/indian-express-bangla/media/post_attachments/wp-content/uploads/2019/11/jayanta_nov10.jpg)
নিরাপত্তার ঘেরাটোপে মোড়া অযোধ্যা। ছবি: বিশাল শ্রীবাস্তব, ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেস
ফের একটি ঐতিহাসিক রায় ভারতের সুপ্রিম কোর্টের। ২৭ বছরে আগে বাবরি মসজিদ ভাঙ্গা হয়। সেই ঘটনায় গোটা বিশ্বে নিন্দিত হয় ভারত। মসজিদ ভাঙার জন্য অভিযুক্তদের বিরুদ্ধে মামলা এখনও চলছে। সেটি একটি পৃথক মামলা। ১৮৫৬ পর্যন্ত এই বাবরি মসজিদে নামাজ পড়া হতো, তার কোনও প্রমাণ পাওয়া যায়নি বলে জানিয়েছে শীর্ষ আদালাত। উল্টে প্রধান বিচারপতি রঞ্জন গগইয়ের নেতৃত্বে পাঁচ বিচারপতি ঐক্যমত্যের ভিত্তিতে রামমন্দির নির্মাণের জন্য নতুন একটি ট্রাস্ট গঠনের নির্দেশ দিয়েছেন।
আরও বলে দেওয়া হয়েছে, তিন মাসের মধ্যে ভারত সরকারকে মন্দির গড়ার পরিকল্পনা জমা দিতে হবে। প্রধান বিচারপতি ১৭ নভেম্বর অবসর নিতে চলেছেন। তার আগে শনিবারের ঐতিহাসিক রায়ে আরও মেনে নেওয়া হলো আর্কিওলজিক্যাল সার্ভে অফ ইন্ডিয়ার রিপোর্ট। বলা হলো, বাবর আদৌ এই মসজিদ গড়েন নি। গড়েছিলেন মীর বাকি।
এখন প্রশ্ন হলো, অতঃ কিম? অর্থাৎ এর ফলে এখন বিজেপি কী করবে? বিজেপির আপাত রণকৌশল হলো, এখনই আর কাশী বা মথুরার মত অন্য কোনও মন্দিরের ব্যাপারে রাজনৈতিক আন্দোলন না করে অযোধ্যায় এক বিশাল রাম মন্দির নির্মাণ করা।
বিজেপির প্রতিপক্ষ অবশ্য মনে করছে যে পরবর্তী লোকসভা ভোটের আগে অযোধ্যায় রাম মন্দির নির্মাণ করেই বিজেপি ভোটে যাবে। তাতে অর্থনীতি ও অন্য সব ইস্যু ধামাচাপা পড়ে যাবে। মোদী যদিও বলছেন, রাম বাহিনী নয়, এ হলো দেশের জয়।
মোটমাট ভারতবর্ষে পাঁচশ বছরের প্রাচীন এক বিবাদের নিরসন হলো। দেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ হিন্দুদের বিশ্বাসকে যেমন সুপ্রিম কোর্ট মর্যাদা দিল, ঠিক সেভাবে আর্কিওলজিক্যাল সার্ভে অফ ইন্ডিয়ার অনুসন্ধান রিপোর্ট, তার তথ্য, ও সিদ্ধান্তকেও গুরুত্ব দিল।
এ ধরনের বিবাদ নিরসন খুব সহজ কাজ যে ছিল না, সে কথা নিশ্চয়ই সকলেই স্বীকার করবেন। রাজীব গান্ধী চেষ্টা করেছিলেন। সফল হন নি। নরসিংহ রাও তো বাবরি মসজিদ ভাঙার পর সুপ্রিম কোর্টের কাঁধে বন্দুক রেখে এই বিপদ বৈতরনী থেকে মুক্ত হতে চান। মনে আছে, প্রধানমন্ত্রী হয়ে চন্দ্রশেখর বলেছিলেন, তিন মাসের মধ্যে তিনি সমস্যার সমাধান করে দিতে পারেন। তাঁর সরকারই পড়ে গেল, সমস্যা সমাধান তো দূর অস্ত।
আজ এত বছর পর যে এই সমস্যার সমাধান হলো, সুপ্রিম কোর্ট দায়িত্ব নিয়ে একটা রায় ঘোষনা করল, তাতে মানসিকভাবে যথেষ্ট শান্তি পাচ্ছি। যাঁরা বলেন, এই বিতর্কের ভারতের রাজনীতিতে অগ্রাধিকার পাওয়া কাম্য নয়। অগ্রাধিকার পাওয়া উচিৎ অর্থনীতি, কর্মসংস্থান, উন্নয়নের, তাঁদেরও কিন্তু স্বস্তি পাওয়া উচিত। অন্তত এই রামমন্দির নির্মাণ নিয়ে সাম্প্রদায়িক উত্তেজনা আর বৃদ্ধি পাবে না।
