হেন লোক নেই যার মুখে ওয়াগনারের অপেরার বন্দনা নেই। গোটা দেশ একরকমই উত্তাল বলা যায়। শুধু নিৎসে একা, কেবল একা বন্ধু ও গুরুর বিরুদ্ধাচারণ করে চলেছেন। আর বিক্ষত, রক্তাক্ত হচ্ছেন ক্রমাগত। একদিন দেখা হল এক রেস্তরাঁয়। অনেক কথা হল। নিৎসে ভাল করে বুঝে নিলেন ওয়াগনারের শিল্প নিয়ে ধারণা, খ্রিস্ট ধর্ম নিয়ে তাঁর জীবনের পরিকল্পনার কথা। কোনওকিছুর সঙ্গেই তিনি সহমত নন। ফলত দুই পথ দুদিকে বেঁকে গেল অবধারিতভাবেই। কষ্ট পেলেন নিৎসে। এতটা কষ্ট পেলেন যে, ফিরে গিয়ে ডায়রিতে লিখলেন, একা তিনিই কি আমাকে দিয়ে গেলেন শোকার্ত হওয়ার শাপ!
যে কোনও বিরোধিতা করতে গেলে এই শোকার্ত হওয়ার শাপ ধারণ করার জন্য নিজেকে তৈরি করতে হয়। তার জন্য অনুশীলন প্রয়োজন। এ পর্যায়ে না গেলে সমস্ত সমালোচনা এবং বিরোধিতাই স্রেফ খেউড়ে পরিণত হয় শেষমেশ।
সম্প্রতি সিনেমা সমালোচনা নিয়ে ফেসবুকের পক্ষ-প্রতিপক্ষের অমৃতলাভের লড়াই দেখে এই পুরনো গল্প মনে পড়ল। আমাদের কিন্তু মনে রাখতে হবে যে, এই নিৎসেও জীবনের শেষ পর্বে স্বীকার করে গিয়েছিলেন যে, ওয়াগনারকেই তিনি জীবনে সবথেকে বেশি ভালবাসতেন। আর আমাদের সত্যজিৎ রায়ও ভ্রান্ত সমালোচনার জেরে একদা খেপে উঠে সরাসরি যা লিখেছিলেন তার মর্মার্থ এই, পয়সা থাকলেই যে কেউ সিনেমা দেখতে পারে। কিন্তু তাই বলে যে কেউ সিনেমা নিয়ে লিখতে চাইলে যা মুশকিল হওয়ার তা-ই হয়। এখন যে কেউ মানে নিশ্চিতই সিনেমাদীক্ষিত নন এমন কাউকেই বোঝানো হচ্ছে। তার জন্য সিনেমা বানানোর প্রয়োজন অবশ্যই নেই। কিন্তু সিনেমা নিয়ে সমালোচনা করার অধিকার নিশ্চিতই অর্জন করতে হয়। যেমন, রাগসঙ্গীত নিয়ে কথা বলতে গেলে বা স্টিফেন হকিং কিংবা অমর্ত্য সেনকে সমালোচনা করতে গেলে তা করার যোগ্যতা দরকার। কবিতার ক্ষেত্রে যেমন দীক্ষিত পাঠকের কথা বারবার উঠে আসে। এই দীক্ষিত পাঠকের অভাবেই স্নেহাকর ভট্টাচার্য বা শম্ভু রক্ষিতরা কবিতা-পছন্দের সিন্থেটিক ঝলমলে পৃথিবী থেকে ক্রমশ সরে যেতে থাকেন। এবং বাংলা কবিতার ইতিহাস একটা খাপছাড়া বর্ণময় বাগানে রূপান্তরিত হয় মাত্র। সুতরাং যে কোনও শিল্পমাধ্যমেই সমালোচনার জন্য অধিকার বা যোগ্যতা প্রয়োজন। সিনেমা তার ব্যতিক্রম নয়। কিন্তু সিনেমার সঙ্গে যেহেতু অর্থের সরাসরি যোগাযোগ, তাই এই ক্ষেত্রেই এই ভ্রান্তি ও ব্যর্থতার ইতিহাস সবথেকে বেশি। ফলত এই ধরনের পরিস্থিতির বারবার উদ্ভব হয়, যেমনটা এখন হয়েছে।
