২০ মে-র আমফান সাইক্লোনে সুন্দরবন বদ্বীপ অঞ্চলসহ পশ্চিমবঙ্গের দক্ষিণের জেলাগুলি বিধ্বস্ত। এই সাইক্লোন ওড়িশা ও বাংলাদেশের একাংশেও আঘাত হেনেছে। বঙ্গোপসাগরে যত শক্তিশালী সাইক্লোন এ যাবৎ তৈরি হয়েছে, তার মধ্যে আমফানের মত মাত্রার সাইক্লোন আগে দেখা যায়নি। এই সাইক্লোনের জেরে অন্তত একশোরও বেশি প্রাণহানি হয়েছে এবং বাংলার ৬ কোটির বেশি মানুষ ও ওড়িশার ৪৫ লাখের বেশি মানুষ ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন।
সাইক্লোনের জেরে ঘরবাড়ি উড়ে গিয়েছে, কৃষি উৎপাদন বিনষ্ট হয়েছে এবং পৃথিবীর ইতিহাসে দীর্ঘতম লকডাউনে ক্ষতিগ্রস্ত মানুষের জীবনে আরও বিপর্যয় নেমে এসেছে। কিছু পূর্বতন সমস্যাকে আমফান ফের সামনে এনে দিয়েছে। ইউনেস্কোর সংরক্ষিত পশ্চিমবঙ্গের সুন্দরবন এলাকা এতটাই ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে যে তা আর সংস্কার করা সম্ভব নয়। মাটি থেকে তোলা ছবিতেই দেখা যাচ্ছে নোনা জলে ডুবে যাওয়া দ্বীপ, উপড়ে পড়া ম্যানগ্রোভ অরণ্য, ধুয়ে যাওয়া বাড়ি, পাশাপাশি পড়ে থাকা মৃত মানুষ ও বাঘ।
এ ভয়াবহতা নিয়ে রাজনীতির দিকটিও উপেক্ষা করা যাবে না। কেউ কেউ ভেবেছিলেন, এই সাইক্লোন যেভাবে কেন্দ্র সহ সমস্ত পক্ষের দৃষ্টি আকর্ষণ করেছে, তার ফলে বড়সড় ত্রাণ ঘোষিত হবে। কিন্তু আমফান প্রভাবিত এলাকায় প্রধানমন্ত্রীর আকাশপথে পরিদর্শনের পর মাত্র ১,০০০ কোটি টাকার ত্রাণ প্রকল্প ঘোষিত হয়েছে।
আরও পড়ুন: করোনা-আমফান, এবং বাঙালির আত্মপরিচয়
তৃণমূল কংগ্রেসের রাজ্যসভার সাংসদ দেখিয়েছেন, কেন্দ্রের কাছে আমফানের আগেই রাজ্য সরকার ৫৩ হাজার কোটি টাকা পায়। এর মধ্যে ৩৬ হাজার কোটি টাকা কেন্দ্রীয় প্রকল্পের জন্য, ১১ হাজার কোটি টাকা হস্তান্তর বাবদ, ৩,০০০ কোটি টাকা জিএসটি বাবদ ও ৩,০০০ কোটি টাকা অন্যান্য ক্ষতিপূরণ বাবদ প্রাপ্য। এভাবে টাকা আটকে রাখা, বিশেষ করে এই সংকটের সময়ে, ফেডারেল সম্পর্কের স্পিরিট নষ্ট করতে পারে।
আমফান পরবর্তী সময়ে কেন্দ্র ও রাজ্য সরকার প্যাকেজ ঘোষণা করেছে। খবর অনুসারে রাজ্য সরকারের ত্রাণ কাজে গতি এসেছে, একইসঙ্গে অভিযোগ, ত্রাণ বণ্টনে দুর্নীতির অভিযোগও উঠেছে, তবে মূল চ্যালেঞ্জ হলো অতিমারীর সময়ে ত্রাণ বণ্টনে সমস্যা।
অতিমারীর সময়ে বিভিন্ন ব্যক্তি ও সংস্থার উদ্যোগে কমিউনিটি কিচেন, কমিউনিটি হেলথ কেয়ার সেন্টার গড়ে উঠেছে, যার মাধ্যমে সহায়তা পেয়েছেন দুর্বল ও অসমর্থ মানুষেরা। এই উদ্যোগগুলি মূলত গড়ে উঠেছে সহ নাগরিকদের দেওয়া অর্থে।