দেখুন, এ ধরনের রায়ের পক্ষে ভারতের সমস্ত মানুষ থাকবেন এমনটা আশা করা উচিত নয়। এত বড় দেশ। কোটি কোটি মানুষ। সুপ্রিম কোর্টে পাঁচজন বিশিষ্ট বিচারপতি একত্রে এক অখণ্ড রায় দিয়েছেন ঐক্যমত্যের ভিত্তিতে, তবু রায়ের বিরুদ্ধে মতামত প্রকাশের অধিকার আছে। যে কোনও ভারতীয় নাগরিকের। কিন্তু মতপার্থক্য যাই হোক, সুপ্রিম কোর্টের এই ১,০৪৫ পৃষ্ঠার রায় পর্যালোচনা করলে বোঝা যাচ্ছে যে পাঁচ বিচারপতি প্রত্যেকটি তথ্য খতিয়ে দেখেছেন, এলাহাবাদ হাইকোর্টের রায় ও সেই সময়কার দলিলগুলি পর্যন্ত।
যেমন সুন্নি বোর্ডকে আদালত জানিয়েছে, ১২ বছরের মধ্যে আইন মেনে দাবি না জানানোয় আজ তাদের ওই জমির টাইটেলের ওপর কোনও অধিকার নেই। আবার রামলালাকেও আইনি সত্তা নয় বলে তাদেরও মন্দির নির্মাণের অধিকার নেই বলে জানিয়েছে। সুপ্রিম কোর্টের বক্তব্য, রামলালা ঈশ্বরের প্রতীক। আইনি শরিক জমির মালিক হবেন কী করে?
সুপ্রিম কোর্ট এখন ভারত সরকারকে নির্দেশ দিয়েছে একটি ট্রাস্ট গঠন করতে। সেই ট্রাস্ট তিনমাসের মধ্যে মন্দির নির্মানের পরিকল্পনা রচনা করবে। এই ট্রাস্ট গঠনের ক্ষেত্রে নির্মোহী আখড়াকে কাজে লাগানো যেতে পারে, কিন্তু নির্মোহী আখড়াও টাইটেল গ্রহণের ক্ষেত্রে ২০ বছরের মধ্যে দাবি না জানানোয় তাদের অধিকারও খারিজ করে দেওয়া হয়েছে। এই সব সিদ্ধান্ত নেওয়াও কিন্তু খুব সহজ কাজ ছিল না।
নরসিংহ রাও আদালতের দীর্ঘসূত্রিতা চেয়েছিলেন, কিন্তু মোদী তো দ্রুত নিষ্পত্তি চান। রামমন্দির সম্পর্কিত বিজেপির অবস্থানের সঙ্গে আপনি একমত না হতেই পারেন। তৃণমূল কংগ্রেস যখন এনডিএর শরিক ছিল, তখনও তো মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় রামমন্দির কর্মসূচির বিরুদ্ধ ছিলেন। শরিকদের ভূমিকা তখন গুরুত্বপূর্ণ ছিল, অটল বিহারী বাজপেয়ীকে জোট সরকার চালানোর জন্য আপস করতে হত। সেজন্য রামমন্দির, অভিন্ন দেওয়ানি বিধি ও ৩৭০, এসবই বিজেপিকে শিকেয় তুলে রাখতে হয়েছিল। মোদীর ক্ষেত্রে পরিস্থিতি ভিন্ন। তিনি বিপুল সংখ্যাগরিষ্ঠতা নিয়ে দ্বিতীয়বারের জন্য সরকার গঠন করেছেন।
দলীয় ইশতেহারে রামমন্দির নির্মাণের বিষয়টি নতুন নয়। আরএসএস-বিশ্ব হিন্দু পরিষদ-জনসঙ্ঘ পরবর্তীকালে বিজেপির কোর ইস্যু এটি। ১৯৮৯ সালে লালকৃষ্ণ আডবানীর নেতৃত্বে রামমন্দির আন্দোলন শুরু হয়। হিমাচল প্রদেশে পালমপুরে বিজেপির জাতীয় কর্ম সমিতির বৈঠকে এই রামমন্দির আন্দোলনের বিষয়ে কর্মসূচি গৃহিত হয়েছিল। তাই মোদী যা করেছেন, তা দলীয় মতাদর্শ ও নীতি থেকে এক ইঞ্চিও সরে যাওয়া নয়।
