Advertisment

'পড়াশোনা করা ছেলেমেয়েদের মতামত সরকার শুনবে না'

"মোদীর বিরুদ্ধে যদি বাম-মমতা জোট হয়, কেমন হবে? আমার তো মনে হয় একদিকে কেউটে সাপ থাকলে অন্যদিকে গোখরো সাপ," বলছেন কংগ্রেস নেতা এবং বিশিষ্ট আইনজীবী অরুণাভ ঘোষ

author-image
IE Bangla Web Desk
New Update
NULL

আজকের ভারতবর্ষে শেষ কথা হল রাষ্ট্রশক্তি। রাষ্ট্রশক্তির পক্ষে থাকলে আপনার সাতখুন মাফ, আর রাষ্ট্রশক্তির বিপক্ষে থাকলে খুব সামান্য কারণেও আপনাকে জেলে বছরের পর বছর আটকে রাখবে। এর প্রমাণ হলেন ছত্রধর মাহাতো। যিনি জীবনে বন্দুক চালাননি, অথচ সারাটা জীবন জেলেই কেটে যাচ্ছে তাঁর। এটা কিন্তু আলাদা করে কোনো দলের বৈশিষ্ট নয়। সিপিএম, তৃণমূল, কংগ্রেস, সব জায়গাতেই ছবিটা এক।

Advertisment

সংবাদপত্রগুলোও মারের ভয়ে চাটুকার হয়ে গিয়েছে। এদের নিজেদের কোনও মত নেই। ফলত, 'আইডিয়া অব অপোজিশন'টাই উঠে যাচ্ছে। ছাত্রদের মধ্যে পড়াশুনো কমে গেছে। মঠের স্বামীও মোদী-মমতাকে নিয়ে মন্তব্য করছেন, ক্ষমতায় কার আসা দরকার বলছেন। অথচ মঠের স্বামীর তো রাজনীতি নিয়ে কোনও কাজ থাকার কথা না।  ভগবান চিন্তাটাও রাষ্ট্রশক্তির অধীনে চলে এসেছে।

এই যে চারজন নকশালকে গ্রেফতার করা হল, তাঁরা কোনো এক কালে নকশালবাড়ির চিন্তাধারায় বিশ্বাসী ছিলেন। আমরা চিন কিংবা সোভিয়েত রাশিয়াকে সমালোচনা করি কেন? অন্য কোনও চিন্তাধারার জায়গাই ছিল না। এখানেও তো তাই-ই হচ্ছে। চারটি ছেলে কোথাও ভাষণ দিতে গিয়েছিল, ইউপিএ আইনে ধরে ঢুকিয়ে দিল জেলে! এখানে বিরোধী চিন্তার কোনও স্থান নেই। পড়াশোনা করলে অন্য মত হতেই পারে, তাই, পড়াশোনা করা ছেলেমেয়েদের মতামত এই সরকার শুনবে না। তৃণমূল কংগ্রেসের ছেলেদের তো আর পড়াশোনা নেই। 'মা'-'মাটি'-'মুখ্যমন্ত্রীর অনুপ্রেরণা' ছাড়া এরা কিছু বোঝেও না। অর্ণব দাম একজন পড়াশোনা করা ছেলে, কিন্তু জেল থেকে তাকে ঠিক সময়টা বলা হল না বলে সে পরীক্ষার হলে পৌঁছতে পারল না। জেলের গাফিলতির জন্য একটা ছেলে পরীক্ষা দিতে পারল না, এর থেকে খারাপ প্রশাসন হয় আর?

আরও পড়ুন: আদর্শ একটাই, ‘জোর যার মুলুক তার’

সাম্প্রতিককালের এক ছাত্রনেতার জ্ঞান দেখে রীতিমত অবাক হয়ে যাচ্ছি। কানহাইয়া কুমার। আমার সঙ্গে মতের মিল নেই, কিন্তু ছেলেটির যুক্তিবোধ অসাধারণ। আমায় রীতিমত ভাবাচ্ছে। দিন তিনেক আগেই কানহাইয়া বলে গেল, দিল্লিতে মোদী যা করছেন, রাজ্যে মমতাও সেটাই করছেন।

