এ পৃথিবীতে কিছু জিনিস আছে যা লেখা যায় না। অরুণ জেটলি এ পৃথিবীতে নেই, আর আমি ওঁর অবিচুয়ারি লিখছি, এটা আমি ভাবতে পারি না। আমি যখন দিল্লি আসি, সেটা ১৯৮৭ সাল। আমার সঙ্গে প্রথম ওঁর দেখা হয়েছিল সুপ্রিম কোর্টে। আমি ওঁর একটা মামলার শুনানিতে উপস্থিত ছিলাম। শুনতে শুনতে মুগ্ধ হয়ে গেছিলাম। যেমন সুন্দর দেখতে, তেমন ক্ষুরধার যুক্তি।
সেদিন প্রবীণ আইনজীবী অশোক সেন আমাকে ওঁর সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিয়েছিলেন। আমাকে বলেছিলেন, "এই পাঞ্জাবি ব্রাহ্মণ একদিন দেখো সুপ্রিম কোর্টের প্রধান বিচারপতি হবে।"
না। সে পথে অরুন জেটলি গেলেন না। লালকৃষ্ণ আডবাণী তাঁকে সক্রিয় রাজনীতিতে নিয়ে এলেন। জরুরি অবস্থার সময় জয়প্রকাশ নারায়ণ অরুণকে পছন্দ করেছিলেন। আরএসএস নেতা নানাজি দেশমুখেরও নজরে পড়েন তিনি। সেই অরুণ ধাপে ধাপে কোথা থেকে কোথায় পৌঁছলেন।
ওঁর সবচেয়ে বড় শক্তি ছিল স্পষ্ট মতাদর্শ, যা কিন্তু কট্টরবাদী মনোবৃত্তি বর্জিত। সংসদে বিরোধী নেতাদের সঙ্গেও খুব ভালো সম্পর্ক রক্ষা করতেন অরুণ। যখন বিজেপির সঙ্গে পশ্চিমবঙ্গে তৃণমূল সরকার এবং দলের চূড়ান্ত বিরোধ চলছে, তখনও মমতা বন্দোপাধ্যায়ের অনুরোধে সাড়া দিয়ে অরুণ কলকাতা গেলেন। আমি ওঁর সঙ্গে কলকাতা গেলাম। রাস্তায় যেতে যেতে অরুণ আমাকে বুঝিয়েছিলেন, "রাজনীতি রাজনীতির জায়গায় থাকবে। কিন্তু কেন্দ্র-রাজ্য সম্পর্ক একটা সাংবিধানিক সম্পর্ক। এই সম্পর্ক রক্ষা করা উচিত। আর রাজনীতিতে যতই বিরোধ হোক, ব্যক্তিগত সম্পর্ককে কখনোই খারাপ করা উচিত নয়।"
শুধু মমতা নন, যখন নীতিশ কুমারের সঙ্গে বিজেপির বিরোধ, নীতিশ-লালু ঐক্য স্থাপিত হয়েছে, তখনও অরুণ নীতীশ কুমারের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক রক্ষা করতেন। নীতিশ কুমার দিল্লি এলেই ওঁর বাড়িতে ডিনার খেতে আসতেন। নীতিশ দক্ষিণী খাবার খেতে ভালোবাসেন, তাই ওঁর জন্য স্পেশাল ধোসার ব্যবস্থা হতো। এর পর যখন নীতিশ পুনরায় বিজেপির সঙ্গে সম্পর্ক স্থাপন করলেন, তখন অরুণই মোদীর প্রতিনিধি হিসেবে আলোচনা শুরু করলেন।
অরুণ যখন বাণিজ্য মন্ত্রী হলেন, তখন প্রণব মুখোপাধ্যায় বিরোধী কংগ্রেস নেতা। অরুন একদিন ১৩ নম্বর তালকাটোরা রোডে প্রণববাবুর কাছে এলেন রাতের দিকে। বললেন, "আপনার কাছ থেকে বিশ্ব বাণিজ্য চুক্তি বোঝার আছে। কারণ আপনি প্রথম ডাঙ্কেল প্রস্তাব কার্যকর করেন।" প্রণববাবু রাজ্যসভায় কংগ্রেস নেতা ছিলেন, কিন্তু অরুণের বিশেষ প্রশংসক ছিলেন। বলতেন, "এত ভালো মন্ত্রী বিজেপিতে কম। মাথা খুব পরিষ্কার।"
