এক তরুণী নৃত্যশিল্পী হিমালয়ে নাচের পূর্ণাঙ্গ চর্চাকেন্দ্র গড়ে তুলতে বদ্ধপরিকর। আর্থ-সমাজিক পরিস্থিতি নানাভাবে তাঁর সামনে বাধা হয়ে দাঁড়াচ্ছে- উদয়শঙ্করের অনবদ্য সৃষ্টি 'কল্পনা'র (১৯৪৮) বিষয়বস্তু এটাই। আর এই 'কল্পনা'কে বাস্তবে অবিস্মরণীয় করে তুলেছে অমলাশঙ্করের গভীর ও দৃপ্ত নৃত্য। কিন্তু, যে মেয়ের সঙ্গে ১৯৩০ পর্যন্ত নাচের কোনও সম্পর্কই ছিল না, তিনি এমন শিল্প রপ্ত করলেন কীভাবে!
যত কাণ্ড প্যারিসে!
১৯৩০ সালে ১১ বছর বয়সী অমলা নন্দী অধুনা বাংলাদেশের যশোর থেকে প্যারিসের উদ্দেশে রওনা দেন স্বর্ণ ব্যবসায়ী বাবার সঙ্গে। উপলক্ষ- আন্তর্জাতিক ঔপনিবেশিক প্রদর্শনীতে ভারতীয় কারূকর্মের প্রতিনিধিত্ব। আমন্ত্রণ ছিল নন্দীবাবুরই, কিন্তু ছোট্ট মেয়েও সঙ্গী হল বাবার। প্যারিসেই তাঁদের সঙ্গে আলাপ হয় শঙ্কর পরিবারের। বছর ত্রিশের উদয়শঙ্কর ততদিনে নৃত্যদুনিয়ায় পরিচিত নাম। মুম্বইয়ের 'জে জে স্কুল অব আর্টে' পড়া শেষ করে 'রয়্যাল কলেজ অব আর্টে' চিত্রকলা নিয়ে পড়ার জন্য ততদিনে লণ্ডন পাড়ি দিয়েছেন উদয়শঙ্কর। সেখানেই 'রাধাকৃষ্ণ' এবং 'একটি হিন্দু বিবাহ' নামের দুটি ব্যালাডের নির্দেশনা দেন উদয়শঙ্কর। এরকমই একটা অনুষ্ঠানে রাশিয়ার প্রখ্যাত নৃত্যশিল্পী আনা পাভলভার নজরে পড়েন উদয়শঙ্কর। এরপর লণ্ডন ও প্যারিসে আনার সঙ্গে উদয়শঙ্করের নৃত্যাভিনয় মুগ্ধ করে পশ্চিমী দুনিয়াকে। এবার ফিরে আসা যাক ১৯৩০ সালের প্যারিসে। সেবার তিন ভাই (রবিশঙ্করও ছিলেন) এবং মা হেমাঙ্গিনী দেবীকে নিয়ে ফ্রান্সে অনুষ্ঠান করতে গিয়েছিলেন উদয়শঙ্কর। অমলাকে দেখেই পছন্দ হয় হেমাঙ্গিনী দেবীর। তিনি ছোট্ট অমলাকে নিজের শাড়ি পরিয়ে দিতেন। সে সময় রবিশঙ্করের সঙ্গেই খেলতেন অমলা। রবিশঙ্কর আবার তখন দাদা উদয়শঙ্করের দলের সঙ্গে নাচতেনও।
বিদ্যারম্ভ
প্যারিসেই অমলাকে নাচের কয়েকটি মুদ্রা চেষ্টা করে দেখতে বলেন উদয়শঙ্কর। কথাতেই কাজ! উদয় ঠিক যেমনটা বলেছিলেন, ছোট্ট অমলা হুবহু তা করে দেখান। অমলার সেই নাচ দেখে মুগ্ধ হন উদয় এবং তাঁর মা হেমাঙ্গিনী দেবীকে তিনি বলেন অমলার বাবাকে অনুরোধ করতে যাতে তিনি ২ মাসের জন্য ইউরোপে মেয়েকে নাচের অনুষ্ঠান করার অনুমতি দেন। সে বছরই রবীন্দ্রনাথ উদয়শঙ্করকে বলেন এবার যেন তিনি নৃত্য চর্চার একটি কেন্দ্র গড়ে তোলেন। এরপর ১৯৩৮ সালে স্বয়ং উদয়ের হাতেই 'উদয়শঙ্কর সেন্টার ফর ডান্সে'র জন্ম হয়। এদিকে, নেতাজি সুভাষচন্দ্র বসু আবার ছিলেন যশোরের নন্দীদের বিশেষ পরিবারিক বন্ধু। নেতাজিই অমলার বাবাকে বলেন, মেয়েকে যেন তিনি উদয়শঙ্করের নৃত্যচর্চা কেন্দ্রে পাঠায়। আর নেতাজির কথা কি আর ফেলা যায়! আমলা আসেন সেন্টারে। সত্যিই শেখেন অমলা। শেখার মতো করে যে শিখেছিলেন তা বোঝা যায় কয়েক বছরের মধ্যেই।
শিব-পার্বতী অধ্যায়