লোকসভার আগে অনেকেই বলছেন, মোদীর বিরুদ্ধে যদি বাম-মমতা জোট হয়, কেমন হবে? আমার তো মনে হয় একদিকে কেউটে সাপ থাকলে অন্যদিকে গোখরো সাপ। কোন দিকে যাব? কিসের জন্য যাব? শুধুমাত্র ক্ষমতার জন্য তো? আমি আগেও বলেছি, রাজনীতিতে এখন ক্ষমতাই শেষ কথা। মোদী জিতলে নিঃসন্দেহে একরকম ক্ষতি। কিন্তু আঞ্চলিক দলগুলো জিতলে তার ফল হবে ভয়াবহ। এরা আসলে কংগ্রেস বা বিজেপি-রই লোক। ব্যক্তিস্বার্থে আজকে অন্য দল করেছে। মমতাও তো আসলে কংগ্রেসের। খণ্ড বিখন্ড হয়ে এক জায়গায় যাওয়া তো শুধু এবং শুধুমাত্র স্বার্থের কারণে। এর চেয়ে কংগ্রেস আসুক অথবা বিজেপি আসুক।

আমাদের দেশে ধর্মের রাজনীতি ট্রেন্ড হয়ে দাঁড়াচ্ছে ক্রমশ। আমাদের ছোটবেলায় কই, আমরা ধর্ম দেখে বন্ধু বেছেছি, এমনটা তো হয়নি। রাজ্যে মমতা, অথবা কেন্দ্রে মোদী তো হিন্দু-মুসলমানের মধ্যে অশান্তিটাকে জিইয়ে রাখতে চাইছে। আমি তো অদূর ভবিষ্যতে কোনও বিকল্প দেখতে পাই না। তলোয়ার ছেড়ে বোমা তুলে নিচ্ছে হাতে, এই তো যা বদল আসছে। 'ছোটলোকের' ক্ষমতায়ন হচ্ছে বলেই ভদ্রলোকেরা ক্রমাগত রাজনীতি থেকে দূরে সরে যাচ্ছে। রাজ্যে সৌগত রায়, সুব্রত মুখার্জি, অমিত মিত্র সামনে আসতে পারছেন না। মুখ খুলতে না পেরে হাতজোড় করে পিছনের সারিতে থেকে যাচ্ছেন।

ভদ্রলোকেদের ফিরিয়ে আনতে না পারলে ভবিষ্যৎ অন্ধকার। বাম জমানায় আমি সরকারের অনেক নীতির তুমুল বিরোধিতা করেছি। কিন্তু সিপিএম-এর আমলে ফার্স্ট ক্লাস ডিগ্রি ছাড়া উপাচার্য হয়েছেন কেউ, এমন ঘটনা ঘটেনি। এখন যারা উপাচার্য হচ্ছেন, তাঁরা অশিক্ষিত। নিজের বিষয় নিয়ে কতটা কী পড়াশোনা করেছেন জানি না, মোটকথা তাঁদের সঙ্গে কথা বলা যায় না।

আরও পড়ুন: ‘যে সিপিএম-কে হারিয়েছেন, সেই সিপিএম-কে আর ফেরত আসতে দেব না’

পশ্চিমবঙ্গে কংগ্রেসের আমলে সিদ্ধার্থশঙ্কর রায়ের মন্ত্রিসভায় ছিলেন ভোলা সেন, অজিত পাঁজা, গণি খান চৌধুরী, সিপিএম-এর আমলে বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য ছিলেন, জ্যোতি বসু নিজে ছিলেন, অসীম দাশগুপ্ত ছিলেন, বিনয় চৌধুরী ছিলেন। এখন কারা আছেন? বেচারাম মান্না, সুজিত বসু? কলেজ কেন, এঁরা স্কুলের গণ্ডীও পেরোননি। ৪৬ জন মন্ত্রীর মধ্যে ১০-১২ জন কলেজের মুখ দেখেন নি। খাতা কলম নিয়ে বসালে দু-কলম বাংলা লিখতে পারেন না।

