যা বাঞ্ছনীয় তা করতে হবে।
যদি মনে হয়, বড়োরকমের কোনও ভুল হচ্ছে, তবে প্রতিবাদ করার অবশ্যই কারণ আছে। প্রতিবাদের মাধ্যমে পরিবর্তন আনার চেষ্টায় হৃদয় যেমন থাকবে, তেমন মাথারও যোগ থাকতে হবে।
দৃঢ় প্রত্যয়ে অনুজ প্রজন্মকে এই কথা শিখিয়ে দিলেন অধ্যাপক অমর্ত্য সেন। নবনীতা দেবসেন স্মারক বক্তৃতা, প্রথম বছর। বক্তা অমর্ত্যবাবু, বিষয় – বিরোধী যুক্তি। মেধা আর রসবোধের বিচ্ছুরণে ঘণ্টা দেড়েকের জারিত প্রায় অলৌকিক শীতসন্ধের ভিতর থেকে বেরিয়ে মেট্রোর এস্ক্যালেটরে পা দিয়ে হঠাৎ মনে পড়ল, অনু দুবের কান্না-কান্না মুখখানা।
হায়দরাবাদ গণধর্ষণকাণ্ডের প্রতিবাদে একা একটা প্ল্যাকার্ড নিয়ে পার্লামেন্টের সামনে বসে ছিলেন তিনি। পুলিশ তাঁকে আটকও করেছিল। পুরোপুরি একার ছিল সেই প্রতিবাদ। নাকি আসলে সমূহের হয়েই একক প্রতিবাদের মুখ হয়ে উঠেছিলেন অনু!
কেন মনে পড়ল তাঁর কথা? ইতস্তত হাতড়ে উদ্ধার করলাম একটি প্রসঙ্গ। জনৈক শ্রোতা একটি প্রশ্নের সূত্রে অমর্ত্যবাবুকে জানিয়েছিলেন, যে, খোদ নবনীতা তাঁকে নারীবাদী বলে অভিহিত করতেন। শুনে হাসলেন অমর্ত্যবাবু। বললেন, নারীবাদী হওয়ার যথেষ্ট কারণ রয়েছে।
তার মধ্যে অন্যতম হল, নারীবাদ যেমন নারীদের কথা বলে, তেমন সামগ্রিকভাবে বঞ্চনার কথাও বলে। গ্লোবালাইজেশনের খারাপ দিক নিয়ে সমালোচনা করতে গেলে তাঁকে প্রায়শই প্রশ্নের মুখে পড়তে হয়, যে, তাহলে কি তিনি চাইছেন গরিব দেশগুলো গ্লোবালাইজেশন বা এই সংযোগ থেকে বিচ্ছিন্ন থাকুক? উত্তরে তিনি বলেন, সমালোচনায় তা বলা হচ্ছে না। বলা হচ্ছে, এর ফলে গরিব দেশগুলোর যা সুবিধা পাওয়ার কথা ছিল, প্রাপ্ত সুবিধা তার কাছাকাছিও পৌঁচ্ছাচ্ছে না। ঠিক যেমন নারীবাদ মানে নারীদেরকে পরিবারবিচ্ছিন্ন বা নারী-পুরুষের যৌথ জীবন থেকে বিচ্ছিন্ন করে দেখা নয়, বরং পরিবারের মধ্যে তার যে সুবিধা-সম্মান, ন্যায়-ন্যায্যতা পাওনা ছিল, তা না-পাওয়ার, সেই বঞ্চনার প্রতিবাদ করা। বঞ্চনার স্বরূপ উপলব্ধি করা। তাই নারীবাদী হওয়া তিনি বাঞ্ছনীয় মনে করেন। মনে করেছেন, এ-বিষয়ে কথা হওয়া এবং বলা উচিত।
বুঝলাম, এই ‘বাঞ্ছনীয়’ শব্দটিই আমাকে অনু দুবের কথা মনে করিয়ে দিয়েছে। যেমন তিনি মনে করেছিলেন, প্রতিবাদ করাটা বাঞ্ছনীয়। যেমন কান্নান গোপীনাথান, আবদুর রহমান এই কাঠামোর ভিতর থেকে সরে দাঁড়ানো বাঞ্ছনীয় মনে করেছেন। যেমন অন্ধের মতো থাকতে না-পেরে সি পি চন্দ্রশেখর বা অমিত ভাদুড়িরা তাঁদের প্রতিবাদ নথিবদ্ধ করেছেন সময়ের নোটবুকে। তাঁদের একক প্রতিবাদ কি বৃহত্তর কোনও পরিবর্তন আনতে পারে?
