একটা সমাজে থাকতে গেলে একাধিক মত থাকবেই। যদি এমন কোনো সমাজ থাকে, যেখানে সবার একটাই মত, ভিন্ন কোনো মতই নেই, বুঝতে হবে সেখানে কিছু অস্বাভাবিকতা আছে। এই যেমন পশ্চিম বাংলায় এখন মুখ্যমন্ত্রীর বিরুদ্ধে বক্তব্য রাখা প্রায় অসম্ভব। কিন্তু তাই বলে ভিন্ন মত নেই, তা তো নয়। যখনই, ভিন্ন মত বিভিন্ন রাজনৈতিক দিক থেকে প্রকাশ করা না যায়, তখনই এই অন্তর্দলীয় দ্বন্দ্বগুলো শুরু হয়। এটা ১৯৭২-৭৭ সালে সিদ্ধার্থ শঙ্কর রায়ের আমলেও হয়েছিল। এবার তৃণমূলেও এই গোষ্ঠীদ্বন্দ্ব শুরু হয়েছে। এদের পুরো লড়াইটা পয়সা কেন্দ্রিক। তৃণমূলের নিজেদের মধ্যে সমস্যা শুরু হয়েছে আদর্শ বা ইডিওলজির সংকট থেকে। বলা যেতে পারে, আদর্শের অনুপস্থিতি থেকে। যতদিন ক্ষমতায় সিপিএম ছিল, মমতার আদর্শ ছিল সিপিএম-বিরোধী। সেটা কোনোভাবেই অ্যাকাডেমিক দিক থেকে নয়। সিপিএম এতদিন ক্ষমতায় থাকার ফলে তার বিরুদ্ধে সাধারণ মানুষের মনে একটা ক্ষোভ জন্মেছিল। সেই ক্ষোভকে ভিত্তি করেই মমতার রাজনীতি চলছিল। এখন বাজারে সিপিএম নেই, তাই বিজেপি-বিরোধী আদর্শ নিয়ে মাঠে নেমেছে তৃণমূল।
ইতিমধ্যে যেটা হয়েছে, রাজ্য নির্বাচন কমিশনের অধীনে যে ক'টা (উত্তর দিনাজপুর, মুর্শিদাবাদ, সল্ট লেক) নির্বাচন হয়েছে, আসলে কিন্তু নির্বাচন হয়নি। অন্যান্য দলের সদস্যদের পুলিশের ভয় দেখিয়ে ভাঙিয়ে আনা হয়েছে। আর যারা তাতেও ভয় পাননি, তাঁদের বিরুদ্ধে খুনের মামলা এনে জেলে পুরে রাখা হয়েছে। যেমন, মুর্শিদাবাদের জেলা পরিষদের প্রধান। যেহেতু তিনি দল বদল করেননি, তাকে ১৮ মাস জেল খাটতে হয়েছে। এখানে অত্যন্ত দুঃখের বিষয়, এখানে আদালতগুলোও প্রাথমিক ভাবে সরকারের বক্তব্যই মেনে নিয়েছে। পরে অবশ্য অন্য কথা বলেছে।
যেখানে একটি দলই শেষ কথা, এবং যে রাজ্যে নির্বাচন আসলে হয় না, সেখানে ভদ্রলোকের আধিপত্য থাকতে পারে না। কারণ নির্বাচনে লড়ার জন্য মানুষের কাছে পৌঁছতে হচ্ছে না। 'ভালো' হওয়ার দরকার নেই। গায়ের জোরই শেষ কথা। এর ফলে এমন এক শ্রেণির কাউন্সিলার তৈরি হয়েছে তৃণমূলের, যারা ক্ষমতায় আসার মাস ছয়েকের মধ্যেই দুর্নীতিতে জড়িয়ে পড়েছে।
সিপিএম আমলে দেখা যেত না একজন কাউন্সিলার ক্ষমতায় আসার ছ'মাস কিংবা পাঁচ বছরের মধ্যে স্করপিও চেপে ঘুরে বেড়াচ্ছেন। এখন কিন্তু সেটা হচ্ছে। অধিকাংশ কাউন্সিলার এখন স্করপিওতেই ঘোরেন। এই সরকার ক্ষমতায় আসার পর এদের একেক জনের রোজগার ১০ থেকে ১০০ গুণ বেড়েছে। এবার এই যে এত রোজগার হল, লড়াইটাও বাঁধছে এই রোজগারকে কেন্দ্র করেই। একদল পাচ্ছে, একদল পাচ্ছে না। এই নিয়েই অন্তর্কলহ। এটাই মূল কারণ।
