Advertisment

২১ দিনে হবে না, বলছে বাঙালি বিজ্ঞানীর আন্তর্জাতিক গবেষণা

যদি প্রথম একুশ দিনের পরে পাঁচ দিন বিরতি দিয়ে, আরো আঠাশ দিন, এবং আবার পাঁচদিন বিরতি দিয়ে আরো মাত্র আঠারো দিন লকডাউন রাখা যায়, তাহলেও ১০ জুনের মধ্যে আমরা জিতে যাবো করোনা-ভাইরাসের সঙ্গে লড়াইয়ে।

author-image
IE Bangla Web Desk
New Update
Corona research, Lockdown

২৩ মার্চ ২০২০ তে শুরু হলো ভারতজোড়া একুশ দিনের লকডাউন।  করোনাভাইরাসের মারণ-কামড় থেকে বাঁচতে এই লকডাইনে  বিপর্যস্ত একশো তিরিশ কোটির দেশ। কিন্তু একুশ দিন পরে কি আবার জনজীবন স্বাভাবিক হবে? নাকি ফের মানুষের মেলামেশায় শরীর থেকে শরীরের সেতুতে ছড়িয়ে পড়বে মারণ ভাইরাস তার সুবিপুল গতিতে, যে গতি অংকের ভাষায় এক্সপোনেনশিয়ালি বাড়ে।

Advertisment

ইটালিতে ফেব্রুয়ারি পনেরো থেকে মার্চ  ছাব্বিশের মধ্যে, অর্থাৎ মাত্র একমাস দশ দিনের সময়ে ছিয়াশিহাজার মানুষ নিশ্চিত ভাবে কোভিড-১৯ ভাইরাসে আক্রান্ত, মারা গেছেন নহাজারের বেশি মানুষ।  স্পেনে কাল পর্যন্ত চার হাজারের বেশি মৃত্যু, একদিনেই মারা গেছেন ছশো-পঞ্চান্ন জন মানুষ। আমাদের দেশের যা জনসংখ্যা এবং জনঘনত্ব, এই ভাইরাস একবার মড়কের তৃতীয় পর্যায়ে  পৌঁছলে, অর্থাৎ যখন কার থেকে কার শরীরে গেলো তা আর বোঝা যায় না, সব্জিওলার হাত থেকে না ডাক্তারের নিঃশ্বাস থেকে মৃত্যু-ভাইরাস শরীরে আসবে তা  বলা যায় না, সেই “কমিউনিটি স্প্রেড”এর সময় এসে যাবে, তখন আর কিন্তু রক্ষা নেই আমাদের। এমতাবস্থায়, কিভাবে কতদিন দেশ ঝাঁপি বন্ধ করে বসে থাকবে এই অদৃশ্য শত্রুর মোকাবিলা করতে, তার উত্তর কেবল বিজ্ঞানই দিতে পারে। শহর থেকে গ্রামে ফিরছে নিরন্ন শ্রমিকের পদাতিক মিছিল।  এখন এই প্রশ্ন সবচাইতে বড় আমাদের সবার কাছে। কোথায় এই মহামারীর শেষ।

করোনার দিনগুলোয় বাস্তবায়িত হোক নিম্নবিত্তের সুরক্ষা 

সেই উত্তর খুঁজেছেন ক্যামব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যাপনারত বিখ্যাত গণিতবিদ ও পদার্থবিদ রণজয় অধিকারী এবং তাঁর সহকর্মী গণিতবিদ রাজেশ সিং।  ক্যামব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয় ও ইনস্টিটিউট অফ ম্যাথমেটিক্যাল সায়েন্স চেন্নাইয়ের দুই গবেষকের এই যৌথ গবেষণায়, ভারতের জনসংখ্যা, তাঁদের বয়স অনুযায়ী বর্গবিভাজন, বিভিন্ন বয়সের মানুষ কিভাবে কোন কোন সামাজিক পরিকাঠামোয় কাছাকাছি আসেন (স্কুল, কলেজ, কর্মস্থল, পরিবার, ইত্যাদি) তার বিশ্লেষণ, এবং মারণরোগের বিস্তারের গতিপ্রকৃতির ও গতিবেগের নানান জটিল গাণিতিক হিসাবের মাধ্যমে দেখানো গেল, শুধু একুশ দিনের লকডাউন আমাদের দেশকে বাঁচাতে পারবে না করোনাভাইরাসের কবল থেকে। দেশে বর্তমানে কতজন কিভাবে আক্রান্ত, এবং তাঁদের সামাজিক যোগাযোগ অন্যদের সঙ্গে ঠিক কিরকম, এইসব বিশ্লেষণ করে বাংলার ছেলে এবং বিখ্যাত বিজ্ঞানী ডক্টর অধিকারী দেখাচ্ছেন যে এই লকডাউন যদিও ভাইরাস-আক্রান্ত মানুষের সংখ্যা বেশ খানিকটা কমিয়ে আনতে পারবে, তবু একুশদিন পরে স্বাভাবিক মেলামেশা শুরু হলে, আবার বিশে এপ্রিল নাগাদ নতুন করে ভাইরাস-আক্রান্তের সংখ্যা বাড়তে থাকবে যা ভয়ানক এক্সপোনেনশিয়াল কার্ভে চলে যাবে তেরোই মে নাগাদ, প্রায় ছয় হাজার মানুষকে রোগগ্রস্ত করে ফেলে। তারপর ছয় থেকে বারো হাজার, বারো থেকে চব্বিশ হাজার করে লাখে পৌঁছতে সময় লাগবে মাত্র কদিন।  আর লক্ষ থেকে কোটির হিসেবটা নাহয় আমরা আর নাই করলাম!