আমফানের পর এই অর্থের উৎসগুলি শুকিয়ে যেতে শুরু করেছে, কারণ যাঁরা অর্থ দিচ্ছিলেন, তাঁদের অনেকেই ঘূর্ণিঝড়ে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন, সঙ্গে অতিমারীর জেরে লে-অফ ও বেতন ছাঁটাই তো রয়েইছে। ফলে আমফান পরবর্তী ত্রাণের উদ্যোগে দুটি সমস্যা - এক, পর্যাপ্ত অর্থের অভাব এবং দুই, কলকাতার রেড জোনের বাসিন্দারা সুন্দরবনের অভ্যন্তরে ত্রাণ নিয়ে যাওয়ায় কোভিড সংক্রমণের আশঙ্কাও বাড়ছে। ক্ষতিগ্রস্ত এলাকায় ডাক্তার ও স্বাস্থ্যকর্মীদের নিয়ে চালানো স্বেচ্ছাসেবী মেডিক্যাল ক্যাম্পগুলিতে এবার করোনাভাইরাসের পাশাপাশি সাধারণ ও ক্রনিক রোগের সমস্যাও মেটাতে হচ্ছে।
সাধারণ পরিস্থিতিতে সুন্দরবনের বাসিন্দাদের বড় অংশ ডাঙা ও জলের মধ্যে বিপজ্জনক জীবন কাটান, তাঁদের জীবনে সবসময়েই থাকে বাঘ-সাপ-কুমিরের হানার সম্ভাবনা। বহু বছর ধরে ম্যানগ্রোভ মূল ভূখণ্ডের বাসিন্দাদের সাইক্লোনের হাত থেকে রক্ষা করেছে। বিশেষজ্ঞ ও স্থানীয় বাসিন্দাদের কঠোর আপত্তি সত্ত্বেও বিভিন্ন উন্নয়নমূলক প্রকল্প সুন্দরবনের অরণ্য ও জমি খেয়ে নিয়েছে, যার জেরে ম্যানগ্রোভের রক্ষাকারী ভূমিকাও বিপর্যস্ত হয়েছে।
এর সাম্প্রতিক উদাহরণ বাংলাদেশের সুন্দরবনে রামপাল বিদ্যুৎ স্টেশনের অনুমোদন। ২০০৯ সালে আয়লার পর যেসব বাঁধ তৈরি হয়েছে, তাও ছিল অপর্যাপ্ত। নোনা জল ঢুকে বিশাল এলাকা চাষের অনুপযুক্ত করে ফেলেছে।
স্থানীয়দের এ নিয়ে উদ্বেগের বিষয়ে কর্ণপাত করা হয়নি, এবং কর্ণপাত না করার ফলে আমফান তার ভয়াবহ প্রভাব ফেলেছে। এই বিপর্যয় জাতীয় স্তরে তেমন সাড়া ফেলতে পারেনি।
বিপর্যয় নিয়ে রাজনীতি করার সমালোচনা যথাযথ। কিন্তু বিপর্যয়ের ফলে যাঁরা সর্বাপেক্ষা ক্ষতিগ্রস্ত তাঁদের উদ্বেগের বিষয়গুলিকে সামনে আনা যে কোনও পর্যায়ের নির্বাচিত সরকারের পক্ষে জরুরি। প্রাকৃতিক বিপর্যয়ের রাজনীতিকরণ সরকারের ব্যর্থতাকে সামনে আনে। এ ধরনের ক্ষেত্র থেকে সরকারের রাজনীতি করা তাদের সম্পর্কে অনীহা তৈরি করে ও তাদের বিশ্বাসযোগ্যতা কমায়। প্রাকৃতিক দুর্যোগের সঠিক রাজনীতিকরণ প্রয়োজন।
(লেখক ওপি জিন্দাল ইউনিভার্সিটির ইংরেজি শিক্ষক)
ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেস বাংলা এখন টেলিগ্রামে, পড়তে থাকুন