এই মুহূর্তে সারা বিশ্বে একমাত্র আলোচ্য বিষয় করোনা। একদিকে যেমন ডাক্তার এবং স্বাস্থ্যকর্মীরা চেষ্টা করছেন করোনায় আক্রান্ত মানুষদের সারিয়ে তুলতে অন্যদিকে তেমনি বিজ্ঞানীরাও চেষ্টা করছেন কী করে প্রতিষেধক তৈরি করা যায়। এর পাশাপাশি প্রযুক্তিবিদেরাও নিজেদের মতো করে ভাবছেন কি করে কোনও প্রযুক্তির উদ্ভাবন করা যায় যা দিয়ে চিহ্নিত করা যাবে করোনা আক্রান্ত ব্যক্তিদের।
ভারত সরকারের তরফে কিছুদিন আগে বলা হয়েছে যে নাগরিকদের একটি মোবাইল অ্যাপ্লিকেশন তাঁদের ফোনে ডাউনলোড করতে হবে। এর ফলে নাকি বোঝা যাবে কোথায় কোথায় করোনা সংক্রমণের ঘটনা ঘটেছে। প্রধানমন্ত্রী তাঁর জাতির উদ্দেশে যে ভাষণ দিলেন সেখানেও তিনি বিশেষ করে ফোনে আরোগ্য সেতু অ্যাপের উল্লেখ করলেন। বিরোধী দলেরা স্বভাবতই এর বিরোধিতা করেছেন। বিভিন্ন সংগঠন এবং ব্যক্তিবর্গের কাছ থেকে প্রধানমন্ত্রীর কাছে এই বিষয়ে চিঠিও গেছে।
আরও পড়ুন, ফিরব বললে ফেরা যায় নাকি! – কোভিড দুনিয়ার বাস্তব
একদল বলা শুরু করেছেন সেই একই যুক্তি দেখিয়ে যে কারও যদি লুকোনোর মতো কিছু না থাকে তাহলে আপত্তি কোথায়? এই একই যুক্তি দেখানো হয়েছিল আধারের সময়ে, একই যুক্তি দেখানো হয়েছিল নোটবন্দির সময়ে, কিন্তু সবকটি ক্ষেত্রেই কি এটা প্রমাণিত হয়নি যে আসলে ওগুলো দিয়ে দুর্নীতি কমে না। আরোগ্য সেতুর ক্ষেত্রেও যখন এক যুক্তি দাঁড় করানো হচ্ছে তখন কি এই বিষয়টি নিয়ে কথা বলাটা সময়ের দাবি হয়ে উঠছে না ?
প্রথমে বুঝতে হবে কীভাবে এই আরোগ্য সেতু কাজ করবে? সরকারের নির্দেশ অনুযায়ী প্রত্যেক নাগরিককে তাঁদের স্মার্ট ফোনে এই মোবাইল অ্যাপ্লিকেশন নেওয়ার সময়ে নিজেদের নাম, ফোন নম্বর সহ আরও বেশ কিছু তথ্য দিতে হবে। তারপর এই আরোগ্য সেতু কাজ করা শুরু করবে। বলা হয়েছে যে এই অ্যাপ্লিকেশন যাঁদের ফোনে থাকবে তাঁরা যদি কোনও করোনা আক্রান্ত ব্যক্তির সংস্পর্শে আসেন তাহলে সরকার বুঝতে পারবে দেশের কোন কোন জায়গায় কারা সংক্রামিত। যারা স্মার্ট ফোন ব্যবহার করেন তাঁদের মোবাইলে অনেক ধরনের মোবাইল অ্যাপলিকেশন থাকে, দিনে কত ক্যালরি খাবার খাওয়া জরুরি, কত ক্যালরি হেঁটে বা দৌড়িয়ে পোড়ানো উচিৎ, কত ব্লাড প্রেশার বা কত সুগার এরকম হাজারো আছে।
এগুলো ব্যবহার করলে সঠিক তথ্য পাওয়া যায় কি না, তা সম্পর্কে ধারণা না থাকলেও অনেকেই এইগুলো ব্যবহার করেন। বলা হয়েছে এর মধ্যে দিয়ে কোনও ব্যক্তি কোনও করোনা আক্রান্ত মানুষের সংস্পর্শে এসেছেন কিনা সেটা বোঝা যাবে। কিভাবে যাবে? মোবাইলের ব্লুটুথ এবং জিপিএস চালু রাখতে হবে, তার মধ্যে দিয়ে বোঝা যাবে আশেপাশে কোনও করোনা আক্রান্ত মানুষ আছেন কিনা?