এই একটা প্রশ্ন আমাদের এখনও দ্বিধাজড়িত করে রাখে। এবং অবশ্যম্ভাবী দলমুখী করে তোলে। সেই দলের অঙ্ক কাটাকুটি খেলায় ঢেঁড়া আর শূন্য বসাতে আমাদের হাতে যা তুলে দেয়, তা হল সেই বহুল পরিচিত ‘অর্ডার অফ থিংস’। এখন, এই গুছিয়ে রাখার নিয়মকানুন তো কোনোভাবেই আমাদের কিছু কথা বলতে দেবে না। বা, অন্তত ভাবতেও দেবে না যে, তা ভাবা কিংবা বলে ফেলা জরুরি। এখানেই সবথেকে গুরুত্ব নিয়ে প্রতিভাত হয় অধ্যাপক সেনের ‘বাঞ্ছনীয়’ শব্দটি। অঙ্গাঙ্গীভাবে তার সঙ্গে জড়িত বিচার।
মুক্তচিন্তা ও যুক্তির অনুশীলন; অমর্ত্যবাবু বলছেন, “বিরোধিতা করতে গেলে ঠিক কী বিষয়ে বিরোধিতা করছি তা স্পষ্ট হওয়া একান্তই জরুরি। এবং সেই স্বচ্ছতাই বিরোধিতাকে যুক্তিযুক্ততা দেয়।” এখানে দল নেই, ফলত দলের অবস্থানজনিত দ্বন্দ্বেরও প্রশ্ন নেই। আছে নিজের ভিতরকার অচলায়তনকে প্রশ্ন করে, বিচারকে শাণিত করে কর্তব্য নির্ধারণের শিক্ষা। যা কোনও মতাপেক্ষী ও মুখাপেক্ষী নয়। তবে কি এটাই এই সময়ের এপিস্টিম, যার প্রতি ইঙ্গিত করলেন তিনি?
বর্তমানে, দেশ ও দেশের ধারনার সবথেকে বড়ো ধ্বংসকারী যে কে, তা আমাদের কাছে স্পষ্ট। কিন্তু বিরোধের প্রশ্নে অনেক ‘কিন্তু’ ‘তবু’ ‘ইত্যাদি’ এখনও থেকেই যাচ্ছে। এই প্রেক্ষিতে ক্ষেত্রবিশেষে একাধিকজনকে বলতে শুনেছি, অমুক দলের ইতিহাস তো ধোয়া তুলসীপাতা নয় যে, তার বিরোধিতাকে সানন্দে গ্রহণ করতে পারা সম্ভব। সে-কথা অসঙ্গত নয়। কিন্তু বাঞ্ছনীয়-র উপর জোর দিলে আমরা বুঝতে পারি, আসলে আমাদের কী করা উচিত এবং কেন করা উচিত।
কারও লড়াই করার ন্যারেটিভে শব্দ জোগানো আমাদের দায় ও দায়িত্ব হতে পারে না। বস্তুত সেই গেরোর দরুনই এতদিন এ-দেশের তরুণ প্রজন্মের একটা বড়ো অংশ নিজেদেরকে সক্রিয় প্রতিরোধে প্রায় নিষ্ক্রিয় করে রেখেছিল। এই দায়ভার সরিয়ে দিলেই একটা নৈতিকতার জায়গা খোলা থাকে। যেখানে উজ্জ্বল ওই বাঞ্ছনীয় শব্দটির প্রয়োগ ও বিস্তার।
