উত্তরপ্রদেশের মুখ্যমন্ত্রী যোগী আদিত্যনাথ ঘোষণা করলেন, এবার উত্তরপ্রদেশের মতো রাজ্য থেকে গুন্ডারাজের সমাপ্তি হল। কারণ? বিকাশ দুবেকে রাজ্যের পুলিশ এক এনকাউন্টারে খতম করে দিতে সক্ষম হয়েছে এজন্য। রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী এ ঘোষণা করেছেন অতএব রাজ্যের মানুষ এ কথাকে ধ্রুব সত্য বলে মেনে নেবেন?
এনকাউন্টার রহস্যে আমি পরে যাব। সে ব্যাপারে অনেকেই অনেক প্রশ্ন তুলেছেন। আমি তার আগে অন্য একটি প্রশ্ন তুলি। যেদিন আটজন পুলিশ কর্মীকে অপরাধীরা হত্যা করেছিল ঠিক সেদিনই ওই রাজ্যেই আরও দুটি ভয়াবহ ঘটনা ঘটে। আট পুলিশের হত্যাকান্ডের জন্য সে ঘটনা দুটি মানুষের দৃষ্টির আড়ালে চলে যায়। প্রথমটি হল ইলাহাবাদে একটি পরিবারের চার জন সদস্যকে নিষ্ঠুর ভাবে হত্যা। দ্বিতীয় ঘটনাটি হল, ১৯ বছরের দলিত মেয়ে ও তার বাবাকে এক স্টকার (Stalker) হত্যা করল। মেয়েটির বিয়ে হওয়ার কথা ছিল তার পরদিন।
এগুলো বিচ্ছিন্ন ঘটনা নয়। বরং গোটা রাজ্য এমনকি এ দেশে যে ভয়াবহ অপরাধ জগৎ তা যে কীভাবে সক্রিয় তারই দৃষ্টান্ত এ ধরনের ঘটনা। উত্তরপ্রদেশে আজ নয় বহু বছর ধরেই ঘটেছে এমন ঘটনা এবং আজও তা হয়ে চলেছে। রাজীব গান্ধী যখন প্রধানমন্ত্রী তখন আমি লখনউতে মুখ্যমন্ত্রীর কুর্সিতে নারায়ণ দত্ত তিওয়ারিকে দেখেছি। চোখে কালো সুরমা লাগাতেন। কাছে গেলেই ওঁর শরীর থেকে ভেসে আসত লখনউ আতরের সুবাস। সেদিনও এ রাজ্যকে গুন্ডারাজ বলা হত। পরে মুলায়ম সিংহ যাদব অথবা মায়াবতীর রাজত্বেও দেখেছি কীভাবে চলে গুন্ডারাজ। রাজনৈতিক নেতাদের পৃষ্ঠপোষকতাতেই এরা কীভাবে দাপটের সঙ্গে রাজত্ব চালায়, আমার মত বহু সাংবাদিকই তার সাক্ষী। রাজা ভাইয়া বলে এক নেতা মুলায়মের ডান হাত ছিলেন একদা। যখনই লখনউ যেতাম তা হজরতগঞ্জের কফি হাউসই হোক আর লখনউ প্রেসক্লাব, ওকে নিয়ে নানা রকম গল্প শুনতাম। সেসব ভয়াবহ গুজব। তিনি মন্ত্রী কিন্তু তিনি নাকি ভয়ানক ব্যক্তিত্ব। তার খামার বাড়িতে নাকি এক বিরাট গোপন সরোবর সেখানে নাকি আছে তার পোষা কয়েকটা কুমীর। আর কেউ ওর বিরোধিতা করলেই নাকি তারা নিখোঁজ হয়ে যায়। আসলে তারা কুমিরের পেটে চলে যায়। একবার তো বিধানসভায় ওকেই সাংবাদিকরা রসিকতার ছলে এসব প্রশ্ন করেছিল। তা সেসব কথা তিনি হেসে উড়িয়ে দিয়ে বলেন, 'এতো গব্বর সিংয়ের গপ্পোর মত। শো যাও বেটা নেহিতো গব্বর আ জায়েগা।'