আরও পড়ুন, প্রাচীন এক ভ্রমণকাহিনির রসাস্বাদন
না, খুব উচ্চমানের সিনেমা যে হচ্ছে না সে কথা অনস্বীকার্য। পাশাপাশি প্রশ্ন উঠবে উচ্চমানের সমালোচনাও হচ্ছে কি? ফেসবুকের চণ্ডীমণ্ডপে খেউড় জাতীয় রচনায় ‘Love’ পড়ে বেশি, কিন্তু লাভের গুড় পিপড়ে খায়, এও চিরসত্য। তথাকথিত প্রাতিষ্ঠানিক রিভিউ অনেকটাই অন্ধের হস্তিদর্শনের মতো। অথবা স্রেফ চেপে যাওয়া। তার অনেক বাধ্যবাধকতাও যে আছে, সে তো সকলেরই জানা। সোশ্যাল মিডিয়া এসে এই মুক্তাঙ্গন তৈরি করেছিল। যেখানে সুস্থ সমালোচনা করা যেতে পারত। এক সময় তা হতও। কিন্তু কালে কালে তা হাততালি কুড়োতে কুড়োতে কেবলই ও সকলই খেউড় হয়ে উঠল। তাতে এ ওকে কামড়ানো হল, ও তার পিঠ চাপড়ানির কম্মোটি সারা হল বটে, কিন্তু কার কী লাভ হল? যে মুক্ত প্ল্যাটফর্ম করায়ত্ত ছিল তা আসলে বাইরে চলে গেল। প্রাতিষ্ঠানিক সমালোচনা ‘পক্ষপাতদুষ্ট’ আর সোশ্যাল মিডিয়ায় ‘খেউড়মূলক’, এই সমীকরণের ভিতরে দাঁড়িয়ে সত্যিকারের সিনেমা ও সিনেমা আলোচনা দুই-ই মার যে খেল, এ কথা কি অস্বীকার করা যায়? এ তো সেই লীলাময়ী করপুটে সকলই ঝরে গেল, ভালবাসা দিতে পারলেও কেউ গ্রহণে সক্ষম কি না সে প্রশ্নের উঠে আসা। যে সোশ্যাল মিডিয়া শাহবাগ থেকে মেডিক্যাল কলেজ হয়ে ‘মিটু’ ঝড়ের জন্ম দিতে পারে, সে খামোখা খেউড় করে কালক্ষয় করবে কেন? কেন গুরুত্ব হারাবে!
সিনেমা ভাল না লাগলে একশোবার তা বলার অধিকার থাকে, যেহেতু এখানে উপভোক্তার অর্থ সরাসরি জড়িত। কিন্তু কী বলা হচ্ছে এবং কীভাবে বলা হচ্ছে তাও বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ বইকি। নিৎসে যদি সেদিন কোমর বেঁধে খেউড় আর মিম তৈরি করতে লাগতেন, বলা বাহুল্য তিনি নিৎসে হতেন না। আবার এই খেউড়সম্প্রদায়ের গুরুঠাকুরগণ যদি সত্যিই শোকার্ত হওয়ার শাপ বুকে পেতে নিতেন, তবে হয়তো নতুন সৃষ্টির পথ খুলে যেত। যেভাবে প্রতিকূলতা মেনেও অনেকে চুপচাপ ভাল কাজ করছেন বা অন্তত করার চেষ্টাটুকু করছেন। প্রতিষ্ঠানের কুলঠাকুরগণ বাধ্য হছেন সেই সব কাজকে স্বীকৃতি দিতে। জয়টা এভাবেই হওয়ার ছিল, এবং তা ধীরে ধীরে হাসিল হচ্ছেও। কিন্তু মজা হচ্ছে, এই সব সিনেমা বা সিনেমার নীরিক্ষা ভাল ব্যবসা করতে পারে না, বহু ক্ষেত্রেই এই পরিসংখ্যান সামনে আসে। তাহলে এই তথাকথিত ভাল সিনেমার সমঝদারের তখন থাকেন কোথায়, এ প্রশ্ন তো আর অমূলক থাকছে না।
