অনেক রথী-মহারথী যেটা করে উঠতে পারেনি, সেটাই করে দেখিয়েছেন রমেশ পুরালে। একান্তই একজন অখ্যাত মানুষ, দেশের কোটি কোটি আম জনতার একজন রমেশ। তাতে কি, নিজের প্রতি অন্যায়ের প্রতিবাদ করতে পিছু হটেননি তিনি এবং লড়াই করে জয়ী হয়েছেন। প্রমাণ করেছেন ধৈর্য, সাহস, মনোবল ও আত্মবিশ্বাস থাকলে কঠিন যুদ্ধও জেতা যায়।
ভূমিকা ছেড়ে আসল কথায় আসি। কী করেছেন রমেশ ? না, এই যে কেন্দ্রীয় সরকারের জারি করা নিয়মানুযায়ী স্যালারি অ্যাকাউন্টে আধার লিঙ্ক করা বাধ্যতামূলক, পোর্ট ট্রাস্টের কর্মী রমেশ তার প্রতিবাদ করেন। প্রসঙ্গত, দেশের সর্বোচ্চ আদালত ইতিমধ্যেই জানিয়ে দিয়েছে ব্যাঙ্ক ও অন্যান্য আরও কয়েকটি ক্ষেত্রে আধার লিঙ্ক বাধ্যতামূলক নয়। আক্ষেপ, সুপ্রিম কোর্টের এহেন নির্দেশের পরও বহু মানুষ আধার সংক্রান্ত সমস্যায়, জটিলতায় জর্জরিত। একটা সংশয় ও ধোঁয়াশা রয়েই গেছে বিষয়টা ঘিরে।
আরও পড়ুন, রাজনীতিনামা: বাংলায় বিজেপি উত্থান
ফিরে আসি রমেশ পুরালের কথায়। ঘটনাটা এইরকম, রমেশ পুরালে, মুম্বই পোর্ট ট্রাস্টের একজন কর্মী। কাজ করেন চার্জম্যানের পদে। স্যালারি অ্যাকাউন্টে আধার লিঙ্ক করতে রাজি হননি তিনি। যুক্তি খুব স্পষ্ট, আধার তার ব্যক্তিগত যাবতীয় তথ্যের যোগাযোগ সূত্র। সেটা কোনওভাবেই অন্য ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে শেয়ার করবেন না তিনি। এমন ভাবনা বহুবার বহু ক্ষেত্রে আপনার-আমার মাথাতেও এসেছে। কিন্তু আমরা সেভাবে প্রতিবাদ করে উঠতে পারিনি। রমেশ পেরেছেন।
তাঁর প্রতি চূড়ান্ত অন্যায়টা শুরু হয় এরপরই। আধার লিঙ্ক করেননি বলে ২০১৬ থেকে মুম্বই পোর্ট ট্রাস্ট তাঁকে বেতন দেওয়া বন্ধ করে দেয়। আইনি লড়াইয়ের পথে যান রমেশ। এই চরম অন্যায়ের বিরুদ্ধে অভিযোগ জানিয়ে পিটিশন ফাইল করেন তিনি। শেষ পর্যন্ত জয়ী হন রমেশ। মুম্বই হাইকোর্ট স্পষ্ট জানিয়ে দেয়, আধার লিঙ্ক না হওয়ার জন্য রমেশের বেতন আটকে রাখা যাবে না।
আরও পড়ুন, জন ও স্বাস্থ্য: সুস্থতার দিকে… রোগ প্রতিরোধ ও সচেতনতা
২০১৫-র ডিসেম্বরে ইউনিয়ন মিনিস্ট্রি অফ শিপিং-এর পক্ষ থেকে রমেশকে একটি চিঠি দিয়ে জানানো হয়, তাঁকে আধার কার্ড স্যালারি অ্যাকাউন্টের সঙ্গে লিঙ্ক করতে হবে। রমেশ আপত্তি জানান। কারণটা আগেই বলেছি। এরপর ২০১৬-র জুলাই মাস থেকে রমেশের বেতন বন্ধ করে দেওয়া হয়। যাই হোক দীর্ঘ আইনি যুদ্ধে রমেশের জয় হয়। দুই বিচারপতি এ এস ওকা ও এস কে সিন্ধের ডিভিশন বেঞ্চের নির্দেশ অনুযায়ী মুম্বই পোর্ট ট্রাস্টকে রমেশের বকেয়া ৩০ মাসের বেতন দিতে হয়েছে, সঙ্গে ৭.