ঘটনা ১: রমেশ বেহল, একটি বেসরকারি সিকিউরিটি এজেন্সির ডিরেক্টর। ৬৫ বছরের রমেশ নিজের অফিস থেকে বেরিয়ে ভবানীপুরের রমেশ মিত্র রোডের মুখে দাঁড় করানো নিজের গাড়িতে উঠতে যাচ্ছিলেন। বয়স হয়েছে, একটু ধীরেই গাড়ির দিকে এগোচ্ছিলেন রমেশ। তাঁর গাড়িটা এমনভাবে এনে রাস্তার মুখে দাঁড় করিয়েছিলেন ড্রাইভার, যে পিছনে দাঁড়িয়ে থাকা একটা মোটরবাইক এগোতে পারছিল না। কয়েক মিনিট ওই বাইক চালককে অপেক্ষা করতে হয়েছিল, ব্যস এটুকুই। অভিযোগ, ওই বাইক আরোহী প্রচণ্ড রেগে যান, রমেশকে ধাক্কা দেন, থাপ্পড় মারেন। রমেশ আচমকা আঘাতে রাস্তায় পড়ে যান বেকায়দায়। চোট লাগে গুরুতর। হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয়, কিন্তু শেষরক্ষা হয়নি। রমেশকে বাঁচানো যায়নি।
ঘটনা ২: নিজের স্ত্রী এবং বাবাকে পিটিয়ে মেরে ফেললেন এক মধ্যষাটের প্রৌঢ়! মাস দুয়েক আগে এক শুক্রবার রাতের ঘটনা, ট্যাংরা থানা এলাকায়। লি ইয়াং সাং তাঁর ষাট ছুঁইছুঁই স্ত্রীকে সন্দেহ করতেন, ভাবতেন, পরকীয়ায় জড়িয়ে পড়েছেন। সেই রাতে হঠাৎই খুন চেপে যায় মাথায়, পিটিয়ে মারেন স্ত্রীকে। ঘটনা দেখে ফেলেন আশি বছরের বাবা, প্রতিবাদ করেন। রাগে অন্ধ লি ইয়াং বৃদ্ধ বাবাকেও মেরে ফেলেন পিটিয়ে। লি আপাতত পুলিশ হেফাজতে।
ঘটনা ৩: স্ত্রী টুম্পা সোশ্যাল মিডিয়ায় এতটাই আসক্ত যে অফিস থেকে ফিরে ঘরের টুকটাক কাজকর্ম করতে হতো স্বামী সুরজিতকে। হোয়াটস্যাপ-ফেসবুকে এত সময় কাটানো কেন? অন্য পুরুষের সঙ্গে সম্পর্ক তৈরি হয়েছে টুম্পার? সন্দেহ হতো চেতলার বাসিন্দা সুরজিতের। গত বুধবার বিকেলে বাড়ি ফিরে সুরজিত দেখলেন, স্ত্রী সোশ্যাল মিডিয়ায় মজে আছেন। ঘরের কাজ হয়নি কিছুই। তর্কাতর্কি হলো খানিক, এবং ক্রোধে উন্মত্ত হয়ে টুম্পার মাথায় চপার দিয়ে সজোরে আঘাত করলেন সুরজিত। মেরেই ফেললেন স্ত্রীকে! পরের দিন চেতলা থানায় গিয়ে আত্মসমর্পণ করলেন।
আরও পড়ুন: বর্ধমানে ডাক্তার ও তাঁর স্ত্রীর উপর হামলা: গভীর অসুখের বার্তা
এই বছরেই ঘটে যাওয়া কয়েক ডজন ঘটনার মধ্যে তিনটি সাম্প্রতিক উদাহরণ মাত্র, যেখানে দিগ্বিদিক জ্ঞানশূন্য রাগে মানুষ মানুষকে প্রাণে মেরে ফেলেছে, আপাত-অকিঞ্চিৎকর কারণে। এবং আলোচ্য প্রতিটি ঘটনাই ব্যক্তিবিশেষের রাগের পরিণাম, জনরোষ এবং গণপিটুনিতে মৃত্যুর ঘটনা নয় কিন্তু। গণপিটুনিতে মৃত্যু আমাদের সমাজে নতুন কিছু নয়। কিন্তু ব্যক্তির রাগ-রোষে ব্যক্তির বলি হওয়ার এই সাম্প্রতিক প্রবণতা ভয়ের-আশঙ্কার-চিন্তার। জীবন এখন 'রাগপ্রধান'।
অনিয়ন্ত্রিত এবং মাত্রাছাড়া রাগের বহিঃপ্রকাশ যেভাবে মাথাচাড়া দিচ্ছে আমাদের চারপাশে, সেটা গভীর উদ্বেগের। আমরা প্রত্যেকেই ক্রমশ ঢুকে পড়ছি এই লাগামহীন রাগের আবর্তে। হয় নিজে রেগে যাব, নয় অন্যের রাগের শিকার হব, এই সম্ভাব্যতা যেন অনিবার্য হয়ে উঠছে।
ভাবুন বিষয়টা। আপাতদৃষ্টিতে 'স্বাভাবিক' লোকজন এত ভয়ঙ্কর মাত্রায় রেগে যাচ্ছে যে রাগের 'উৎসে' ক্রমাগত আঘাত হেনে সে উৎসকে একেবারে নিশ্চিহ্ন করে দিতে চাইছে। সম্পূর্ণ অপরিচিত কাউকে হয়তো মেরেই ফেলছে, এটা জেনেও যে চরম মূল্য দিতে হবে কৃতকর্মের। এসব দেখে কবীর সুমনের গানের লাইনটা সামান্য বদলে নিতে ইচ্ছে করে, 'কতটা রাগ জমলে তবে মানুষ মারা যায়?'