একটা সুস্থ সমাজ গড়তে গেলে সরকার এবং সাধারণ মানুষের সমালোচনার অধিকার তো থাকতে হবে। 'না' বলার অধিকার থাকতে হবে। সেই অধিকারটাই থাকছে না রাজ্যে অথবা কেন্দ্রে। ভারত থেকে গণতন্ত্র উঠেই যাচ্ছে ক্রমশ। যুক্তির জায়গায় তোষামোদ প্রাধান্য পাচ্ছে। বার্ট্রান্ড রাসেল একটা কথা বলেছিলেন, সিআপনি যদি একটা সংগঠনের ওপরে উঠতে চান, নিজের কথা না বলে বসের কথা বলুন। বেশ সহজেই শীর্ষে পৌঁছনো যাবে, কিন্তু শীর্ষে পৌঁছে বুঝবেন, আপনার নিজের কোনও মত নেই, কারণ আপনি সারাজীবন নিজের কথা বলেন নি।" শাসক দলের একটা ছাত্রনেতার কথা বলতে পারবেন, যে পড়াশোনা করে রাজনীতি করতে এসেছে? শাসকদল সম্পূর্ণ আনুগত্য চায়, যেটা একজন শিক্ষিত মানুষের পক্ষে সম্ভব নয়।

আরও পড়ুন ‘এমনও তো হতে পারে, মমতাকে জেলে যেতে হল’

একটা আশ্চর্য ব্যাপার খেয়াল করেছেন কি না জানি না, কিন্তু বাংলা ভাষাভাষী তিনটি জায়গাতেই গণতন্ত্র নেই। পশ্চিমবঙ্গ, ত্রিপুরা এবং বাংলাদেশ। মূল কারণ একটাই। বাঙালিদের মধ্যে অশিক্ষা বেড়ে গিয়েছে। স্কুলমাস্টারের প্রতি শ্রদ্ধাটা চলে গিয়ে পয়সার প্রতি সম্মান বেড়েছে। মানুষ দেখছে রোলের দোকান দিয়ে কোটিপতি হওয়া যায়, তাহলে আর কষ্ট করে শিক্ষিত হয়ে কী হবে? আপনি দেখবেন, রাজ্যে শাসকদলে সৎ লোক হাতে গোনা। এবং যাঁরা সৎ, দলের মধ্যে তাঁরা প্রাসঙ্গিকতা হারিয়ে পেছনের সারিতে। অথবা কেউ কেউ শিরদাঁড়াহীনতায় ভুগছেন - "আমার যেটুকু আছে, ক্ষমতায় না থাকলে সেটুকুও চলে যাবে"।

আরেকটা কথা আমার মনে হয়, বামেদের যারা শরিক ছিল, ৩৪ বছরে দলের নীচের স্তরে ক্ষমতায়ন করে দিয়ে দলটাকে শেষ করে দিল। লোকে তখন বলত, অনিল বিশ্বাসের সাংগঠনিক শক্তি সাংঘাতিক। কিন্তু আমার ব্যক্তিগত মতামত, সেই সময় হাওয়া ওদের পক্ষে, ওই অবস্থায় সাংগঠনিক ক্ষমতার পরীক্ষা হয়নি। এখনকার পরিস্থিতিতে আসল পরীক্ষা হত। সিপিএম-এর লড়ে নেওয়ার মানসিকতাটাই নষ্ট হয়ে গিয়েছে। সিপিএম-এর মিছিলে প্রচুর লোক হচ্ছে, অথচ পাড়ায় একটা লোকও সিপিএম করে না।

রাজনীতি একটা গঠনমূলক পদ্ধতি। সোমনাথ চ্যাটার্জি একবার একটা কথা বলেছিলেন। বর্তমান পরিস্থিতির বিরুদ্ধে ভেতরে অনেক রাগ না থাকলে রাজনীতি করা যায় না। এখন সেই রাগের বহিঃপ্রকাশটা হচ্ছে না। কারণ দুটো। এক - ভয়। দুই - লোভ। ভয় এবং লোভ, এই দুটো জিনিস সারা দেশকেই খতম করে দিচ্ছে। রাষ্ট্রশক্তির কাছে সামান্য একটু মাথা নোয়ালেই বাড়ির সামনে ঝাঁ চকচকে একটা গাড়ি দাঁড়িয়ে থাকবে। আর রাষ্ট্রশক্তিকে প্রশ্ন করলে ঠাই হবে জেলে।

west bengal politics
Advertisment