ভারতনাট্যম থেকে অনুপ্রাণিত তাণ্ডব নৃত্যের আঙ্গিকে পার্বতীর ভূমিকাতেই হোক (শিব- উদয়শঙ্কর), অথবা কথাকলি ভিত্তিক অনন্য ধারার 'কার্তিকেয়'র শুরুর দৃশ্যে ধ্রুপদী ও লোকায়ত নৃত্যের অসামান্য সংমিশ্রণে, কিংবদন্তী স্বামী উদয়শঙ্করের পাশে চিরকাল সমুজ্জ্বল থেকেছেন তাঁর স্ত্রী তথা কিংবদন্তী নৃত্যশিল্পী অমলাশঙ্কর। উদয়শঙ্করের মতো বিরাট মাপের শিল্পীর সঙ্গে অমলাশঙ্কর কেবল সঙ্গত করে গিয়েছেন এমন নয়, বরং শিল্পকর্মে ভিন্ন মাত্রা যোগ করেছেন বরাবর। খাঁটি ধ্রুপদী ঘরানা থেকে উঠে আসা বিভঙ্গের সঙ্গে পরিমিতি বোধ ও সমসাময়িকতার মিশেলই অমলা শঙ্করের নৃত্যকে কালজয়ী করেছে। পরবর্তীকালে উদয়শঙ্করের পরম্পরাকে আরও সম্প্রসারিত করেছেন তিনি। সাতটি ধ্রুপদী নৃত্য ধারার সঙ্গে ভারতের লোকনৃত্যের সংমিশ্রণ ঘটিয়ে অমলাশঙ্কর পরবর্তী প্রজন্মের কাছে নৃত্যশিল্পকে এক ভিন্ন মাত্রায় উপস্থিত করেছেন।
সৃষ্টি ও প্রলয়ের যে চিরকালীন তত্ত্ব তা যেমন অননুকরণীয় ভঙ্গিমায় বিখ্যাত 'হস্তমুদ্রা'র মাধ্যমে ফুটিয়ে তুলতেন উদয়শঙ্কর, ঠিক তেমনই পার্বতী চরিত্রে অমলার 'লাস্য', নিয়ন্ত্রিত ও নান্দনিক কামনার প্রকাশ দর্শককে সম্মোহিত করে বারবার। ভরতের নাট্যশাস্ত্রে উল্লিখিত শিব-পার্বতীর যে চিরকেলে কাহিনী তা যেন জীবন্ত হয়ে উঠত জমকালো সাজসজ্জার পর শিব-পার্বতীরূপী উদয়-অমলার অভিনয়-নৃত্যে।
একক অমলা
ব্যালে নৃত্যে উদয়শঙ্কর সব আলো কেড়ে নিলেও অমলা বারবার তাঁর জাত চিনিয়েছেন একক অভিনয়-নৃত্যে। সেখানে সুঠাম পেশীর সদর্প ঝঙ্কার নেই বটে, কিন্তু রয়েছে লোকসংস্কৃতির স্বকীয় মেজাজ। 'যমুনা কে তীরে'তে সাধারণ সুতীর শাড়ি পরে সুক্ষ্ম অথচ তীক্ষ্ণ বিভঙ্গে যে সুরেলা ও গভীর অনুভূতির আবহ তৈরি করেছেন অমলাশঙ্কর তা পরিমিত শিল্পবোধের আদর্শ পাঠ্যপুস্তক।
আলমোরার সেন্টার অর্থাভাবে বন্ধ হয়ে যায়। এরপরই উদয়শঙ্কর তৈরি করেন 'কল্পনা'। এখানে সমাজের আর্থ-সামাজিক-রাজনৈতিক-ধর্মীয় দিকগুলির নানা ত্রুটিকে কড়া সমালোচনা করেন উদয়শঙ্কর। তবে দীর্ঘ আইনি বিবাদে আটকে যায় এই ছবি। বহুকাল পরে রবিশঙ্করের প্রচেষ্টায় ২০১২ সালে কান চলচ্চিত্র উৎসবে প্রদর্শিত হয় 'কল্পনা'। কিংবদন্তী অমলাশঙ্কর আমন্ত্রিত হন এই উৎসবে এবং রেড কার্পেটে অভ্যর্থনা জানানো হয় তাঁকে।
১৯২০ সালে আলাপ এবং ১৯৪২ সালে উদয়-অমলার বিয়ে হয়। সুদীর্ঘ দাম্পত্য এবং শৈল্পিক যাত্রার পর বিচ্ছেদও আসে পায়ে পায়ে। উদয়শঙ্করের মৃত্যুর কয়েক বছর আগে পৃথক হয়ে যান শিব-পার্বতী। তবে যথার্থ শিল্পাী অমলা থামেননি, এরপরও বহু বছর শিল্পচর্চা এবং শিক্ষা চালিয়ে গিয়েছেন। শুক্রবার সকালে ১০১ বছর বয়সে থামলেন বটে অমলা, কিন্তু তিনি অমলিন হয়ে রইলেন কল্পনায় এবং সংস্কৃতির আকাশে।
Read in English
ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেস বাংলা এখন টেলিগ্রামে, পড়তে থাকুন