নানা ভাষা নানা মত নানা পরিধান।
বিবিধের মাঝে দেখো মিলন মহান।
বৈচিত্রের মধ্যে একতা। এটাই ভারতীয়ত্ব। এটাই এদেশের মূল সুর। এই সুর অনুভব করেছিলেন রবীন্দ্রনাথ। তাঁর লেখা জাতীয় সংগীত একথাই বলে।
এদেশের প্রকৃতি থেকে জনজীবন সর্বত্রই তো এই বৈচিত্র। এই বর্ণময়তা।
পঞ্জাব-সিন্ধু-গুজরাত-মারাঠা-দ্রাবিড়-উৎকল-বঙ্গ/
বিন্ধ্য-হিমাচল-যমুনা-গঙ্গা উচ্ছ্বল জলধিতরঙ্গ।
এক এক রাজ্যের এক এক ভাষা। মাতৃভাষা, যাকে মাতৃদুগ্ধের সঙ্গে তুলনা করা হয়। মায়ের প্রতি সেই আনুগত্য রেখেই তো এতদিন ভারতবাসী একে অপরের সঙ্গে সংযোগ স্থাপন করেছে। দরকার মতো হিন্দি বা ইংরেজি ব্যবহৃত হয়েছে যোগাযোগ মাধ্যম হিসেবে। অসুবিধা তো হয়নি।
হঠাৎ কী হলো? হঠাৎ করে এ কোন ভারতের আত্মকথা? এ কোন ভারতবর্ষের ছবি তুলে ধরার চেষ্টা? কেন হিন্দি ভাষা বাধ্যতামূলক ভাবে শিখতেই হবে? আর তার লক্ষ্যস্বরূপ তুলে ধরা হবে জাতীয় সংহতির মতো স্পর্শকাতর বিষয়কে। হিন্দি দিবসের ঘোষণা। এর পালন ও উদযাপন।
আরও পড়ুন: হিন্দি সাম্রাজ্যবাদ ভারতের সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষের শত্রু
হিন্দি ভাষাই দেশকে একসূত্রে বাঁধতে পারে, এই জাতীয় বক্তব্য। সব মিলিয়ে কেন্দ্রীয় সরকারের ভাষাভিত্তিক এই তুঘলকি ভাবনা, নীতি ও তার প্রণয়ন, নতুন করে দেশ জুড়ে তুমুল বিতর্কের জন্ম দিয়েছে।
হিন্দি শেখাটা অপ্রয়োজনীয় একথা আমরা একবারও বলছি না। এই ভাষার গুণগত মান প্রসঙ্গেও অশ্রদ্ধা পোষণ করার প্রশ্নই নেই। হিন্দি যথেষ্ট জনপ্রিয় ভাষা, তাতেও কোনও সন্দেহ নেই। বলিউড ও হিন্দি টেলিভিশনের কল্যাণে দেশের বিভিন্ন প্রান্তের মানুষ আজকাল কাজ চালানোর মতো হিন্দি বলতে সক্ষম। যাঁরা ভাষা ও সাহিত্যের চর্চা করেন, তাঁরা হয়তো একটু বেশি শুদ্ধতার সঙ্গে হিন্দি ভাষার চর্চা করেন। যাঁরা কাজ চালানোর মতো বলেন, তাঁরা ভুল-ত্রুটি থাকলেও বলার চেষ্টা করেন। অর্থাৎ হিন্দি বলা নিয়ে কারও যে বিশেষ আপত্তি আছে তা নয়।
সেনসাস বলছে, দেশের ৫৭.১ শতাংশ মানুষ কমবেশি হিন্দি জানেন। ৪৩.৬৩ শতাংশ মানুষের মাতৃভাষা হিন্দি (তথ্যসূত্র উইকিপিডিয়া)। এটা ২০১১-র পরিসংখ্যান। প্রতি ১০ বছরে এই গণনা হয়। পরেরটা ২০২১-এ হবে। সংখ্যাটা ইতিমধ্যে বাড়তেই পারে। কাজের প্রয়োজনে হিন্দি শেখাটাই বাঞ্ছনীয়। ২০২১ এলে সঠিক মাত্রাটা বোঝা যাবে। মোদ্দা কথা, হিন্দির গুরুত্ব নিয়ে কারও কোনও সন্দেহ নেই। তাহলে এই জোরাজুরিটা কেন? কেন চাপিয়ে দেওয়া?