সুতরাং সঙ্গে সঙ্গে সরকারের কাছে তথ্য পৌঁছে যাবে যে অমুক অঞ্চলে একজন বা একাধিক করোনা আক্রান্ত মানুষ আছেন। দেশের অন্তত ৫০ শতাংশ মানুষ যদি এই আরোগ্য সেতু নিজেদের মোবাইলে না নেন, তাহলে এই প্রযুক্তি কতটা কাজ করবে তা নিয়ে সন্দেহের অবকাশ আছে। বলা হয়েছে যে আপাতত প্রত্যেকটি মানুষের তথ্য সেই মোবাইলেই জমা থাকবে, যদি কোনও মানুষ করোনা আক্রান্ত হন তখন সেই তথ্য সরকারের কাছে দেওয়া যেতে পারে।
আরও পড়ুন, পুঁজির বিশ্বাসঘাতকতা এবং ভারতীয় শ্রমিক
কিন্তু শোনা যাচ্ছে যে এই তথ্য একটি বেসরকারি সংস্থার কাছে রাখা থাকবে, যারা যেকোনো কারও কাছে এই তথ্য বিক্রি করতে পারবে, ঘটনাচক্রে এই সংস্থার কাছেই ভারতের বহু নাগরিকের আধারের তথ্য রাখা আছে এবং বিভিন্ন সময়ে যা আরও অন্যান্য সংস্থার কাছে বিক্রি করা হয়েছে।
সবচেয়ে জরুরি যে বিষয়টি নিয়ে অনেকেই কথা বলেননি, তা হল এই অ্যাপটি একটি সন্দেহ ঢুকিয়ে দেওয়ার প্রযুক্তি। আমাদের মতো দেশে যেখানে শুধু করোনা আক্রান্ত এই সন্দেহে একেক জন মানুষকে গ্রাম ছাড়া করা হয়, বা অবসাদে কোনও কোনও মানুষ আত্মহত্যাও করছেন এই খবরও পাওয়া যাচ্ছে সেখানে এই ‘আরোগ্য সেতু’ অ্যাপটি কি মানুষে মানুষে আরও দূরত্ব বাড়াবে না? একজন মানুষ যদি জানতে পারেন তাঁর পাশের মানুষটি করোনা আক্রান্ত তাহলে কি মব লিঞ্চিং বা গণপিটুনির ঘটনা ঘটবে না, বা অন্তত একঘরে করার প্রক্রিয়া শুরু হবে না, সেই নিশ্চয়তা দেওয়া যায়? যে দেশে শুধু খাদ্যাভাসের কারণে একের পর এক গণহত্যা ঘটে, সেখানে কে করোনায় আক্রান্ত, কে সংখ্যালঘুদের কোন সমাবেশে হাজির ছিল সেটাও যদি বোঝা যায় তাহলে একজন নাগরিকের জীবন কি অসুবিধায় পড়তে পারে না?
এখন প্রশ্ন হচ্ছে সরকার কি কোনও নাগরিককে বাধ্য করতে পারে এই ধরনের কোনও মোবাইল অ্যাপ্লিকেশন নিতে ? জাতীয় বিপর্যয় আইন ২০০৫ এর যে আইনকে দেখিয়ে এই কথা বলা হচ্ছে যে সতর্কতা মূলক অঞ্চলে বা লাল অঞ্চলে প্রত্যেকটি নাগরিকের যেন আরোগ্য সেতু থাকে সেটা কি এই আইনে বলা যায়?
