এবারের লোকসভা নির্বাচনের ফল প্রকাশের আগে অবশ্যই আলোচনা হয়েছিল তৃণমূল নেত্রীর প্রধানমন্ত্রী হওয়ার সম্ভাবনা নিয়ে। অধীর আগ্রহে অপেক্ষায় ছিলেন তাঁর সমর্থকেরা। সঙ্গে বাঙালি আবেগ তো ছিলই। পশ্চিমবঙ্গের বাইরেও মমতা ব্যানার্জীর প্রধানমন্ত্রিত্ব নিয়ে আলোচনা করেছেন রাজনৈতিক নেতানেত্রীরা। যাই হোক, সে ঘটনা ঘটে নি। অর্থাৎ এক্ষেত্রে একটা ছোট্ট আশা ছিল, যা নাকি বাস্তবায়িত হয় নি। রাজনীতিতে এমনটা একেবারে স্বাভাবিক। আপাতত যা পরিস্থিতি, তাতে পশ্চিমবঙ্গে ঘর সামলানোটাই তাঁর বড় কাজ। ফলে রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রীর প্রধানমন্ত্রিত্ব নিয়ে এখন আলোচনা হওয়ার সম্ভাবনা কম, আপাতত কমপক্ষে পাঁচ বছরের অপেক্ষা।
আরও পড়ুন, বহরমপুরের রবিনহুড থেকে দিল্লির দলনেতা: অধীর চৌধুরীর বিজয়পথ
অন্যদিকে যে কথা সাধারণভাবে মাথায় আসে নি, সেটাই হল। অধীর চৌধুরীকে কংগ্রেসের সংসদীয় দলের নেতা নির্বাচন করলেন গান্ধী পরিবার। এর জন্যে খুব ভাবতে হয়েছে এমনটা নাও হতে পারে। দশ শতাংশ আসনের কম পাওয়া কংগ্রেস বিরোধী দলের মর্যাদাই পায় নি, আগের বারের মতই। দলে গান্ধী পরিবারের সদস্য ছাড়া সেভাবে জাতীয় নেতা বলে কেউ নেই। যেটুকু টিমটিম করছে তা মাত্র কয়েকটি রাজ্যে। সেখানেও ব্যাপক পরিবারতন্ত্রের ছায়া। এছাড়া পরপর বেশ কয়েকবার সাংসদ হয়েছেন এমন নেতা বলতে হাতে গুনে অধীর চৌধুরী বা শশী থারুরের মত অল্প কয়েকজন। ফলে এর বাইরে বিশেষ বিকল্প ছিল না। দল যে পরিবারের সম্পত্তি নয় তা বোঝানোর দায় কংগ্রেসের চিরকাল থাকে। সেই জায়গায় গান্ধী পরিবার সংসদে নেতৃত্ব ছেড়ে দিলে অধীরবাবু অত্যন্ত স্বাভাবিক পছন্দ। রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা সহজ বিষয়টা ভেবে দেখেন নি, তাই এই খবরটায় কিছুটা চমক জুড়েছে। কিন্তু বহু লড়াইয়ের সাথী, বামপন্থী ভাবধারার সঙ্গে রাজনৈতিক জীবনের শুরুতে যোগাযোগ, তারপর কংগ্রেসের নেতা হিসেবে বামফ্রন্টের সঙ্গে টক্কর দেওয়া, সব মিলিয়ে এই নেতার মধ্যে বিরোধী চরিত্র একাকার হয়ে আছে। ডাকাবুকো মানসিকতার এবং সোজা সাপটা কথা বলা অধীরবাবু তাই বিরোধী নেতা হিসেবে একেবারে সঠিক পছন্দ।
জাতীয় রাজনীতির প্রেক্ষিতে আপাতত অধীরবাবুর কাজ ভালো কিছু বক্তব্য রাখা। এর মধ্যেই তাঁর প্রথম কিস্তি পেশ করা হয়ে গেছে এবং তিনি সসম্মানে উত্তীর্ণ। ভালো বক্তব্য রাখার নজির এর আগে সংসদে প্রচুর আছে। কিন্তু আজকের পরিস্থিতিতে বিষয়টি আলাদা। বিশেষ করে কেউ যখন পশ্চিমবঙ্গের সাংসদ। বহু বছর ধরে সবাই জানতেন যে আর কিছু না থাক, বাঙালিদের আঁতলামো