সাল ২০১৯। ১৪ সেপ্টেম্বর দিনটিকে হিন্দি দিবস হিসেবে সরকারি ঘোষণা। উপলক্ষ্য, হিন্দি ভাষাই এখন থেকে ভারতবর্ষের 'অফিসিয়াল' ভাষা রূপে স্বীকৃত হলো। অফিসিয়াল অর্থ জাতীয় ভাষা এবং প্রধান ভাষা। কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহের বক্তব্য এ প্রসঙ্গে উল্লেখ্য। তিনি বলেছেন, হিন্দি ভাষাই দেশকে একতাবদ্ধ করতে পারে। সারা বিশ্বের কাছে দেশের প্রতিনিধিত্ব করার জন্য একটি ভাষারই প্রয়োজন, আর তা হলো হিন্দি।
আরও পড়ুন: দুর্গাপূজা অনুদান: আজ না হোক কাল, হিসেব হবেই
প্রধান ভাষা। ফার্স্ট ল্যাঙ্গুয়েজ। এতদিন পর্যন্ত পঠনপাঠনে যার যার মাতৃভাষাই ছিল ফার্স্ট ল্যাঙ্গুয়েজ। মানে যারা নিজেদের মাতৃভাষাকে মাধ্যম করে পড়ছে। অর্থাৎ বাংলা মাধ্যম স্কুলে বাংলা, গুজরাতি বা মারাঠি কিংবা পাঞ্জাবির ক্ষেত্রেও একই ভাবে মাতৃভাষাকে ফার্স্ট ল্যাঙ্গুয়েজ রেখে, হিন্দি ও ইংরেজিকে দ্বিতীয় স্থানে রেখে পড়াশোনা করেছে তারা। অন্যদিকে ইংরেজি মাধ্যমে ইংরেজি ও হিন্দি মাধ্যম স্কুলে হিন্দি ফার্স্ট ল্যাঙ্গুয়েজ রূপে পরিগণিত হয়। সেকেন্ড ল্যাঙ্গুয়েজ ঐচ্ছিক থাকে। সেখানে অধিকাংশ ছাত্রছাত্রীই মাতৃভাষাকে রাখে। এবার থেকে সকলেরই ফার্স্ট ল্যাঙ্গুয়েজ কি হিন্দি? বাকি যা কিছু পরে? অর্থাৎ আর যাই হোক, মাতৃভাষাকে প্রধান করে ইচ্ছে থাকলেও পঠনপাঠন আর সম্ভব হবে না?
লেখাপড়া তো হলো। এবার কাজের দুনিয়া। সব রাজ্যের সব অফিসিয়াল কাজকর্ম এখন থেকে যদি হিন্দিতে হয়, তাহলে আর তো কাজ চালানো হিন্দি জানলে চলবে না। হিন্দি পড়তে ও লিখতে জানতে হবে এবং সেটা অবশ্যই ব্যাকরণ মেনে। মানুষ কটা ভাষার চর্চা ব্যাকরণ মেনে করতে পারে? অবধারিত ভাবে অবহেলিত হবে মাতৃভাষা। এ তো এক ভয়ঙ্কর প্রক্রিয়া। ভাষা তো শুধু কথা বলা নয়। ভাষা তো শুধু ভাব প্রকাশ নয়। ভাষা ও সংস্কৃতি তো মানুষের পরিচয়। সেই পরিচয় হারিয়ে বাঁচা মানে কী ভয়াবহ, তা ভাবতেই তো অন্তরের অন্তঃস্থল শুকিয়ে যায়। এ যে ঘর ছেড়ে পথে নামানোর ষড়যন্ত্র।