৫% সুদ। মুম্বই পোর্ট ট্রাস্ট একটা যুক্তি আদালতের সামনে খাড়া করার চেষ্টা করেছিল, তাদের ৮০০ কর্মীর মধ্যে রমেশের একার জন্য নিয়ম বদলানো সম্ভব নয়। কোর্ট জানিয়েছে রমেশ এক ও অদ্বিতীয় হলেও কোনও অজুহাতে বা যুক্তিতেই কারও বেতন আটকে রাখা যায় না, যাবে না।
নিঃসন্দেহে, কোনও প্রতিষ্ঠানই এমনটা করতে পারে না। একজন মানুষ বিনা বেতনে মাসের পর মাস কাজ করে যাবেন, এত চরম অন্যায়। সুখের কথা , দেরিতে হলেও এই অন্যায়ের প্রতিকার হয়েছে। দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছেন রমেশ। কিন্তু, এই প্রেক্ষিতেই উঠে আসছে বেশ কিছু প্রশ্ন। যেমন, এই দৃষ্টান্তে অনুপ্রাণিত হয়ে ক'জন রমেশের পদাঙ্ক অনুসরণ করবেন? আমাদের উদাসীনতার খোলস ছেড়ে এরপরও আমরা বাইরে আসবো কি? আবার তার থেকেও বড় কথা, ক'জনের কাছে আদৌ পৌঁছেছে রমেশের কাহিনি! যত দূর মনে পড়ে, সংবাদ মাধ্যম খুব বেশি হইচই করেনি এই খবরটি নিয়ে।
আরও পড়ুন, গণতন্ত্রের স্বার্থে এবার দ্রুত ঘর গোছাক কংগ্রেস
এর বাইরে সামগ্রিক ভাবেই আধারের প্রয়োগ নিয়ে বেশ কিছু সংশয় ও বিতর্ক রয়ে গেছে। আইন আর প্রশাসনের মধ্যে সমন্বয় নেই। আইন বলছে কিছু কিছু ক্ষেত্রে বাধ্যতামূলক নয়। প্রশাসনিক স্তরে আজও বাধ্য করা হচ্ছে সাধারণ মানুষকে, আধার লিঙ্কের প্রশ্নে। সাধারণের অনেকেই জানেনও না সুপ্রিম রায়। শিক্ষার সুযোগ যাঁরা পান না, জরুরি ও গুরুত্বপূর্ণ তথ্য বা সংবাদ জানার উপায় যাঁদের নেই, সমাজের সেই সব মানুষের কথা ছেড়েই দিলাম। আমরা যাঁরা নিজেদের তথ্যসমৃদ্ধ মনে করি,তারাও কি সবাই এই আধার-প্যান-রেশন কার্ড সংক্রান্ত নিয়মকানুন, নথিভুক্ত করা ইত্যাদি প্রক্রিয়াগুলি খুব ভালো করি বুঝি বা জানি ?
জানি না, কিন্তু, নিয়মের শিকলে বাঁধা পড়ে আছি। আমার আধার, আমার পরিচয়। সে তো একান্তই আমার ব্যক্তিগত সম্পদ। দেশের সরকার তাকে নিয়ন্ত্রণে রাখতে চাইছে। সেটা উচিত না অনুচিত সেই সাংবিধানিক জটিল প্রশ্নে না গিয়েও একটা প্রশ্ন নিশ্চয়ই তোলা যায়। আমার আধার নানা সূত্রে চলে যাচ্ছে ঘরের বাইরে। অর্থাৎ সুরক্ষিত নয় আমার ব্যক্তিগত তথ্যাদি। আর সেই সুযোগে আমার যাবতীয় গোপনীয়তা, জীবন ও সম্পদ যে কোনওদিন চোর-ডাকাত-জোচ্চররা লুঠ করে নিতে পারে, নিচ্ছেও। প্রশাসন , যে কিনা সরকারি নীতি ও নিয়মের সহায়ক , সে কিন্তু সাধারণের ব্যক্তিগত তথ্যের সুরক্ষার গ্যারান্টি দিতে পারছে না । কেন ?
