলে। কোথাও ধোনিকে মিস করি। মুখিয়ে আছি আইপিএল-এর জন্য। মনেপ্রাণে চাই, যুব ও প্রতিশ্রুতিবান খেলোয়াড় উঠে আসুক, যদিও বিশ্বকাপের মতো মঞ্চে অভিজ্ঞতার দাম থেকে যায়।
শরদিন্দু মুখোপাধ্যায়ের নিয়মিত কলাম পড়ুন এখানে