আছে, আছে সমাজবিজ্ঞান কিংবা ইতিহাস সম্পর্কে ভালো জ্ঞান, আছে প্রগতিশীলতা। উত্তর ভারতের চড়া দাগের রাজনীতির ওপর ভিত্তি করে সংসদে পেশ করা ভাষণের তুলনায় বাঙালির লেকচার যে অন্যরকম হবে সেকথা মানতেন সবাই। এখন দিন অন্যরকম। আজ (২০ জুন, ২০১৯) যে ইংরিজি স্টেটসম্যান কলকাতা থেকে ছাপা বন্ধ হয়ে গেল সে খবর রাখার দায় নেই বাঙালিদের। বরং অনেক বেশি আকর্ষণীয় সংবাদ দ্বিচক্রযান চড়ে মাঝরাতে কে কাকে তাড়া করল, কটা বিধায়ক কিংবা পুরপ্রতিনিধি হাতবদল হল যুযুধান দুই রাজনৈতিক দলের মধ্যে। বাজারে অনেক বেশি খাচ্ছে যে পশ্চিমবঙ্গের বেশির ভাগ সাংসদ নিয়মনীতি জলাঞ্জলি দিয়ে সংসদের শপথ গ্রহণেও ধ্বনি সন্ত্রাসে আবদ্ধ। এই কীর্তিতে দেশের বাকি সাংসদদের মজা পাওয়া দেখে একজন বাঙালি হিসেবে অসহায় লাগাটাই স্বাভাবিক। সেই অসহায়তা তাঁর বক্তব্যে হয়ত কিছুটা ঘুচিয়েছেন সাংসদ অধীর চৌধুরী। আর রাজনৈতিক কৌশলে এখন বিজেপির মূল লক্ষ্য এক দেশ, এক ভোট। বিষয়টির পক্ষে এবং বিপক্ষে বিভিন্ন রকমের যুক্তি আছে। সেই জায়গায় দাঁড়িয়ে বিরোধী অধীরবাবু কিভাবে নেতৃত্ব দেন তা দেখার অপেক্ষায় থাকবে সারা দেশের মানুষ।
এবার সরাসরি আসা যাক পশ্চিমবঙ্গের কথায়। তৃণমূল-বিজেপির মুখোমুখি লড়াইতে অধীরবাবুকে কি তৃতীয় পক্ষের নেতা হিসেবে দেখা যেতে পারে? পশ্চিমবঙ্গের রাজনীতিতে দলবদল, পরিবারতন্ত্র, দুর্নীতি ইত্যাদি বিষয় এমনভাবে জড়িয়ে গেছে যে যুক্তিপূর্ণ রাজনীতির পরিসর এই মুহূর্তে অত্যন্ত সংকীর্ণ। বাম-কংগ্রেস যে বিজেপি-তৃণমূলের থেকে খুব অন্যমানের রাজনীতি করে এমন কথা কেউ বলবেন না। তবু এই মুহূর্তে তা বিজেপি-তৃণমূলের প্রতিযোগিতামূলক সাম্প্রদায়িক তথা প্রাদেশিক রাজনীতির প্রেক্ষিতে কোন এক তৃতীয় পক্ষ তো বটে। মুশকিল হল সেখানে জনসমর্থন বলতে খুব টেনেটুনে পনেরো শতাংশ। এই জায়গায় অধীর চৌধুরীকে দেখে কি অন্তত এই পনেরো শতাংশ একজোট হতে পারবে? অর্থাৎ বামফ্রন্ট আর কংগ্রেসের জোট কি এ রাজ্যে শিশুসুলভ ঝগড়াঝাঁটির গণ্ডি পেরিয়ে, অতিবৃদ্ধ তাত্ত্বিক লড়াইয়ের আগল ভেঙে, নিজেদের পা এবং নিজেরা বসে থাকা গাছের ডালে কুড়ুল না মেরে সাধারণ ভোটারদের আকর্ষণ করতে পারবে? অধীর চৌধুরী যে ভোট করাতে পারেন সে কথা প্রমাণ হয়েছে বারবার। সংসদীয় গণতন্ত্রে ভোট করানো কথাটা শুনতে খারাপ লাগলেও, ক্ষমতা দখলের রাজনীতিতে এ এক অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ পথ। ব্যঙ্গ করে অনেকে বলছেন যে এই লোকসভা নির্বাচনে ব্যারাকপুর সেই পথ দেখিয়েছে। সামনের দিনে বহরমপুর কি রাজ্য-রাজনীতির অন্য দিকনির্দেশ করতে পারবে?
