দুটি মানুষ দু'দশকের বেশি সময় একই ছাদের নিচে বেঁচে থাকেন পারস্পরিক নির্ভরতা, ভরসা, আস্থা ও বিশ্বাসে। তাঁদের জীবনের সুরটি যে পরম ভালোবাসার তারে বাঁধা, তা বুঝে নিতে অসুবিধা হয় না। আইনের অনুমোদন বা সামাজিক অনুশাসনের উর্দ্ধে গিয়ে রচিত এই সম্পর্ক একান্তই দু'টি প্রানের নিজস্ব জগৎ। একটা সময়ের পর তাঁরা উপলব্ধি করেন, এবার সম্পর্কটাকে আইনের স্বীকৃতি দেওয়া প্রয়োজন। বাস্তবতা ও যুক্তিগ্রাহ্যতার নিরিখে তাঁদের এই সিদ্ধান্তও একান্তই ব্যক্তিগত।
দীপঙ্কর দে ও দোলন রায়, বাংলা বিনোদন জগতের এই দুই বিশিষ্টজন বাইশ বছর লিভ-ইন রিলেশনে থাকার পর সম্প্রতি বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হন। বিয়ের পরই গুরুতর অসুস্থ হয়ে পড়েন দীপঙ্কর। হাসপাতালে চিকিৎসাধীন থাকার পর আপাতত বাড়িতে ফিরেছেন তিনি।
এই পুরো বিষয়টাই একটা ঘটনাচক্র। তাঁদের দুজনের পক্ষে ব্যক্তিগত সংকট-সমস্যার এবং প্রবল দুশ্চিন্তার মুহূর্ত। প্রায় দিশেহারা হওয়ার মতো একটা অবস্থা। অত্যন্ত লজ্জার কথা হলো, একটি গোষ্ঠী এটা নিয়েই ব্যাঙ্গ-বিদ্রুপ-তামাশা করতে মাঠে নেমে পড়েছেন। তাঁদের বক্তব্য, এই বয়সে বিয়ে ও তাকে ঘিরে উৎসব, আনন্দ, উত্তেজনা ইত্যাদির ধাক্কা সামলাতে পারেননি দীপঙ্কর। তাই এই অসুস্থতা!
আরও পড়ুন: ‘ভাইরাল’ ভাইরাসে আক্রান্ত সমাজ, ঠিক ভুল একাকার
মানবতা, সংবেদনশীলতা, এসব শব্দ তো কবেই অভিধান থেকে মুছে ফেলেছি আমরা। এখন চক্ষুলজ্জাও বিসর্জন দিলাম মনে হচ্ছে। কোথায় কখন কী বলতে হবে, সেই বিবেচনা থাকাটা কিন্তু সভ্য সমাজের রীতির মধ্যেই পড়ে। অপরের জীবনের অন্দরে কতদূর উঁকি মারব সেই সীমানাও বেঁধে দেওয়া আছে শিক্ষিত সমাজে। আক্ষেপ, আমরা বিবর্তনের প্রক্রিয়ায় আদিম থেকে তথাকথিত আধুনিক হয়েছি। কিন্তু সভ্য বা শিক্ষিত হতে পারিনি।
প্রসঙ্গত, এই যে গোষ্ঠী, যাঁরা দীপঙ্কর-দোলনের কঠিন সময়ে অতি উৎসাহে আসরে নেমে পড়েছেন তামাশার মদিরাপাত্র হাতে নিয়ে, তাঁরা কিন্তু সব যুগেই ছিলেন ও আছেন। মনে পড়ছে, বাংলা সিনেমার এক কিংবদন্তী দম্পতির কথা, রবি ঘোষ এবং অনুভা গুপ্তা। অনুভা বয়সে রবির চেয়ে অনেকটাই বড়। এটাকে ইস্যু করেই সেসময় রবির অনুভাকে বিয়ে করা নিয়ে প্রচুর কেচ্ছা ও বিতর্ক তৈরির চেষ্টা করেছিলেন এঁরাই।
আজকের সময়ে পৌঁছে দীপঙ্কর-দোলনের সম্পর্ককেও একইভাবে কালিমালিপ্ত করার চেষ্টা করে চলেছেন এঁরা। কথায় বলে, ভালোবাসা সবচেয়ে মহান। কী আক্ষেপ, দুটি মানুষের এই নিবিড় ভালোবাসাও আমাদের অনুপ্রাণিত করে না, কোনও মহত্বের অনুভূতি দেয় না। উল্টোভাবে দেখলে, নিন্দা-বিতর্ক-সমালোচনার চাটনি বিলাসে উদ্বুদ্ধ করে। এটা তো সব কিছু বাদ দিয়ে সেই ভালোবাসারই পরাজয়!