তাহলে কি আশার আলো নেই কোন? তা কিন্তু নয়। এই বিজ্ঞানীদের গবেষণামূলক প্রবন্ধটি আমাদের এই অন্ধকার করোনা-সুড়ঙ্গপথে আশার আলোই দেখায়।  যদি একুশ দিনের জায়গায় টানা উনপঞ্চাশ দিন লকডাউন চালানো যায়, তাহলে তেরোই মে-র মধ্যে এই ভয়ানক ক্ষুদ্র শত্রুকে আমরা সম্পূর্ণ বাগে আনতে পারবো। যদি সত্যিই লকডাউন ফলপ্রসূ হয় দেশ জুড়ে, তেরোই মে নাগাদ হয়তো একশোর অনেক নীচে নেমে আসবে আক্রান্তের সংখ্যা। কিন্তু এমন লকডাউনের অনেক অন্য প্রভাবও তো থাকে। অর্থনীতি দুমড়ে মুচড়ে যায়। দিন-আনি-দিন-খাই মানুষের পেটে অন্ন জোটে না। দেশে নেমে আসতে পারে ভয়ানক অরাজকতা। তাই, মাঝখানে মাঝখানে একটু বিরতি দিতে হতে পারে। অংকের সাহায্যে এমন অনেক লকডাউন প্যাটার্ন বা নক্সার  সম্ভাবনা দেখিয়েছেন এই বিজ্ঞানীরা।

Corona curve India, Lock Down যে ভাবে যা হতে পারে

যেমন, যদি প্রথম একুশ দিনের পরে পাঁচ দিন বিরতি দিয়ে, আরো আঠাশ দিন, এবং আবার পাঁচদিন বিরতি দিয়ে আরো মাত্র আঠারো দিন লকডাউন রাখা যায়, তাহলে দশই জুনের মধ্যে আবারো আমরা জিতে যাবো করোনা-ভাইরাসের সঙ্গে লড়াইয়ে। আক্রান্তের সংখ্যা নেমে আসবে একশোর অনেক নীচে।

আবার শুরু হবে স্বাভাবিক দিন। যেহেতু কম্পিউটার প্রোগ্রামিং ও অংকের সাহায্যে করা হয়েছে এই গবেষণাটি, আমাদের সরকারে প্রয়োজন অনুযায়ী, ঠিক ঠিক কীভাবে কোন বিষয়সূচী মাথায় রেখে, অর্থনীতির উপর প্রভাব ইত্যাদি কমাতে, মানুষের সার্বিক আক্রান্ত হবার হার, বা বৃদ্ধদের মৃত্যুর হার কমাতে, ঠিক কি ভাবে সামাজিক দূরত্ব এবং লকডাউনের কর্মসূচি গ্রহণ করা হবে তার আলাদা আলাদা পরিকল্পনা দিতে সক্ষম এই বিজ্ঞানীদের কম্পিউটেশনাল মডেলটি।

যাঁরা অঙ্কে উৎসাহী তাদের জন্য জানানো হল যে মহামারী বিস্তারের গতিপ্রকৃতি হিসাব করার জন্য এক জটিল এসআইআর মডেল (epidemiological SIR model) ব্যবহার করা হয়েছে, পূর্বানুমানে ব্যবহৃত তথ্যের ছিদ্রপূরণের জন্য ব্যবহার করা হয়েছে প্রসিদ্ধ বেসিয়ান ইমপিউটেশন (Bayesian imputation model)। ইটালি ও চীনের মানুষের সামাজিক যোগাযোগ ও ছোঁয়াছুঁয়ির  যে কাঠামো, তাকে যেমন ব্যবহার করা হয়েছে, তেমনই ভারতবর্ষের পরিবারে যেভাবে তিন-প্রজন্মের মানুষ মিলেমিশে থাকেন সেখানে কিভাবে রোগ এক বয়স থেকে অন্য বয়সে আরো বেশি ছড়িয়ে যেতে পারে, তার হিসেবও রেখেছে এই গবেষণাপত্রটি। তবে অত হিসাবে মাথা না গুলিয়ে ফেলে, মোদ্দা কথা এই যে, কেবল একুশ দিনের লকডাউন আমাদের বাঁচাতে পারবে না এই মহামারীর প্রকোপ থেকে। আরো একটু লম্বা হবে আমাদের যুদ্ধ।

এই দুর্দিনের ঘন কালো মেঘে  আলোর রেখাটুকু  এই যে, আমরা এবার হয়তো আরো একটু কম অন্ধভাবে, আরো একটু চক্ষুষ্মান হয়ে জানতে পারবো এই সুড়ঙ্গের শেষে কোথায় মুক্তি। যুদ্ধের শেষ দেখতে পেলে মানুষ যুদ্ধে উৎসাহ পায়। নইলে অনিশ্চয়তার অন্ধকার বড্ড চেপে ধরে সবাইকে।  বিজ্ঞানই দিতে পারে সেই আলো। খুব সম্ভব দিলোও। আমাদের সরকার কেন্দ্রে এবং আমাদের বাংলা-রাজ্যে খুবই  তৎপর এই আপৎকালে মানুষের জীবনরক্ষায়। আশা করি বিজ্ঞানের হাতিয়ার এই ভয়ংকর লড়াইয়ে আমাদের সবাইকে আরো কিছুটা সমর্থ করে তুলবে। আমাদের সরকারকেও।

coronavirus
Advertisment