দ্বিতীয় একটা কারণও আছে। পুরনো যাঁরা তৃণমূল ছিলেন, যাঁরা সৎ হিসেবে পরিচিত ছিলেন দলের মধ্যে, তাঁরা কিন্তু আজকে পিছিয়ে গেছেন অনেকটাই। কারণ ভালো লোক দেখিয়ে ভোট আদায়ের আর প্রয়োজনীয়তাই নেই। তৃণমূলে নির্বাচন হয় না। সুতরাং মারদাঙ্গার লোকেরাই সামনে চলে আসছে। ২০০১ সালে আমি তৃণমূলের নির্বাচন লড়েছি, ফাউন্ডারদের মধ্যে ছিলাম। সেই সময়ে যারা তৃণমূলের সঙ্গে থেকেছেন, তাঁরা জানতেন, কিছু পাব না। তা সত্ত্বেও লড়াইটা করেছে সিপিএম এর রাজনৈতিক কিংবা আঞ্চলিক স্তরে অত্যাচারের বিরুদ্ধে। কিন্তু যাঁরা নতুন এসেছেন তৃণমূলে, তাঁদের কিছুই সহ্য করতে হয়নি। দলে যোগ দিয়েই তাঁরা কাউন্সিলার হয়ে গিয়েছেন। এঁদের অধিকাংশই ২০০৯-এর পর দলে এসেছেন। খুব স্বাভাবিকভাবেই এরা লড়াইয়ের ইতিহাসটা দেখেন নি। কিন্তু এঁদের গায়ের জোর এবং পয়সার জোর দুটোই আছে। এঁরা এখন পুরনো তৃণমূল সদস্যদের ওপর আধিপত্য বিস্তার করছেন। পুরনো তৃণমূল সদস্যদের তো পয়সা ছিল না। তাঁরা কোনও একটা আদর্শের বিরোধিতা করে অথবা বিক্ষুব্ধ হয়ে লড়াই করেছিলেন। সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয়, তাঁরা লড়েছিলেন রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে। আর এখন যাঁরা তৃণমূলে এসেছেন, তাঁরাই রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাস ঘটাচ্ছেন।
এখন যেসব 'নামী' লোকেরা তৃণমূলে এসেছেন, তাঁরা তো কেউ আদর্শের জন্য আসেন নি, এসেছেন ধান্দার জন্য। এ সব মানুষের সঙ্গে পুরনোদের সংঘাত অনিবার্য। তাই পুরনোরা পেছনের সারিতে চলে গেছেন। কেউ কেউ আবার বিজেপিতে চলে যাচ্ছেন। তৃণমূলে রয়ে গেছেন এমন অনেকে আমার বাড়ি এসে বলে গেছেন বিজেপিকে ভোট দেবেন। তৃণমূল ছেড়ে বিজেপিতে যোগ দিচ্ছেন একটাই কারণে। এক গুণ্ডার কাছ থেকে বাঁচতে মানুষ যে কারণে আরেক গুণ্ডার কাছে যান। শুধু মার খেতে হবে না, মার দিতেও পারবেন বলে। এঁরাও তো এককালে প্রতিপত্তি দেখিয়েছেন এলাকায়, এখন পারছেন না বলে দল বদলে বিজেপিতে যোগ দিচ্ছেন। যাঁদের প্রতিপত্তি দেখানোর চাপ নেই, তাঁরা কিন্তু এই সংকটে ভোগেন না।
নিজেদের মধ্যে অন্তর্কলহ কংগ্রেস, সিপিএম-এ কি হয়নি? নিশ্চয়ই হয়েছে। কংগ্রেস নাহয় ধরলাম পশ্চিম বঙ্গে ৪৩ বছর ধরে ক্ষমতায় নেই, তাদের ভেতরের সমস্যা মানুষের কাছে এসে না পৌঁছনোই স্বাভাবিক। আদর্শ নিয়ে, ক্ষমতা নিয়ে একটা রাজনৈতিক দলের সদস্যদের মধ্যে মতবিরোধ হবেই। কিন্তু তৃণমূল ক্ষমতায় আসার আগে তা এত প্রতীয়মান ছিল না, সাধারণ মানুষের যাপনে তার কোনো প্রভাব পড়ত না।