আমার এক সম্পর্কিত দিদি, কার্যকারণে টালিগঞ্জ স্টুডিও পাড়ায় কিছুটা যাতায়াত ছিল তাঁর। সেই দিদির মুখেই শোনা, অনুভা মারা যাওয়ার পর শিশুর মতো কেঁদেছিলেন রবি। সেটা নিয়েও হাসাহাসি করেছিল লোকজন। ওঁদের অমলিন সম্পর্ক, অনুভার চলে যাওয়ায় রবির একা হয়ে যাওয়া, এসব কিছুই স্পর্শ করেনি তাদের।
আরও পড়ুন: জেএনইউ কী শেখাল? হয় বশ্যতা, নয় ধ্বংস
আসলে স্পর্শকাতরতা বিষয়টাই যে নেই। সেদিনও ছিল না। আজও নেই। এই ঘটনা বহু বছর আগে ঘটা। মাঝে ক'টি যুগ পার হয়েছে। অবস্থা বদলায়নি। অপরের ব্যক্তিগত সমস্যা-সংকট, শোক-দুঃখের মুহূর্তে তাঁদের রক্তাক্ত করার মধ্যে উল্লাস খুঁজে নেন কিছু মানসিকভাবে অসুস্থ মানুষ। তাঁরা যদি বিখ্যাত ব্যক্তি হন, তাহলে সেই উল্লাস লাগামছাড়া হয়ে যায়। এটা নিঃসন্দেহে এক সামাজিক অসুখ এবং সোশ্যাল মিডিয়ার কল্যাণে সেই অসুখ যে বহুগুণে পল্লবিত আজ, সে কথা বলার অপেক্ষা রাখে না।
যদিও সাধারণভাবে আমাদের সকলের ক্ষেত্রেই সুখ-দুঃখ, আনন্দ-বেদনা, শোক, বিরক্তি, খুশি ইত্যাদি অনুভূতিগুলি সমান। খ্যাতনামারা ভিনগ্রহ থেকে আসেন নি। যন্ত্রণার মুহূর্তে আমাদের মতোই তাঁদেরও রক্তক্ষরণ হয়। পেশার সূত্রেই নানা সময়ে বিভিন্ন বিখ্যাত মানুষের সংস্পর্শে আসার সুযোগ হয়েছে। অনেককেই খুব কাছ থেকে দেখেছি। অনুভব করেছি মুহূর্তগুলিকে, যখন তাঁরা একান্তের বেদনায় মর্মাহত বা ব্যক্তিগত আনন্দে উজ্জীবিত।
তাঁদের ওপর অগণিত মানুষের চোখ, জানেন তাঁরা। অনেক সময়েই চোখের জল কালো চশমার আড়ালে লুকোতে হয় তাঁদের। জনসমক্ষে মন হালকা করার উপায় থাকে না। বোধহয় তার জন্যই অনেক গভীরে বয়ে বেড়াতে হয় বেদনার অভিঘাত। তবু, সেই সব বিকৃত রুচির মানুষের দেওয়া খোঁচা, আঘাত থেকে মুক্তি মেলে না তাঁদের। সেই সব মানুষরা আজ দীপঙ্কর-দোলন, অতীতে অন্য কেউ, আগামিকাল অন্য কাউকে মজার খোরাকে পরিণত করেছেন, করবেন।
আরও পড়ুন: বিপর্যয় মোকাবিলা: কী পারা যায়, কী পারা যায় না
এই দলটি যে কতখানি নিচে নামতে পারে, তার প্রমান সাম্প্রতিককালে শাবানা আজমির দুর্ঘটনা-পরবর্তী চালচিত্র। এক্ষেত্রে তাঁর ওপর নেমেছে নির্মম ও অত্যন্ত ঘৃণ্য সাম্প্রদায়িক খাঁড়া। এক বিশেষ ধর্মের রক্ষক হিসেবে দাবিদার গোষ্ঠীর দাবি, শাবানার দুর্ঘটনা থেকে বেঁচে ফেরা কেন? চলে গেলেই তো ভালো হতো! ভাবলেও শিউরে উঠতে হয়। অত্যন্ত প্রতিভাধর, আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন একজন গুণী অভিনেতা, সর্বোপরি একজন মানুষ। তাঁকে নিয়ে এহেন মন্তব্য বুঝিয়ে দেয় কোন অধঃপাতে চলেছি আমরা! শাবানা কেন, কারও ক্ষেত্রেই কি এমনটা ভাবতে পারেন কোনও সুস্থমনের মানুষ?