রাজনৈতিক সহিষ্ণুতা এবং অসহিষ্ণুতা নিয়ে যখন বিতর্ক চলছে, তখন অরুণ কিন্তু সহিষ্ণুতার প্রতীক। এক উদার, সকলকে নিয়ে চলা নেতা ছিলেন। অবশ্য তার মানে এই নয় যে অরুণের মতাদর্শগত কমিটমেন্ট কম ছিল। সংসদে একবার অরুণ বলেছিলেন, "কাশ্মীর নিয়ে যা চলছে তাতে একদিন প্রমাণ হবে, ইতিহাস তার সাক্ষী হবে, যে শ্যামাপ্রসাদ মুখার্জী না নেহরু, কে ঠিক ছিলেন?" এটা বলা যায়, একদিকে যেমন তিনি ঐক্যমতের রাজনীতি করেছেন, আবার অন্যদিকে নিজের মতাদর্শের ব্যাপারে কোনো আপোস করতে রাজি ছিলেন না।
আরও একটা কথা বলা যায়, অরুণ জেটলি জনসংঘের প্রাচীন ধ্যানধারণাকে অভিজাত মধ্যবিত্ত ভারতীয় সমাজের ড্রয়িং রুম পর্যন্ত পৌঁছে দিয়েছিলেন। এর আগে ধুতি-পরিহিত কিছু বৃদ্ধ ছিলেন জনসংঘের প্রতিনিধি। একটা ধারনা ছিল, জনসংঘ মানে সামন্ততান্ত্রিক প্রাচীন হিন্দুবাদী এক দল। এই প্রাচীনপন্থী দলটিকে আধুনিক করে তোলার পিছনেও অরুণের ভূমিকা অনেকটাই।
এক অসাধারণ মজাদার মানুষও ছিলেন তিনি। খেতে ভালোবাসতেন, খাওয়াতেও ভালোবাসতেন। ওঁর জন্মদিনে তিন দিন ধরে উৎসব চলত। একদিন শুধু আইনজীবিদের জন্য, একদিন মিডিয়া, আর একদিন আত্মীয় স্বজনদের জন্য। আমিষ, বিশেষ করে তন্দুরি চিকেন, খেতে খুব ভালোবাসতেন তিনি। ব্যক্তি অরুণ ছিলেন এক চিত্তাকর্ষক ব্যক্তিত্ব।
মাত্র ৬৬ বছর বয়সে তিনি যেভাবে চলে গেলেন, সেটা কিছুতেই মেনে নিতে পারছি না।
শেষদিনগুলোতে সচেতনভাবে যেতাম না। রাজনীতির হুড়োহুড়ি থেকে দূরে থাকতাম। আর ভাবতাম, চিকিৎসকরাই যখন ওঁকে বেশি দেখা করতে নিষেধ করেছেন, দিনে তিনজনের বেশি দেখা না করার পরামর্শ দিচ্ছেন, যখন কথা বলতে গেলেই ওঁর ভয়ানক কাশি এসে যাচ্ছে, তখন কেন দেখা করব? আমার অনুভূতি থাক আমার কাছেই! দিন দশেক আগে রাষ্ট্রপতির মিডিয়া উপদেষ্টা অশোক মালিক দেখা করতে গিয়েছিলেন অরুণের সঙ্গে। অশোক আমার বন্ধু। ও বলছিল, "জানো, অরুণ তোমার কথা জিজ্ঞাসা করছিল। বলছিল, কেমন আছে বাঙালিবাবু?"
হঠাৎ মনে হয়েছিল, তবে একবার যাব দেখা করতে। না হয় কোনও কথা বলব না। দাঁড়িয়ে থাকব। বসব না। কেননা বসলেই তো অরুণ বকবক করতে চাইবেন, আর কাশি এসে যাবে। না, যাওয়াটা আর হলো না। ওঁর স্ত্রী ডলিকে ফোন করে বলেছিলাম, "সামনের রবিবার আসব।"
সেটা আর হলো না। তার আগেই অরুণই বললেন, "অলবিদা"। কৈলাস কলোনির বাড়িতে আর ফিরলেন না।