আমি কিন্তু ভীষণভাবে কমিউনিস্ট বিরোধী। ওরা বুনিয়াদী স্তরে গণতন্ত্র বলতে যা বোঝায়, তাতে বিশ্বাস করে না বলেই আমি মনে করি। সিপিএম-এর ৩৪ বছরের শাসনকালেও তো দলের সদস্যদের মধ্যে মতানৈক্য হয়েছে। কিন্তু তা এখনকার তৃণমূলের মতো প্রকাশ্যে আসেনি। নিজেদের মধ্যে ঝগড়া হচ্ছে, হতেই পারে, স্বামী-স্ত্রী-র মধ্যে প্রায়শই হয়, কিন্তু তা বাইরের লোকের কাছে পৌঁছবে কেন? শেষ সাত বছরে আঞ্চলিক স্তরে অনেক সিপিএম নেতাকে কাছ থেকে দেখেছি। কাউন্সিলার তাঁর এলাকায় শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত বাড়ি বানিয়ে ফেললেন, তৃণমূলের মতো এরকম অসততা কিন্তু সিপিএম এর মধ্যে নেই। বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য, গৌতম দেব, অসীম দাশগুপ্তর বাড়ি গেলে এখনও দেখতে পাবেন কতটা সাধারণ জীবন যাপন করেন ওঁরা। এই প্রসঙ্গে আমি বিজেপির কথা আলাদা ভাবে বলতে চাই, ওরাও কিন্তু তৃণমূলের রোগে আক্রান্ত হচ্ছে।
তৃণমূলের গোষ্ঠীদ্বন্দ্ব মানে একদল চোর আরেকদল চোরের সঙ্গে লড়াই করছে। কলকাতা পুরসভায় যে ১৪২ জন কাউন্সিলার আছেন, তাঁদের মধ্যে ১০ জনকে নিয়ে মমতা ব্যানার্জি মঞ্চে উঠতে পারবেন, যাদের বিরুদ্ধে চুরির অভিযোগ (প্রমাণ হয়েছে কী না, সে অন্য প্রসঙ্গ) নেই? যেখানে প্রতাপ প্রতিপত্তি নির্ভর করছে বৈভব এবং গায়ের জোরের ওপর, সেখানে গোষ্ঠীদ্বন্দ্ব হবেই। এখানে আদর্শের জায়গাই নেই। 'জোর যার, মুলুক তার'। স্বাভাবিক ভাবেই এই নীতিতে বিশ্বাস করে বলেই তৃণমূলে গোষ্ঠীদ্বন্দ্ব আছে, থাকবে, এবং এইটাই তৃণমূল দলটাকে শেষ করবে।
বাংলার রাজনীতিতে যে সৎ কেউ নেই, সেটা বলা ঠিক না। আমি নকশালদের মধ্যে, একদম নিচু স্তরের সিপিএম-এর মধ্যে, ছাত্র রাজনীতির স্তরে পড়াশোনা করা সৎ ছেলে এখনও আছে। এমনিতে যে কোনও মধ্যবিত্ত পরিবারের একটু পড়াশোনা করা লোক কিন্তু ভীষণ ভাবে তৃণমূল বিরোধী। কিন্তু ভয়াবহ ব্যাপার, তৃণমূল বিরোধী হতে গিয়ে এদের একাংশ বিজেপিতে যোগ দিচ্ছে। এই প্রবণতা খুবই বিপজ্জনক। তবে আমি একটা ব্যাপার লক্ষ করেছি, শহরের চিন্তাভাবনা ক্রমশ সারা রাজ্যে ছড়াতে থাকে। সারা রাজ্যে যখন কংগ্রেসের হাওয়া ছিল, কলকাতা শহর বামপন্থার দিকে ঝুঁকেছিল। সেই হাওয়া এক সময় সারা রাজ্যে ছড়িয়ে পড়ল। আবার বাম বিরোধী ঝড়টাও কিন্তু কলকাতা থেকেই শুরু হয়েছিল। ঠিক একই ভাবে কলকাতা কিন্তু এখন তৃণমূল বিরোধী। এই বিরোধিতা কোন দিকে নিয়ে যাবে কিচ্ছু বলা যায় না।
(মতামত ব্যক্তিগত)
অনুলিখন: মধুমন্তী চট্টোপাধ্যায়