একটা জরুরি জিনিস এখানে বলার, 'রাগ' মানেই যে খারাপ, এমন অবশ্যই নয়। রাগ একটা প্রতিক্রিয়া, এবং রাগের ইতিবাচক মনস্তাত্ত্বিক দিকটি নিয়ে, সদর্থক সামাজিক দিকটি নিয়ে বিদগ্ধ গবেষণা আছে বহুসংখ্যক। রাগ বহু ক্ষেত্রে উপকারীও বটে। ইতিহাসের মোড়-ঘোরানো আন্দোলনগুলির কথা ভাবুন, প্রতিটির জন্ম হয়েছিল কোনও বিক্ষোভ বা প্রতিবাদকে কেন্দ্র করেই। যে বিক্ষোভ বা প্রতিবাদের নেপথ্যে ছিল একটাই অনুভূতি। রাগ।
আরও পড়ুন: দূষণ রোধে প্রশাসনের সবচেয়ে বড় শত্রু কে? আমি, আপনি, আবার কে?
তবে মুশকিল হলো, আজকের দৈনন্দিন দুনিয়ায় মুদ্রার উল্টো দিকটাই উত্তরোত্তর বেশি প্রকট। রাগের একটা উদ্দীপক চরিত্র আছে। নেতিবাচক অর্থে হয়তো, কিন্তু আছে। এবং যে কোন উদ্দীপক বস্তুর মতো রাগেরও একটা আসক্তি-সম্ভাবনা থাকে। যা রাগকে অভ্যাসে বদলে দেয়, এবং সেই অভ্যাসে অভ্যস্ত আমি-আপনি খুঁজতে থাকি রাগ প্রকাশের নিত্যনতুন অজুহাত। এটাই কি ঘটছে আমাদের সঙ্গে? আমরা কি তাহলে রাগের নেশায় আসক্ত হয়ে পড়ছি, যে আসক্তি আসলে আমাদের রোজকার নানাবিধ সমস্যা থেকে পরিত্রাণের পথ? সামাজিক বৈষম্য থেকে, শ্রেণী-বিভেদ থেকে, অর্থকরী সমস্যা থেকে, বস্তুত দিনগত পাপক্ষয় থেকে মুক্তির রাস্তা? কোথাও গিয়ে একের রাগ অনেকের হয়ে যাচ্ছে নিজেদেরই অজান্তে?
একটু তলিয়ে ভাবলে মনে হয়, ক্রোধের এই সংক্রমণে অন্যতম অনুঘটকের ভূমিকা নিয়েছে সোশ্যাল মিডিয়া। যার ব্যাপ্তি পাশের বাড়ির কোন ঘটনাকে পাড়া-শহর-রাজ্য ছাড়িয়ে দ্রুত নিয়ে যেতে পারে জাতীয় বা এমনকি আন্তর্জাতিক স্তরেও। ব্যক্তির রাগ নিমেষে সোশ্যাল মিডিয়া বদলে দিতে পারে সমষ্টির ক্রোধে। প্রযুক্তি-পরিসরে রাগের এই ক্রমশ চড়তে থাকা পারদ কিন্তু ব্যক্তিগত গণ্ডি ছাড়িয়ে ক্রমশ দূষিত করছে বৃহত্তর সামাজিক আবহকেও।
অবিমিশ্র হিতাহিতজ্ঞানশূন্য রাগের অবধারিত পরিণতি এই সমাজ-দূষণ। ক্রোধের প্রতিটি উগ্র বহিঃপ্রকাশ যেন একে অন্যকে মান্যতা দেওয়ার মতো বিপজ্জনক পর্যায়ে পৌঁছে যাচ্ছে। আমরা ভুলতে বসেছি, 'two wrongs don’t make a right’। একটা ভুল কখনওই অন্য কোনও ভুলকে সমর্থনের কারণ হতে পারে না। যেটা ভুল, সেটা ভুলই।
আরও পড়ুন: ফেসবুক, মি টু, এবং…
আসলে সোশ্যাল মিডিয়ার মধ্যস্থতায় এমন এক প্রযুক্তি-মঞ্চ হাতের মুঠোয় পেয়ে গিয়েছি আমরা, যা আমাদের বল্গাহীন রাগ প্রকাশের লাইসেন্স হতে বসেছে। ডিজিট্যাল দুনিয়ায় রাগ প্রকাশের সদর্থক পরিণতিও ঘটে ক্ষেত্রবিশেষে, অস্বীকার করছি না। কিন্তু সেটা নিয়ম নয়, নিয়মের ব্যতিক্রম মাত্র। রাগ-ঘৃণা-দ্বেষ যেমন খুশি যখন খুশি যার উপর খুশি উপুড় করে দেওয়াটাই নিয়ম হয়ে উঠেছে।
ভুলটা আর কতদিন ধরে করে চলব আমরা? পথের শেষ কোথায়, কী আছে শেষে? সমাধান কোথায়? উত্তর হাতড়াতে গিয়ে সত্যি বলতে দিশেহারাই লাগে খানিক। আর শেষমেষ মনে হয়, স্নায়ু-সংযমই বোধহয় একমাত্ৰ রাস্তা।
পরের বার যখন প্রবল রাগ গ্রাস করবে আপনাকে, ইচ্ছে হবে প্রবলতর প্রক্রিয়ায় তা উগরে দেবার, একটু ভাবুন। কোথায় চলেছি আমরা? এমন এক জীবনধারায়, যেখানে 'রাগের আমি, রাগের তুমি, রাগ দিয়ে যায় চেনা?'