ঠিকই চিনেছেন আমাদের বিচক্ষণ প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র দামোদর মোদী। জামা কাপড় সাজসজ্জা দেখেই তিনি বুঝতে পেরেছেন গোটা দেশজুড়ে কারা ‘গণ্ডগোল’ করছে। তিনি বুঝে ফেলেছেন এনআরসি, সিএএ বানচাল করতে কারা নেমেছে রাস্তায়। টিভির পর্দায় চলমান ছবি আর খবরের কাগজে রঙিন স্থিরচিত্র দেখেই প্রধানমন্ত্রী বুঝে নিয়েছেন, তারা মুসলমান।
ঝাড়খণ্ডে এক নির্বাচনী সভায় মোদী বলেছিলেন, ‘আগুন কারা লাগাচ্ছে, সেটা তাদের পোশাক দেখলেই চেনা যায়।’ তিনি বলেন, ‘আমার ভাই ও বোনেরা, এই যে দেশে আগুন লাগানো হচ্ছে, টেলিভিশনে যে সব ছবি আসছে সেগুলো কি আপনারা দেখেছেন? আগুন কারা লাগাচ্ছে, সেটা কিন্তু তাদের পোশাক দেখলেই চিনতে পারা যায়!’ কংগ্রেসের মতো বিরোধী দলগুলো এতে উসকানি দিচ্ছে বলেও প্রধানমন্ত্রী অভিযোগ করেন। বিরোধীরা অবশ্য প্রধানমন্ত্রীর এই মন্তব্যকে একটি বিশেষ ধর্মের মানুষের প্রতি সাম্প্রদায়িক আক্রমণ হিসেবেই চিহ্নিত করছেন।
বিজেপির হিন্দু উদ্বাস্তু প্রেম একটি ব্রাহ্মণ্যবাদী রাষ্ট্রীয় মিথ্যাচার
এনআরসি, সিএএ বিরোধী আন্দোলন খুব স্বাভাবিক কারণেই পছন্দ নয় নরেন্দ্র মোদীর। তার ওপর সেই প্রতিবাদ যদি হয় মুসলমানদের। তবে তাঁর বা অন্য কারও পছন্দ হোক বা না হোক, এ কথাটা সত্যি যে এটা তো মুসলমানদেরই লড়াই। এ লড়াই তাঁদেরই লড়তে হবে। মুসলমানরাই লড়ছেন। দেওয়ালের লেখা সঠিকভাবে পড়ে ভারতীয় মুসলমানরা আজ নিজের প্রতিবাদ নিজে করার সংকল্প নিয়ে পথে বেরিয়েছেন। তাঁদের অধিকার রক্ষার লড়াইটা অন্য কেউ লড়ে দেবে, সেই ভরসায় আর বসে নেই মুসলমান।
১৯৯২ সালে বাবরি মসজিদ ধ্বংসের পর থেকে কোনও কিছুতেই মুসলমান যেন নিস্পৃহতা কাটছিল না। মুসলমানের বিরুদ্ধে যাবতীয় অন্যায়ের প্রতিবাদ করার দায় যেন উদার ধর্মনিরপেক্ষ হিন্দুদের। তেমনটাই চলে আসছিল। মুম্বই আর গুজরাটের ভয়াবহ দাঙ্গা, তারও পরে উত্তর প্রদেশের পর পর ঘটে যাওয়া মুসলমান নিধনের ঘটনাগুলোর পরেও তেমন করে প্রতিবাদ করেনি মুসলমান। এমনকী ভেঙে গুঁড়িয়ে দেওয়া বাবরি মসজিদের ওপর রাম মন্দির নির্মাণের যে নির্দেশ সুপ্রিম কোর্ট দিল, তার বিরুদ্ধেও কোনও সোচ্চার প্রতিবাদ মুসলমানদের তরফ থেকে চোখে পড়েনি। গোরক্ষার নামে তুচ্ছ কারণে একটার পর একটা গণপিটুনির ঘটনা ঘটেছে। তারও প্রতিবাদ করেনি মুসলমান। বিজেপি নেতারা দিনের পর দিন মুসলিম বিরোধী মন্তব্য করে চলেছেন। এবং নিশ্চিতভাবেই তাতে দলের ওপর মহলের অনুমোদন থাকে। তারও কোনও প্রতিবাদ হয়নি।
বিদ্বেষ-আদর্শ আর নতুন ভারত, এই লড়াই এখন মুখোমুখি
প্রতিবাদ যা হয়েছে সবই ভারতের উদার হিন্দু বা ধর্মহীন ব্যক্তি বা সংগঠনের উদ্যোগে। ভারতীয় মুসলমান যেন ভুলতে বসেছিল প্রতিবাদের ভাষা। অথচ গত কয়েক বছরে বিভিন্ন সময়ে মুসলমানদের ঠেলতে ঠেলতে খাদের কানায় নিয়ে গিয়ে দাঁড় করিয়েছে কেন্দ্রের বিজেপি সরকার। হয় তাকে প্রবল শক্তিতে নিজের ক্ষমতায় নিরাপদ জায়গায় ফিরতে হবে নয়তো খাদে পড়ে মরতে হবে। এমন একটা জায়গায় পৌঁছে তার প্রতিবাদে গর্জে ওঠা ছাড়া উপায় ছিল না। এই প্রতিবাদ দেখে কেবল বিজেপি নেতা মন্ত্রীরা নন, বহু সাধারণ মানুষও বলতে শুরু করেছে, নতুন সংশোধিত নাগরিকত্ব আইনে বা এনআরসিতে মুসলমাদের উল্লেখ পর্যন্ত নেই, ‘ওদের’ এত ভয় পাওয়ার কী হয়েছে?