আরও পড়ুন, বাজার হোক বা সীমান্ত, চিনা রণকৌশল থাকবে অব্যাহত
ওকে দেখতে কিন্তু দাবাং-টাইপ ছিল না। রোগাসোগা। কপালে লাল টিপ। এরকম চরিত্র শুধু উত্তরপ্রদেশ নয়, বিহারেও আছে। পাপ্পু যাদব সাংঘাতিক জেলখাটা আসামী কিন্তু লালুর চেলা হয়ে সংসদের সদস্য পর্যন্ত হয়েছিলেন। মধ্যপ্রদেশ বা রাজস্থানের মত হিন্দি বলয়ের রাজ্য এমনকি হরিয়ানা অথবা পাঞ্জাবও কম যায় না।
সমস্যা হচ্ছে, উত্তরপ্রদেশ বা বিহারে এই অপরাধ বৃত্তি ও রাজনীতি যেমন মিলেমিশে আছে, ঠিক সেভাবে জাতপাত ও ধর্মীয় মেরুকরণের রাজনীতিও এর সঙ্গে যুক্ত হয়ে গেছে। যেমন গুন্ডার সর্দারটি যদি ঠাকুর হয় তবে সে দলিত বিরোধী কার্যকলাপে মদত দেবে ও তাতে ঠাকুর রাজনীতির রাঘব বোয়ালদের প্রোটেকশন সে পাবে। আবার যদি এই গ্যাংস্টারটি দলিত বা নিম্নবর্গের হয় তবে মায়াবতীই হন বা আধুনিক দলিত নেতা চন্দ্রশেখরই হন, তাকে প্রশ্রয় দেবেন নিজের স্বার্থে। যাদব দাদা তা সে কানপুরওয়ালাই হোক আর এটোয়াওয়ালা, সে তো আসলে উত্তরপ্রদেশের লাঠিওয়ালা।
জাতীয় ন্যাশনাল ক্রাইম রেকর্ডস ব্যুরোর ২০১৮ সালের তথ্য অনুসারে, মেয়েদের ওপর অত্যাচারে উত্তরপ্রদেশ প্রথম (৫৯,৪৪৫ টি ঘটনা)। ২০১৭ সালের চেয়ে শতকরা সাত ভাগ বৃদ্ধি। গ্যাংরেপও এ রাজ্য প্রথম। আর সাধারণ ধর্ষণে এদেশে দ্বিতীয়। পণের জন্য হত্যা, শিশুদের অপরাধ সবই এরাজ্যে ভয়াবহ ভাবে বেড়েছে।
সমস্যা হচ্ছে মানুষ স্থানীয় মিডিয়া বা চ্যানেলগুলি দেখে এই অপরাধ সম্পর্কে ঠিক কী ধারণা উপলব্ধি করেছে সেখানে। তাদের কিন্তু মনে হচ্ছে আগের চেয়ে বোধহয় পরিস্থিতিটা উন্নত হচ্ছে। কারণ প্রায় প্রতিটি চ্যানেল ও সংবাদ মাধ্যম তা দেখাচ্ছে। মার্কিন লেখক ওয়ালটার লিপম্যান বলেছেন, বাইরের পৃথিবীতে আসলে কী হচ্ছে সে বাস্তবটা অনেকটাই কম গুরুত্বপূর্ণ হয়ে গেছে। আমরা আমাদের মস্তিষ্কে কী ধারণা তৈরি করছি সেটাই আমাদের কাছে চরম সত্য। কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের বিশেষ অধ্যাপক দীপঙ্কর সিনহা একই কথা বলেছেন, 'Mediatized গণতন্ত্র'।
আরও পড়ুন: মধ্য এশিয়ায় চিনের সীমান্ত নীতি থেকে শিক্ষা নিতে পারে ভারত