আরও পড়ুন, যুক্তি প্রমাণের দুনিয়ায় তথ্যের স্বচ্ছতা
আমাদের শৈশবে ছিল শুধু রেশন কার্ড। এর মাধ্যমে সস্তায় খাদ্যসামগ্রী পাওয়া ছাড়াও এটাই ছিল আমাদের নাগরিকত্বের প্রমাণপত্র। অনেক বছর পর্যন্ত রেশন কার্ডই ছিল একমাত্র বৈধ পরিচয়পত্র। তারপর প্যান, পার্সোনাল অ্যাকাউন্ট নাম্বার। এর ভূমিকা মূলত আয়কর সংক্রান্ত বিষয়ে। তারই সঙ্গে পরিচয়পত্র রূপেও দাখিল করা হতে লাগলো। সব শেষে আধার। আধার যেন ভগবানের দেওয়া সার্টিফিকেট। এদেশে জন্ম-মৃত্যুর মাঝে বেঁচে থাকার যে তা থৈ নাচন, আধার ছাড়া সেখানে এক পাও নাচা, থুড়ি চলা যাবে না।
সরকার হুজুর মা-বাপ! যেমন আজ্ঞা দেবেন! কিন্তু ব্যক্তিগত তথ্যের গোপনীয়তা? আধারের সূত্রে তার যে দফারফা। আপনি নিয়মিত আয়কর জমা দেন। সেখানে আপনার ব্যাঙ্ক স্টেটমেন্ট থাকে। তবু অ্যাকাউন্টে আধার যুক্ত করো। এদিকে এক সকালে এটিএম থেকে টাকা তুলতে গিয়ে দেখলেন অ্যাকাউন্ট খালি। কেউ বা কারা রাতারাতি ফাঁকা করে দিয়েছে। সাইবার বিশেষজ্ঞদের মতে যত্রতত্র আধার লিঙ্কের কারণেই চোরদের রাডারে চলে যাচ্ছে আপনার সম্পদের তথ্য। চোরদের রাডারে আপনি। চোর কিন্তু পুলিশের রাডারে নাও থাকতে পারে। ধারাবাহিকতা দেখে বলা যায় আর সব ক্ষেত্রের মতোই এক্ষেত্রেও অপরাধীরা অনেক বেশি চতুর, ক্ষমতাশালী, প্রভাবশালীও বটে। প্রযুক্তির দিক থেকেও বেশ এগিয়ে তারা।
আরও পড়ুন, এন আর সি ও আসামে ‘বিদেশি পাকড়াও’ করার নানা হাতিয়ার
তাহলে কী দাঁড়ালো ? আধার নিয়ে আমরা এখনও অনেকটাই আঁধারে। কোথায় অপরিহার্য আর কোথায় নয়---এ বিষয়ে আইন ও প্রশাসনের এক সুর হওয়া প্রয়োজন। দেশের নাগরিকদের ব্যক্তিগত ডেটাবেস সরকারের কাছে থাকবে আর তাদের আর্থিক নিরাপত্তার দায়িত্ব সরকার নেবে না, এটা কি ঠিক ?
কী করবেন, কীভাবে করবেন তার দায় শুধু মহামান্য আদালতের নয়। সরকারি পর্যায়ে যাঁরা বড় বড় নীতি ও নিয়ম নির্ধারণ করেন, তাঁদেরও সমান দায় এক্ষেত্রে। শেষ করবো রমেশ পুরালেকে কুর্নিশ জানিয়ে। লড়াইটা করেছেন তিনি। প্রশ্ন তুলেছেন কর্তৃপক্ষের রক্তচক্ষুর সামনে। কিছু মানুষকে তো অন্তত পথ দেখিয়েছেন! আজকের গড্ডলিকা প্রবহমান সময়ে এও কি কম পাওয়া?