ব্যক্তিগত শোক ও সংকটের মুহূর্তে এঁরা আশা ভোসলের মতো কিংবদন্তী সংগীতশিল্পী বা দিগ্বিজয় সিংয়ের মতো কৃতি রাজনীতিবিদকেও ছাড়েন নি। প্রথমে দিগ্বিজয়ের কথা। বয়সে বেশ কিছুটা ছোট এক তরুণী সাংবাদিককে বিয়ে করার পর প্রথমে বিতর্কের ঝড়ের মুখে পড়েন তিনি। বিয়ের কিছুদিন পরেই তাঁর প্রথম পক্ষের কন্যা কর্নিকার মৃত্যু হয় ক্যান্সারে। কন্যাশোকের মুহ্যমান দশা কাটিয়ে উঠতে পারেননি তখনও দিগ্বিজয়, সোশ্যাল মিডিয়ায় শুরু হয়ে যায় তোলপাড়-করা কুৎসিত মন্তব্যের বর্ষণ।
পাপের শাস্তি পেয়েছেন দিগ্বিজয়, এটাই ওই নেট দুনিয়ার বোদ্ধা জনতার অভিমত। কী সেই পাপ? না, তিনি কাউকে ভালোবেসে তাঁকে স্ত্রীর মর্যাদা দিয়েছেন। এই স্বঘোষিত বিচার-বিশ্লেষকরা নিজেদের মোদীজির সমর্থক বলেও দাবি করেছিলেন সেদিন। রসাতলে যাওয়া ধর্মকে পুনরুদ্ধার করাই নাকি এঁদের লক্ষ্য। এটা কোন ধর্ম? যা মানুষের গাঢ় বেদনার মুহূর্তেও চরম অমানবিক হয়ে ওঠে?
আরও পড়ুন: পুলিশ, প্রশাসন, এবং ভিলেনের মুখোশ
আশা ভোসলের প্রথম অপরাধ ছিল, তিনি তাঁর অর্ধেক বয়সী রাহুল দেব বর্মনকে বিয়ে করেন। সে সময় ছাড়া পাননি রাহুলও। তিনিই বা কেন মায়ের বয়সী একজন মহিলাকে বিয়ে করলেন? যেন কে কার জীবনে কী সিদ্ধান্ত নেবেন, তার ঠিকাদার এঁরাই। এরপর রাহুলের অকালমৃত্যুর পর এই সবজান্তা গোষ্ঠী তুলে আনে রাহুলের প্রতি আশাজীর অবহেলার তথ্য ও তত্ত্ব। তিনি একান্তই উচ্চাকাঙ্ক্ষী। সিঁড়ি হিসেবে ব্যবহার করেছেন পঞ্চমকে, এখন প্রয়োজন ফুরিয়েছে, তাই অবজ্ঞা-অবহেলা, এসব কথাও শোনা গেল। আশাজীর কর্মফল সম্পর্কে এদের তত্ত্বকথা আরও একবার বিশদ হলো তাঁর কন্যা বর্ষা ভোসলের আত্মহত্যার পর। মা হিসেবে যন্ত্রণায় দগ্ধ হতে হতেই শুনতে হয়েছে তাঁকে, কত স্বার্থপর তিনি, কেরিয়ার নিয়েই মেতে আছেন। সংসারে মন দেননি।
যেটা লক্ষ্যনীয়, এই প্রত্যেকটা ভাবনা, বিচার, সিদ্ধান্তে উপনীত হওয়া, সবটাই কিন্তু একতরফা। যাঁরা এসব করছেন, তাঁরা কেউই অপর পক্ষের জীবন দর্শন বা যাপনের খবরই রাখেন না। বিখ্যাত মানুষের জীবনকে বহু দূর থেকে দেখে একটা মনগড়া ধারণা করে নেন। আর তার ওপর চাপিয়ে দেন নিজেদের অসুস্থ মনের ধূসর রং। এই রঙে খ্যাতনামাদের কালিমালিপ্ত করে তাঁরা এক বিজাতীয় উল্লাসের স্বাদ পান। এই কাজটি তাঁরা বছরভরই করে চলেন।
ইন্টারনেটের আশীর্বাদপ্রাপ্ত সোশ্যাল সাইটগুলি তাঁদের এই উল্লাসের আগুনকে অনেক বেশি বিস্তৃত করতে সাহায্য করেছে আজ, সেকথা বলাই বাহুল্য। শুধু বিশেষ কিছু সময়েও যদি একটু সংযত হতেন এঁরা! সেই 'সময়' যখন খ্যাত-অখ্যাত সকলেই বিপর্যস্ত, বেদনাহত। যখন অনেক বেশি সমবেদনার প্রয়োজন। প্রয়োজন পাশে থাকার। অন্তত তখনকার মতো একান্তে থাকতে দেওয়া হোক তাঁদের। আর এটুকুও না পারলে নিজেদের মানুষের পর্যায়ে ফেলা কেন?