অপরাধ সম্পর্কে তাই media narrative- কে আমজনতা অনেকটাই গ্ৰহণ করছে। বাস্তবটা তাহলে কী? শতকরা ৩৩ ভাগ সদস্য ক্রিমিনাল কেসে অভিযুক্ত। শতকরা ৮৩ ভাগ হল কোটিপতি। অ্যাসোসিয়েশন ফর ডেমোক্রাটিক রিফর্ম (ADR)-এর দেওয়া রিপোর্ট এ তথ্য দিচ্ছে। চলতি লোকসভায় ৫২১ জন সদস্যের মধ্যে ১৭৪ জনের (৩৩ভাগ) বিরুদ্ধে ক্রিমিনাল কেস আছে। ২০১৪ সালের লোকসভায় এটি ছিল শতকরা ২০ ভাগ। ১০৬ জন। এই ক্রিমিনাল কেসগুলির মধ্যে আছে হত্যা, সাম্রতিক হিংসা, কিডন্যাপ এমনকি মেয়েদের বিরুদ্ধে অপরাধ। কিন্তু মানুষ এদের ভোট দিয়ে জিতিয়েও এনেছে। ৫৪৩ জন যে হলফনামা জমা দিয়েছেন তার ভিত্তিতেই এই সমীক্ষা করা হয়। খুনের ঘটনায় জড়িত ১০ জনের মধ্যে ৪ জন শাসক দল বিজেপির। একজন করে কংগ্রেস, এনসিপি, লোক জনশক্তি পার্টি, রাষ্ট্রীয় জনতা দল ও একজন নির্দল। হত্যার চেষ্টার মামলা আছে ১৪ জনের বিরুদ্ধে। তাতে আটজন বিজেপির। বাকি আছে কংগ্রেস, NCP, RJD, শিবসেনা ইত্যাদি। সাম্রদায়িক সংঘর্ষের ঘটনায় যে ১৪জন সদস্যর বিরুদ্ধে অভিযোগ, তার মধ্যে ১০ জনই বিজেপির।
আসলে আজ একজন বিকাশ দুবের হত্যাকান্ড নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। যে বিকাশ খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে হাঁটে সে পালানোর চেষ্টা করল কী ভাবে ? এই হত্যাকাণ্ড নিয়ে কংগ্রেস-মায়াবতী এবং অখিলেশ সিং যাদব তদন্ত দাবি করেছে। জানি না এ ঘটনার তদন্তে নরেন্দ্র মোদী রাজি হবেন কিনা শেষ পর্যন্ত। কিন্তু এটুকু বলতে পারি উত্তরপ্রদেশের মাফিয়া ও এই অপরাধ জগৎ অতীতেও রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠানের অঙ্গ ছিল। আজও এটা আসলে শুধু উত্তরপ্রদেশের ঘটনা নয় সমগ্ৰ দেশের জলন্ত বিষয়। শরদ পাওয়ারের সঙ্গে দাউদ ইব্রাহিম এবং মুম্বাইয়ের অপরাধ জগতের সম্পর্ক নিয়ে একদা শিবসেনা সোচ্চার ছিল। আবার বালাসাহেব ঠাকরের বিরুদ্ধেও একই অভিযোগ ছিল। 'সরকার' নামে ছবিটি তো অমিতাভ বচ্চন গডফাদারের আদলে একটা নয় পরপর তিনটি সিরিয়াল করেছেন। মানুষ তা বিনোদন হিসেবে গ্ৰহণ করেছে।
মুম্বাই বিষ্ফোরণের পর মহারাষ্ট্র বিধানসভায় রাজনীতিক ও অপরাধী সম্পর্ক নিয়ে কম হৈ চৈ হয়নি। এসবি চবণ তখন কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী। পাওয়ার বিরোধী এই কংগ্রেস নেতা মুম্বাইয়ের অপরাধ ও রাজনীতির যোগ সাজশ নিয়ে তদন্তের জন্য ভোরা কমিটি তৈরি করেন। সে কমিটি একটি
রিপোর্টও জমা দেয় চবণকে। আপনি কি জানেন সে রিপোর্টটি আজও গোপন। এটি আজও সংসদে পেশ করা হয়নি ! কেন হয়নি বলুন তো !
ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেস বাংলা এখন টেলিগ্রামে, পড়তে থাকুন