যদি মনে হয় ‘বড়োরকমের ভুল’ হচ্ছে তবে বিরোধিতা করা বাঞ্ছনীয়। ফলত, এই বিন্দুতে এসে ‘ইগো’র মৃত্যু জরুরি হয়ে উঠছে। একদা হুসেরল্ যে অহংকে গুরুত্ব দিয়েছিলেন অনেকটা, এবং তাঁর মতে, এই অহং-ই মানুষের চৈতন্যকে চালিত করে। ঘটনাচক্রে তাই-ই হতে দেখি আমরা। যদিও সার্ত্রে এই মত খণ্ডন করে স্পষ্টই জানিয়েছিলেন, চৈতন্যের কেন্দ্রে এমন কোনও বস্তু নেই। বরং একটা ঘটনা বা বস্তুই একজনকে চেতন করে তুলতে পারে। সন্দেহ নেই, আমাদের দেশে, অন্তত এখন সেই ধরনের ঘটনারই বাড়বাড়ন্ত। তাই-ই আমাদের চেতন করে তুললে এবং ওই ইগো নামে বস্তুটির অস্তিত্ব ভুলতে পারলে হয়তো আমরা এইখানে বাঞ্ছনীয় শব্দটির স্বরূপ উপলব্ধি করতে পারি। আমরা বুঝতে পারি, কেন অনু দুবে কেঁদেছিলেন। কেন অমিত ভাদুড়িরা সরে দাঁড়াচ্ছেন।
দীর্ঘ পরিকল্পনার অন্তে যে জগদ্দল বর্তমানে সংহত রূপ পেয়েছে, তাকে সরানো যে ইনস্ট্যান্ট আর্টিক্যাল খোলার মতো সহজসাধ্য কাজ, তা নয়। বরং এর জন্যও দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা জরুরি। আর, তার গোড়ায় থাকবে শিক্ষা। কোন দল কী করেছে বা করেছিল, এবং তার বিনিময়ে সে-দলকে কী মূল্য দিতে হবে সেই হিসেবের মধ্যে আমরা যত গিয়ে পড়ি বা পড়তে বাধ্য হই, তত আসলে অর্ডার অফ থিংস-কেই সমর্থন জানিয়ে ফেলি।
‘ও যদি করে থাকে’ তবে ‘এ করলে ভুল কেন’- সে দ্বন্দ্বের পাঁকে না-পড়ে আমরা বরং ভাবতে পারি, আমাদের কী করা বাঞ্ছনীয়। সেইটেই এই সময়ের প্রকৃত বিরোধিতার স্বরূপ। একবার এ-কর্তব্য ঠিক করতে পারলে কী করতে হবে এবং কীভাবে করতে হবে – তা নিয়ে বোধহয় সংশয় থাকে না।
আজ পৌরুষের চূড়ান্ত প্রকাশের বিপ্রতীপে সমস্ত আন্দোলনের নেতৃত্বে যখন মহিলারা, তখন তাঁরা কেবল নারীবাদের হয়ে তো লড়ছেন না। লড়ছেন সামগ্রিক বঞ্চনা ও অন্যায়ের বিরুদ্ধে। যে-কথা বলেছিলেন অধ্যাপক সেন। সেভাবেই কোনটি ‘বাঞ্ছনীয়’, সে বিচার করতে পারলেই সম্ভবত আমরা বুঝতে পারব কোনও দলের হয়ে অন্য কোনও দলের বিরুদ্ধে নয়, আমাদের বিরোধিতা ন্যায় ও ন্যায্যতার পক্ষে, তা ধ্বংসকারীর বিরুদ্ধে।
এর কোনও বিকল্প নেই।
সম্ভবত এটাই সেই অবস্থান, যেখানে সমস্ত দ্বিধার অবসানে এমনকি দলীয়তা অতিক্রম-ও সম্ভব।