এক কথায় উত্তর না, বলা যায় না। কারণ এই জাতীয় বিপর্যয় আইনও সংবিধানের যৌথ তালিকায় পড়ে, অর্থাৎ কেন্দ্র আইন বলবৎ করতেই পারে, কিন্তু রাজ্যগুলোকে এ ব্যাপারে অনুরোধ করতে হবে যাতে রাজ্যগুলো তা মেনে চলে। এক্ষেত্রে আরও একটি বক্তব্য থেকে যায় যে কোনও সরকার কোনও নাগরিককে এই অত্যন্ত ব্যক্তিগত তথ্য সরকারকে দিতে বলতে পারে না আইনত, এবং কর্মক্ষেত্রেও কোনও কোম্পানির মালিক এই তথ্য চাইতে পারেন না। শুধুমাত্র বেতন সংক্রান্ত কোনও তথ্য ছাড়া অন্য যে কোনও তথ্য কোনও সংস্থার মালিক চাইতে পারেন না। কারণ ২০১৭ সালের যে প্রাইভেসি বিল আনার কথা হয়েছিল, যা আপাতত যৌথ সংসদীয় কমিটির বিবেচনাধীন আছে সেই অনুযায়ী, একজন ব্যক্তি নাগরিকের স্বাস্থ্য সংক্রান্ত তথ্য একান্তই গোপনীয় এবং ব্যক্তিগত তথ্য। ইচ্ছে করলে যে কোনও নাগরিক তাঁর মালিককে কোর্টে নিয়ে যেতে পারে শুধু মালিক যদি দেখতে চান যে তাঁর কর্মচারীর মোবাইল ফোনে আরোগ্য সেতু আছে কি না।
২০১৭ সালে ৯ সদস্যের যে বেঞ্চ প্রাইভেসি বা গোপনীয়তার রায় দিয়েছিলেন সেই বেঞ্চে ছিলেন বিচারপতি ডি ওয়াই চন্দ্রচূড়। তিনি বলেছিলেন যে কোনও আপৎকালীন বা জরুরি পরিস্থিতিতে সরকার তথ্য চাইলেও তাঁকে আগে বলতে হবে যে এই তথ্য তাঁরা অন্য কোনও কাজে ব্যবহার করবেন না, এবং কোনও নাগরিকের কোনও তথ্য যে তাঁরই তথ্য সেটা তাঁরা বাইরে প্রকাশ করবেন না।
যে দেশে করোনার মতো মহামারী হলে সরকারি স্বাস্থ্য পরিষেবা পেতে গেলে যে কোনও নাগরিকের অবস্থা যথেষ্ট করুণ হচ্ছে, যে দেশে স্বাস্থ্যকর্মীদের সাধারণ পিপিই নেই, যে দেশে মাত্র ৩০ শতাংশ মানুষ স্মার্ট ফোন ব্যবহার করেন, যে দেশে করোনায় যত মানুষ মারা যাবেন তার থেকে বেশী মানুষ দারিদ্র এবং খিদের জ্বালায় মারা যাচ্ছেন, যে দেশে মানুষ কুসংস্কারাচ্ছন্ন এবং থালা বাজিয়ে, শাঁখ বাজিয়ে বা মোমবাতি জ্বালিয়ে মনে করেন যে করোনা দূর করা যায়, সেই দেশে আর কিছু না থাক মোবাইল অ্যাপ্লিকেশন আছে।
এই দেশে মানুষ সরকারকে কাঠগড়ায় দাঁড় করানোর কথা ভাবেন না যে কেন স্বাস্থ্য খাতে বাজেট বরাদ্দ এতো কম? এই দেশে মানুষ করোনায় কেন এতো কম পরীক্ষা হচ্ছে তা নিয়ে চিন্তিত না হয়ে আরোগ্য সেতুর মতো মোবাইল অ্যাপ্লিকেশন দিয়ে করোনা মুক্ত দেশ তৈরি করবে ভাবে। এই দেশে মানুষ প্রশ্ন করতে ভুলে গেছেন তাই পিএম কেয়ারের টাকা কোথায় যাচ্ছে কেউ চিন্তিত হন না, তাঁরা ভাবছেন যে এই আরোগ্য সেতু বোধহয় কোনও তাবিজ কবজ যা দিয়ে নিজেকে রক্ষা করতে পারবেন।
আসলে তাঁরা এটা বুঝতে পারছেন না যে এই আরোগ্য সেতুর সাহায্যে প্রতিটি মানুষের চলাফেরা নজরদারি করা হবে, কোন ওষুধের দোকান থেকে কী ওষুধ কিনছেন একজন মানুষ, কিংবা কী ধরনের জামাকাপড় পছন্দ করেন তিনি বা কী ধরনের অনুষ্ঠান টিভিতে দেখতে উনি পছন্দ করেন সমস্ত কিছু মাপা হবে। সেই অনুযায়ী তারপর একজন ব্যক্তি মানুষকে নিয়ন্ত্রণ করাটা কি সুবিধাজনক হবে না?