৪৩.৬৩ শতাংশ বাদ দিয়ে যাঁরা এদেশের নাগরিক, তাঁদের মাতৃভাষা আর কোনও ভাবেই প্রধান থাকবে না। আজ থেকে কয়েক যুগ পরে ভারতের বহু সমৃদ্ধ ভাষাই হয়তো হারিয়ে যাবে চর্চার অভাবে। ইতিমধ্যেই ইংরেজি মাধ্যমের ধাক্কায় বাঙালির বাংলা চর্চা প্রশ্নের মুখে। তারপর এই নতুন ভাষানীতি নির্ধারণ। বাঙালির ভাষা আন্দোলন, ভাষার জন্য শহীদ হওয়া, সবই অর্থ হারাবে? ২১ ফেব্রুয়ারির আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হিসেবে স্বীকৃতি লাভে আপামর বাঙালির যে গর্ব, তাও কি অভিমুখ হারাবে? এ কথা প্রযোজ্য দেশের অন্যান্য আঞ্চলিক ভাষার ক্ষেত্রেও। মাতৃভাষা নিয়ে আমাদের যে আবেগ, সেখানে খুব বড় এক ধাক্কা নিঃসন্দেহে এই সিদ্ধান্ত।
আরও পড়ুন: জাতীয় শিক্ষা, যুক্তি-অযুক্তি অথবা ‘বিক্রম’-এর সিকিসাফল্য
প্রসঙ্গত, সারা দেশে তো একরকম হলো। ভারতের দক্ষিণের রাজ্যগুলিতে এই সিদ্ধান্ত চাপিয়ে দেওয়া যাবে তো? ওই চার রাজ্য বাধ্যতামূলক ভাবে হিন্দি বর্জন করে চলেছে বরাবর। তামিল, তেলুগু, কন্নড়, মালয়ালম ছাড়া ওঁরা শুধু ইংরেজি বলেন। অনেকে সেটাও বলেন না। হিন্দি না বলার ব্যাপারে রীতিমতো কট্টরপন্থী ওঁরা। যাকে বলে নো কম্প্রোমাইজ। দক্ষিণ ভারত বেড়াতে গেলে এ বাবদ যথেষ্ট ভোগান্তি পোহাতে হয় পর্যটকদের। এমন এক প্রেক্ষিতে ওঁরা কী করেন, ওঁদের ওপরেই বা কী লাগু হয়, তা দেখার অপেক্ষায় থাকবে সারা দেশ।
চাকরি বা ব্যবসার প্রয়োজনে এক রাজ্যের মানুষকে অন্য রাজ্যে যেতেই হয়, যেতে হয় অন্য দেশেও। সেই অনুসারে ছেলেমেয়েদের পড়াশোনা, স্কুল-কলেজ। ভাষা শিক্ষা ও প্রয়োগও সেই পথ ধরেই। এত কিছুর পরও নিজের ভাষা ও সংস্কৃতি ধরে রাখার চেষ্টা করে সকলেই। এ যেন দিনের শেষে ঘরে ফেরার শান্তি ও আরাম। আঘাতটা এল সেখানেই। অথচ এর কোনও দরকারই ছিল না। দেশের মানুষ স্বতঃস্ফূর্ত ভাবেই হিন্দি ভাষাকে আয়ত্তে আনছিলেন। অবশ্যই নিজের স্বাতন্ত্র্য বজায় রেখে। আপন ভাষা ও সংস্কৃতি বাঁচিয়ে। এরমধ্যেই পারস্পরিক সুস্থ ও স্বাভাবিক আদানপ্রদানও চলছিল। জোর করে কিছু মেনে বা মানিয়ে নিতে হলে সেই স্বাচ্ছন্দ্য, সেই স্বাভাবিকতা হারিয়ে যায়।
আজ মনে হয়, রবীন্দ্রনাথ তাহলে ভারতের অন্তরের সুর বুঝতে পারেন নি। তাঁর লেখা জাতীয় সংগীত তাহলে আজ আর প্রাসঙ্গিক নয়। যে সংগীতের পরতে পরতে রয়েছে বৈচিত্রের মহিমার মাঝে একতার মহান বার্তা। এ প্রশ্ন আলোড়িত করছে দেশের তামাম শুভবুদ্ধির শিক্ষিত মানুষকে। প্রত্যাশা এই উপলব্ধি, তামাম দেশবাসীর অন্তরের এই আবেগকে গুরুত্ব দিয়ে বিষয়ের পুনর্বিবেচনা করবেন দেশের মানুষের নির্বাচিত সরকারের প্রতিনিধিরা।