একই কথা কবিতা, বই পড়া বা গান শোনার ক্ষেত্রেও খাটে। কিছু হচ্ছে না, কী বাজেই না হচ্ছে- এই ধরনের মন্তব্য তাৎক্ষণিক বাজার গরম দিতে পারে বটে। নিজেকে একটা এলিট শ্রেণিতেও তুলে আনা যায়, অন্তত সোশ্যাল মিডিয়ার ইমেজে। হয়তো ভাল কিছু তেমন হচ্ছে না, তাও সত্যি। কিন্তু এটাও তো সত্যি যে, কেউ তো জোর করে চেতন ভগত পড়াচ্ছে না। ইচ্ছে না করলে চেতনায় ফিরে অমিয়ভূষণ মজুমদার পড়া যায়। কিন্তু আমি যদি চেতনই পড়ি শুধু চেতনকে নিয়ে মজা করব বলে, তবে আমার পাঠ-উদ্দেশ্য নিয়েই প্রশ্ন উঠে যায়। এক্ষত্রেও তা-ই হচ্ছে। এবং যে কোনও শিল্প মাধ্যমের পক্ষেই তা বিপজ্জনক প্রবণতা। বাকস্বাধীনতা যেমন গুরুত্বপূর্ণ, তেমনই জরুরি তার মাত্রাবোধ। স্রেফ মাত্রার কারণেই ‘ও’ ক্রমে ‘ত্ত’ হয়ে ওঠে। আদরের ডাকও তখন অনুচ্চারিত হয়ে পড়ে।
আরও পড়ুন, মির্জা গালিব: নিজের বই, নিজের পাঠ
আসলে দীক্ষিত দর্শক, পাঠক, শ্রোতাও একটা খারাপ কাজকে বাতিল করে আর একটা ভাল কাজের জন্ম দিতে। খেউড়, মিমের দুনিয়ায় হারিয়ে আমরা কেন ভুলে যাচ্ছি যে, হাজার খেউড় যা করতে পারে না তাই-ই করতে পারে দর্শকের প্রত্যাখ্যান ও প্রকৃত সমালোচনা। এর থেকে বড় চপেটাঘাত আর কিছুতে নেই। একদা শিক্ষিত-দীক্ষিত দর্শক বাংলা ছবি থেকে মুখ ফিরিয়েছিলেন। ছবিকে তাই নতুন ভাষা খুঁজে নিতে হয়েছে। পুনরায় তা হওয়ার সম্ভাবনাও দেখা দিতে পারে। আবার নতুন স্রোত রাস্তা খুঁজে নেবে। কিন্তু খেউড় কি সমালোচনার সেই গুরুত্বে জল ঢেলে দিয়ে এই মধ্য বা নিম্নমেধার কাজগুলিকেই নিরাপদ আশ্রয় দিচ্ছে না? কারণ উলটোদিকে খেউড়কে কেউ সিরিয়াসলি নিচ্ছেন না, বড়জোর চটে যাচ্ছেন। কিংবা টেকস্যাভি দুনিয়া ব্লকের রমরমা দেখছে। কিন্তু বারংবার একই ঘটনার পুনরাবৃত্তি জানাচ্ছে তাতে আখেরে কোনও লাভ হচ্ছে না। অথচ সোশ্যাল মিডিয়ায় পারত সমালোচনার গুরুত্ব অক্ষুণ্ণ রাখতে। যা চোখের তারায় সত্যি সত্যি আয়না তুলে ধরতে পারত। খেউড়ের ইন্দ্রিয়সুখে আমরা কি ক্রমাগত সেই শক্তিই ক্ষয় করে চলেছি? এবার বোধহয় ভেবে দেখার সময় এসেছে।