বরং রাজীব গান্ধী যখন অযোধ্যায় শিলান্যাস করার সিদ্ধান্ত নেন, তখন নারায়নদত্ত তিওয়ারি উত্তর প্রদেশের মুখ্যমন্ত্রী। রাজীব স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী বুটা সিংহকে পাঠিয়েছিলেন অযোধ্যায়। সে সময় 'মাচান বাবা'র আশীর্বাদ নিয়েছিলেন বুটা। গাছের ডালে বাঁধা মাচায় বসে থাকতেন মাচান বাবা। বুটা তাঁর পা মাথায় পাগড়ির ওপর রেখে ছবি তুলেছিলেন।
আসলে মুলায়ম সিং বা লালুপ্রসাদ যাদব যেমন সংখ্যালঘু আর যাদব ভোটের রাজনীতি করতেন, কিন্তু হিন্দুত্বর রাজনীতির বিরোধিতা করে মুসলিম ভোটকে দীর্ঘদিন অগ্রাধিকার দেন। কংগ্রেস কিন্তু চিরকাল তার বিরোধিতা করে। কারণ কংগ্রেসও হিন্দু ভোটেরও সাবেকি দাবিদার। গান্ধীই তো প্রথম রাম রাজ্য গঠনের কথা বলেন। 'রাম ধুন'কে জনপ্রিয় করেন। কংগ্রেস আজও হিন্দু মুসলিম দুই সম্প্রদায়কেই কাছে টানতে চায়। আর এটা করতে গিয়ে ভারতীয় রাজনীতির মেরুকরণে কংগ্রেস বিপদে পড়ে। আমও গেল, ছালও গেল কংগ্রেসের। শনিবারও সুপ্রিম কোর্টের রায়কে কংগ্রেস স্বাগত জানিয়ে সমালোচনা করেছে বিজেপির রাজনীতির।
মোদী-অমিত শাহ যা করছেন, তাতে কিন্তু ধারাবাহিকতার কোনও অভাব নেই। কোনও দ্বিচারিতা নেই। কমিউনিস্ট বা তৃণমূল নেতারা, এমনকি কংগ্রেসও এই হিন্দুত্ব রাজনীতির বিরোধিতা করতে পারেন। আপনার মনে হতে পারে এটা ধর্মনিরপেক্ষতা নয়, সাম্প্রদায়িকতা, কিন্তু মোদী যা করছেন, তা কিন্তু করছেন নিজস্ব এবং দলীয় কনভিকশান থেকেই।
এই রায়ের ঘোষনার পরও গোটা দেশে কিন্তু কোথাও কোনও অশান্তি বা উত্তজনা দেখা যায়নি। রায়ে বলা হয়েছে, মুসলিম সমাজকেও অযোধ্যায় একটি মসজিদ নির্মাণের সুযোগ দেওয়া হবে। এই মসজিদ নির্মাণ নিয়েও সরকার মুসলিম প্রতিনিধিদের সঙ্গে আলোচনা করবে। যদিও অল ইন্ডিয়া মুসলিম ল বোর্ড এই রায়ে সন্তুষ্ট নয়। কিন্তু বোর্ডের সকল সদস্যরা একমত নন। সাংবাদিক বৈঠকে খোদ চেয়ারম্যানই অনুপস্থিত ছিলেন। আবার উত্তরপ্রদেশ সুন্নি ওয়াকফ বোর্ড বলেছে এই রায়ের বিরোধিতা করবে না।
অন্যদিকে, রায়ে বলা হয়েছে, বাবরি মসজিদ বাবর নির্মাণ করেন নি। এই মসজিদ নির্মাণ করেছিলেন মীর বাকি। তিনি সুন্নি ছিলেন না। সিয়া ছিলেন। তাহলে সুন্নি সম্প্রদায়ের এই মসজিদ নির্মাণ কোনও অধিকার থাকবে কিনা তা নিয়েও মুসলিম সমাজের একাংশ প্রশ্ন তুলেছেন। নরেন্দ্র মোদী টুইট করে বলেছেন, কারোর হার বা কারোর বিজয় নয়। এ হলো দেশের জয়। মানুষের জয়।
সুপ্রিম কোর্টের এই রায়ের পর একটিই প্রত্যাশা, দেশে কোনও অশান্তি যেন না হয়। উগ্র হিন্দুয়ানির শক্তিও যেন মাথাচাড়া না দেয়। দীর্ঘদিনের এক সমস্যা সমাধান হয়েছে, শুধু এজন্য স্বস্তি পাওয়ার সময় এসেছে। যেন একটা ফিল্মের ক্লাইম্যাক্স হলো! এক লম্বা সিনেমা শেষ হলো। শেষে বলা হলো, হ্যাপি এন্ডিং।
পড়ে নিন অযোধ্যা মামলায় সুপ্রিম কোর্টের পূর্ণাঙ্গ রায়