ধরা যাক অধীরবাবুর নেতৃত্বে বাম-কংগ্রেস এক হয়ে লড়াই করল সামনের দিনগুলোতে। বহরমপুর বাদ দিয়ে অন্য জায়গায় যদি এর প্রভাব না পড়ে তাহলে তো আর আলোচনার প্রয়োজনই নেই। বিজেপি আর তৃণমূল নিজেদের মধ্যে নেতাবদলের রাজনীতি এগিয়ে নিয়ে যাবে, আর সাধারণ মানুষ এই দুই দলকেই ভোট দেবে বারবার। মুর্শিদাবাদ আর মালদার দুএকটা জায়গা বাদে নিশ্চিহ্ন হয়ে যাবে তৃতীয় পক্ষ। আপাতত বিজেপির পারদ ঊর্ধ্বমুখী, তবে সঠিক ফলাফল বুঝতে হয়তো বিধানসভা নির্বাচন পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হবে। তার কারণ বিভিন্ন পুরসভা নির্বাচনে পশ্চিমবঙ্গে স্বচ্ছ মতদানের সম্ভাবনা বেশ কম। পুরোটাই ঠিক হবে বাহুবলীদের দাপাদাপিতে। ফলে সামগ্রিক ভাবে সঠিক জনমত বুঝতে পারা শক্ত। আর অন্য দিকটা হল এ রাজ্যের আপাত-ক্লিশে রাজনীতিতে মানুষ একটু অন্য স্বাদ চাইলেন। সেক্ষেত্রে তৃতীয় পক্ষের ভোট সামান্য বাড়ছে কিনা, বুথের লড়াইতে তাদের উপস্থিতি লক্ষ্য করা যাচ্ছে কিনা, তা কিন্তু সামান্য হলেও বোঝা যাবে এই পুরসভা নির্বাচনগুলোতেই। কারণ সাধারণ নির্বাচনের বদলে দু-একটি ছোট জায়গায় প্রভাব দেখানো অনেকটা সহজ।
আর সেই জায়গায় পশ্চিমবঙ্গের বাম-কংগ্রেস জোটকে সরাসরি মানতে হবে অধীর চৌধুরীর নেতৃত্ব। তাঁকে পেশ করতে হবে পশ্চিমবঙ্গের ভাবী মুখ্যমন্ত্রী প্রার্থী হিসেবে। এ রাজ্যের মানুষ নেতা-নেত্রী খুঁজছেন। সকলের সব গুণ থাকে না, এবং রাজনীতিতে থাকলে অধিনায়ক কিংবা অধিনায়িকার বিরুদ্ধে অভিযোগ সবসময়েই থাকবে — অন্তত পশ্চিমবঙ্গে আজকের ঘোলা জলে। বামফ্রন্টের দিকে সুজন চক্রবর্তী কিংবা অশোক ভট্টাচার্যের মত নেতা বারবার শিরোনামে এসেছেন অল্প কিছুটা জমি দখল করে। কিন্তু তাদের রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী ভাবার মত পরিস্থিতি এখনও আসে নি। তৃণমূলে নেত্রী নিয়ে কোন সমস্যা নেই। আর বিজেপির ক্ষেত্রে জনমানসে আলোচনা চলছে দিলীপ ঘোষ, মুকুল রায় এবং অনেক সময় বাবুল সুপ্রিয়কে নিয়েও। এই পরিস্থিতিতে অধীর চৌধুরীও কিন্তু খুব খারাপ জায়গায় নেই। কংগ্রেসের সংসদীয় দলের নেতা হওয়ায় অবশ্যই তাঁর গুরুত্ব এবং মর্যাদা বাড়ল অনেকটা। কিন্তু সেটা কি রাজ্য রাজনীতিতে প্রভাব ফেলার জন্যে? নাকি অত্যন্ত সন্তর্পণে বড় দায়িত্ব দিয়ে অধীরবাবুকে সরিয়ে নেওয়া হল পশ্চিমবঙ্গ থেকে যাতে তৃতীয় পক্ষ একেবারে নিশ্চিহ্ন হয়ে যায় আগামী দু-এক বছরের মধ্যে। সংসদে অধীরবাবুর সোচ্চার প্রশংসা করলেন প্রধানমন্ত্রী, আর সেক্ষেত্রে খুব বুঝিয়ে বলার প্রয়োজন নেই যে রাজ্য রাজনীতিতে অধীরবাবু যদি খুব বেশি জায়গা না নেন, সেক্ষেত্রে সুবিধে বিজেপিরই। পশ্চিমবঙ্গে তাঁর প্রভাব বাড়লে কোন দিক থেকে ভোট বেশি ভাঙবে সে বড় জটিল হিসেব। অবশ্যই এই ঘটনাটির সম্ভাবনা কম। তবে সেই পরিস্থিতিতে বিজেপি এবং তৃণমূলকে অবশ্যই নজর রাখতে হবে জনমতের মতিগতির দিকে। অধীরবাবু অনেক পুরনো নেতা। সেরা সম্মান পেলেন তাঁর এতদিনের রাজনৈতিক জীবনে। বাকিটা জানার জন্যে ভবিষ্যতকে অতীত বানানোর সময়টুকু দিতে হবে।
(শুভময় মৈত্র ইন্ডিয়ান স্ট্যাটিস্টিক্যাল ইন্সটিটিউটের অধ্যাপক, মতামত ব্যক্তিগত)