কী আশ্চর্য! নতুন সংশোধিত নাগরিকত্ব আইন বা নাগরিকপঞ্জীর পরিণাম জানার পরেও যদি কেউ ভয় না পায় তাহলে তাঁর বোধ-বুদ্ধির বিকাশ বা মনুষ্যত্ব নিয়ে প্রশ্ন উঠবে। প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী বা কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহ যতই বলুন, নতুন সংশোধিত নাগরিকত্ব আইন বা জাতীয় নাগরিকপঞ্জী মুসলমানদের লক্ষ্য করে করা হয়নি, সে আশ্বাস কোনও যুক্তিতেই ধোপে টেঁকে না। কারণ অমিত শাহ স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী হওয়ার পর থেকেই বলে চলেছেন, গোটা দেশেই এনআরসি হবে। এ দিকে, নতুন নাগরিকত্ব আইনে ভারতে এই প্রথম নাগরিকত্বের সঙ্গে ধর্মকে জুড়ে দেওয়া হয়েছে। এবং তা করা হয়েছে ভারতের সংবিধানের মৌল শর্তগুলো অস্বীকার করে। এবং সেই আইনে কোথাও মুসলমান নেই। সরকারের যুক্তি, প্রতিবেশী তিনটি মুসলিমপ্রধান দেশ থেকে ধর্মীয় কারণে নির্যাতনের শিকার হয়ে হিন্দু, বৌদ্ধ, খ্রিস্টান, শিখ, জৈন এবং পারশিরা শরণার্থী হয়ে ভারতে চলে এলে তাদের নাগরিকত্ব দেওয়া হবে। এই আইনের সুরক্ষা পাবে কেবল অমুসলমানেরাই। তাতে মুসলমানদের তো কোনও ক্ষতি হবে না!
ঋত্বিকের ছবিতে উদ্বাস্তুরা কি কেবলই হিন্দু?
অথচ এটা এখন জলের মতো পরিস্কার যে, জাতীয় পঞ্জিকরণ বা এনআরসি প্রক্রিয়ায় কোনও মুসলমান যদি বাদ পড়ে যান তাহলে তাঁকে ভারতীয় নাগরিক প্রমাণ করার জন্য যেতে হবে বিদেশি ট্রাইবুনালে। কোনও হিন্দু যদি এনআরসি তালিকা থেকে বাদ পড়েন তাহলে নতুন সংশোধিত নাগরিকত্ব আইনের সাহায্য নেওয়ার সুযোগ তাঁর থাকছে। নতুন এই আইনের মধ্যে দিয়ে বিজেপি সরকার মুসলমানকে আরও ‘অপর’ করে দেওয়ার প্রক্রিয়া শুরু করল বলে মনে করছেন অনেকে। দেশের মূলস্রোত থেকে মুসলমানকে বিয়োজনের এ কৌশল চিনতে কারও অসুবিধা হওয়ার কথা নয়। মুসলমানের আতঙ্কটা সেখানেই।
তাছাড়া মুসলমানের নামের হেরফেরে, সম্পত্তির উত্তরাধিকারের জটিলতায় কিংবা জন্মপ্রমাণ দাখিল করার টানাপোড়েনে তাঁদের বাদ দেওয়ার কিংবা বাতিল করে দেওয়ার চক্রান্ত এই জাতীয় পঞ্জিকরণ বা এনআরসি। আর তার আগের ধাপ হল নতুন সংশোধিত লাগরিকত্ব আইন। একই দেশে একসঙ্গে গায়ে গা লাগিয়ে হাজার বছর ধরে বাস করার পরে যদি স্রেফ ধর্মের কারণে রাষ্ট্র কাউকে ‘আলাদা’ করে দেওয়ার জন্য আইন প্রণয়ন করে তবে তো শঙ্কার কারণ থাকবেই। যেমন অসমে এনআরসি থেকে ১৯ লক্ষ মানুষের নাম বাদ পড়েছে। তাঁদের মধ্যে যাঁরা হিন্দু, নতুন লাগরিকত্ব আইন তাদের নাগরিকত্ব দেওয়ার একটা সুযোগ করে দিচ্ছে। কিন্তু মুসলমানরা সেই সুযোগ থেকে বঞ্চিত। এছাড়া যারা এনআরসি থেকে বাদ পড়া এবং নতুন নাগরিকত্ব আইনের প্রসাদ না-পাওয়াদের জন্য ডিটেনশন ক্যাম্প প্রস্তুত রয়েছে বা নতুন নতুন আরও শিবির তৈরি হচ্ছে। অসমে ইতিমধ্যে ছ’টি ডিটেনশন ক্যাম্প রয়েছে বিভিন্ন জেলখানার সঙ্গে। এছাড়া গোয়ালপাড়ায় একটা ক্যাম্প তৈরি হচ্ছে যেটা আয়তনে সাতটা ফুটবল মাঠের সমান। মুম্বই আর বাঙ্গালুরুতেও ওই রকম ডিটেনশন ক্যাম্প তৈরি করা হয়েছে। ডিটেনশন ক্যাম্পের আতঙ্কও মুসলমানদের তাড়া করছে। অথচ প্রধানমন্ত্রী জনসভায় দাঁড়িয়ে বলছেন, দেশে কোনও ডিটেনশন ক্যাম্প নেই।