এই মুহূর্তে একজন ফরাসি এথিক্যাল হ্যাকার বারংবার দেখিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করছেন যে এই আরোগ্য সেতু মোবাইল অ্যাপলিকেশনে সহজেই বাইরের মানুষ ঢুকতে পারে এবং একজন ব্যক্তি মানুষের সমস্ত ব্যক্তিগত তথ্য নিয়ে নিতে পারে, কিন্তু এরকম কোনও খবরই আমাদের খুব বেশি নাড়া দিচ্ছে না, আমরা কেমন যেন এক মরীচিকার পিছনে ছুটে চলেছি। ঠিক যেমন ভাবে বলা হয়েছিল যে নোটবন্দিতে কালো টাকা ফিরে আসবে, জিএসটিতে ব্যবসায়ে সুবিধা হবে, আধার দিয়ে সন্ত্রাসবাদ ঠেকানো যাবে, কিন্তু তা কি হয়েছে? একটারও কি কোনও সুফল আমরা দেখতে পেয়েছি? না অদূর ভবিষ্যতে দেখতে পাওয়ার আশা আছে? এর প্রত্যেকটার উত্তরই না। আরোগ্য সেতুও যে কোনও কবচ-কুন্তল নয়, এটাও যে করোনার পরীক্ষার কোনও বিকল্প নয় সেটা যত তাড়াতাড়ি আমরা বুঝতে পারবো ততই মঙ্গল।
আমরা জানি চিনে এই ধরনের কন্টাক্ট ট্রেসিং মোবাইল অ্যাপ্লিকেশন কিংবা মুখের ছবি দেখে চেনার পদ্ধতি কিংবা আরও উন্নত বেশ কিছু প্রযুক্তি করোনা মোকাবিলায় ব্যবহৃত হয়েছে তাতে চিন বেশ কিছু অংশে হয়তো সফল ও হয়েছে এই মহামারী রুখতে।
কিন্তু এই ধরনের অতিমারীর মতো ঘটনা আমাদের রোজ আরও কিছু শিক্ষাও দিচ্ছে বা দিয়েছে। সেটা কী? আমরা রোজ এই লকডাউনের মধ্যে থাকতে থাকতে এটাও শিখছি যে কীভাবে অনেক কিছু ছাড়াও মানুষ বাঁচতে পারে। রোজ দুবেলা দুমুঠো ভাতও হয়তো অনেকের জুটছে না। অনেকেই হয়তো ভাবছেন একদিন আমরা এই অবস্থা থেকে নিশ্চিত বেরোবো। তখন কি আমরা নতুন কিছু শিখে বেরোবো? আজ থেকে কিছু বছর আগেও কি আমরা এই স্মার্ট ফোনে অভ্যস্ত ছিলাম? ইজরায়েলের ঐতিহাসিক জুভাল নোয়া হারারির মতে যদিও বা এই করোনা সংক্রমণ একদিন কেটে যাবে, কিন্তু যে মোবাইল অ্যাপ্লিকেশন যা আজকে হয়তো মানুষের হাঁচি, কাশি চেনার চেষ্টা করছে, আগামী দিনে কি তা মানুষের হাসি, কান্না, একঘেয়েমি বা অন্যান্য শারীরবৃত্তিয় প্রক্রিয়াগুলিও চেনা কিংবা নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা করবে না এটা কি জোর দিয়ে বলা যায়?
(সুমন সেনগুপ্ত কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাস্তুকার ও সমাজকর্মী, মতামত ব্যক্তিগত।)