এর প্রতিবাদে তো মুসলমানকেই পথে নামতে হবে। এটা একান্ত ভাবে তার লড়াই। তার হয়ে কে করে দেবে প্রতিবাদ? আবার মুসলমান পথে নেমে প্রতিবাদ করলে তাকে সাম্প্রদায়িক বলতেও কারও কারও অসুবিধা হচ্ছে না। বিজেপির এক নেতা তো গুজরাতে সংখ্যাগরিষ্ঠের প্রতিক্রিয়া কী সাংঘাতিক হতে পারে তাও মনে করিয়ে দিয়েছেন। এই ধরনের শাসানি চলছেই।
নাগরিকত্ব বিতর্ক ও রামরাজ্যে গণভোট
উত্তরপ্রদেশে প্রতিবাদকারীদের ধরে ধরে চিহ্নিত করে তাদের সম্পত্তি বাজেয়াপ্ত করা হচ্ছে। জামিয়া মিলিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ে লাইব্রেরিতে ঢুকে পুলিশ যেভাবে পাঠরত ছাত্রছাত্রী পিটিয়েছে তা বহুদিনের পুষে রাখা আক্রোশ ছাড়া বোধহয় সম্ভব নয়। তারপরেও প্রতিবাদ হচ্ছে, মিছিল হচ্ছে। প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী ‘সবকা সাথ সবকা বিকাশ’ বললেও গণপিটুনিতে মুসলমানদের খুন হয়ে যাওয়া থেমে থাকেনি। এই সব হত্যা নিয়ে মোদীজিকে বিশেষ উদ্বিগ্ন হতেও দেখা যায়নি। মোদী বলছেন, কাউকে দেশের বাইতে বের করে দেওয়া হবে না।
প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী বা কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহ— দুজনে পরস্পর বিরোধী বিবৃতি দিয়ে চলেছেন। অমিত শাহ প্রায় প্রতিদিন বলেছেন, গোটা দেশে এনআরসি হবে। কোনও অবৈধ নাগরিককে দেশে রাখা হবে না। কোথাও বলেছেন, ‘হিন্দু বৌদ্ধ আর শিখ ছাড়া যে কোনও অনুপ্রবেশকারীকে দেশ থেকে বের করে দেওয়া হবে’। আবার কয়েক দিন আগে এক সাক্ষাৎকারে অমিত শাহই বলেছেন, কোনও ভারতীয় নাগরিকের ভয় পাওয়ার কারণ নেই। কাউকে দেশ থেকে বের করে দেওয়া হবে না। কার কোন কথায় বিশ্বাস করবে মানুষ। কার ওপর আস্থা রাখবে সে?
এই সব আইনি প্রক্রিয়ার মধ্যে দিয়ে মুসলমানকে এ দেশে দ্বিতীয় শ্রেণীর নাগরিক করে রাখতে চায় বিজেপি— এমন আশঙ্কা অনেকেই করছেন। হিন্দু রাষ্ট্রের লক্ষ্য পুরণের এটাই প্রথম পদক্ষেপ। তারও দরকার নেই— মুসলমানকে স্রেফ অনিশ্চয়তা আর আতঙ্কের মধ্যে রেখে দিতে পারলেই বিজেপি এবং তার নাটের গুরু আরএসএসের উদ্দেশ্য সাধিত হবে। সেই কাজটাই শুরু হয়েছে দেশে।
পড়তে ভুলবেন না, সত্যের খাতিরে: এনআরসি-র কথা মোদী অস্বীকার করলেও অমিত শাহরা কিন্তু প্রমাণ রেখে গিয়েছেন
(মিলন দত্ত বরিষ্ঠ সাংবাদিক ও বাংলার হিন্দু-মুসলমান সম্পর্ক বিষয়ে বিশেষজ্ঞ। মতামত ব্যক্তিগত)