হিন্দু তোষণের রাজনীতি দিয়ে যায় চেনা?

অরবিন্দ উচ্চশিক্ষিত, ভুয়ো ডিগ্রির দায় নেই। তাই পরিণত মননে দিল্লির শিক্ষাখাতে খরচ মোট বাজেটের একটা বড় অংশ। ধর্মের রাজনীতি কতটুকু করবেন, তা ঠিক করেন একেবারে অঙ্ক কষে।

অরবিন্দ উচ্চশিক্ষিত, ভুয়ো ডিগ্রির দায় নেই। তাই পরিণত মননে দিল্লির শিক্ষাখাতে খরচ মোট বাজেটের একটা বড় অংশ। ধর্মের রাজনীতি কতটুকু করবেন, তা ঠিক করেন একেবারে অঙ্ক কষে।

author-image
IE Bangla Web Desk
New Update
arvind kejriwal soft hindutva

দিল্লি ভোটে কি জয় নরম হিন্দুত্বের? অলঙ্করণ: অভিজিৎ বিশ্বাস

দিল্লি বিধানসভায় আপের বিপুল জয়ের পর সংবাদমাধ্যমের অনেকটা জায়গা জুড়ে অরবিন্দ কেজরিওয়ালের কৌশল। এই ধরণের বিপুল জয় তো আর রোজ সকালে আসে না। তাই করোনাভাইরাসের কথা ভুলে মানুষ মজেছে দিল্লি বিধানসভার পরিসংখ্যানে। সংখ্যার পেছনে কারণ থাকবে। আর সেই কারণ তো একটা নয়, এক গাদা।

Advertisment

শুরুতে আছে উন্নয়ন। দিল্লি দেশের রাজধানী, ফলে পরিকাঠামো কিংবা পরিষেবায় টাকাপয়সা পাওয়া খুব শক্ত নয়। পুলিশ অমিত শাহের হাতে। সুতরাং আইন শৃঙ্খলা নিয়ে কোনও দায়িত্ব নেই। মুখ্যমন্ত্রী বেশ সাবধানী। নিজের হাতে কোন দপ্তরই রাখেন না। ফলে দৈনন্দিন খুচরো কাজ কম। নীতি এবং দেশের ভবিষ্যৎ নিয়ে ভাবতে পারেন। এ কি আর পশ্চিমবঙ্গ, যেখানে জননেত্রীকে বাজেট বক্তৃতার শেষের কবিতা থেকে শুরু করে সিঁথি থানার ডায়েরি, সবই লিখে দিতে হয়?

অরবিন্দ নিজে উচ্চশিক্ষিত, ভুয়ো ডিগ্রির দায় নেই। তাই পরিণত মননে দিল্লির শিক্ষাখাতে খরচ মোট বাজেটের একটা বড় অংশ। ধর্মের রাজনীতি কতটুকু করবেন, তা ঠিক করেন একেবারে অঙ্ক কষে। শাহীনবাগের দিকে পা বাড়ান নি। ভোটফল দেখলে বুঝতে অসুবিধে হয় না যে শাহীনবাগে গিয়ে কতটা গোলমাল করে ফেলেছিলেন মনীশ সিসোদিয়া। গত পাঁচ বছর গোটা দিল্লির বেশিরভাগ দায়িত্ব নেওয়া মানুষটি জিতেছেন সামান্য ভোটে। সোজা বাংলায়, সংখ্যালঘু তোষণের খেলা যে এখন সুবিধের নয়, সেকথা বারবার উঠে আসছে ভোটফলে।

অর্থাৎ ভারতের রাজনীতির রসায়ন এখন সংখ্যাগুরু তোষণের কৌশল। দেশ দখলের লড়াই উগ্র এবং কোমল হিন্দুত্ববাদীদের মধ্যে। সংখ্যালঘুদের খুব কিছু করার নেই, তাদের কোমল হিন্দুত্ববাদীদেরই সমর্থন করতে হবে। ঠিক যেমনটি হয়েছে দিল্লিতে। মুসলিম এবং শিখ ভোটের প্রায় পুরোটাই গেছে আপের দিকে, সে যতই অরবিন্দ হনুমান মন্দিরে যান না কেন। ফলে ঠিকভাবে বিজেপি বিরোধিতা দেখাতে পারলে সংখ্যালঘু ভোট নিশ্চিত। কিন্তু শুধু সেইটুকুতে তো নির্বাচনে জয়লাভ করা যাবে না। তাই আপকে খুব সাবধানে খেলতে হয়েছে।

Advertisment

এই জায়গায় পশ্চিমবঙ্গের কথাও আসবে। এখানে সংখ্যালঘু ভোট এখন বেশিরভাগটাই তৃণমূলের দিকে। তৃণমূল যতই হিন্দু দেবদেবীর আরাধনা করুক না কেন, পশ্চিমবঙ্গের অহিন্দুদের তাতে বিরোধিতা করার জায়গা খুব কম। তৃণমূলের ওপর চটে গিয়ে তাঁরা বাম-কংগ্রেসকে সমর্থন করলে সুবিধে বিজেপিরই। তাই তৃণমূলকে আঁকড়ে ধরে থাকা ছাড়া সংখ্যালঘুদের অন্য পথ বিশেষ নেই।

এরই একটি অনুসিদ্ধান্ত হলো, রাজ্য নির্বাচনগুলিতে এখন আর মুসলিম তোষণের প্রয়োজন নেই। বিজেপি বিরোধী হলেই সেটুকু ভোট ঝুলিতে আসবে, যদি না সেখানে একের বেশি দল থাকে। মূল লক্ষ্য তাই হিন্দু ভোটের ভাগাভাগি, যেখানে হিন্দু তোষণ মুখ্য। সেই ধরণের কৌশল নিতে হবে রাজনৈতিক দলগুলোকে। দিল্লি বিধানসভা নির্বাচনের মাসখানেক আগে থেকে প্রশান্ত কিশোর সেই বার্তাই দিয়েছেন কেজরিওয়ালকে। সামনে বিহার নির্বাচনে যেহেতু এখনও ত্রিমুখী লড়াই, সেখানে এই অঙ্ক কিভাবে কাজ করবে তা পরিষ্কার নয়। পশ্চিমবঙ্গ অনেকটা দিল্লির মতন। বাম-কংগ্রেসের ভোটের ভাগ যেভাবে কমছে, তাতে লড়াই বিজেপি বনাম তৃণমূল। দিল্লির তুলনায় সংখ্যালঘু ভোটের ভাগ পশ্চিমবঙ্গে অনেকটা বেশি। সেই জায়গায় তৃণমূল ঠিক কতটা নরম হিন্দুত্ব বিক্রি করতে পারবে, সেটাই এখন দেখার।

মোটের ওপর বিজেপির সামনে এখনও খুব বিপদ নেই। তাদের মূল লক্ষ্য দেশের ক্ষমতা দখল, অর্থাৎ লোকসভা ভোট। বিধানসভা নির্বাচন তাদের কাছে সমীক্ষা মাত্র। হারুক বা জিতুক, বিভিন্ন রাজ্যে পঁয়ত্রিশ শতাংশের কাছাকাছি সমর্থন ধরে রাখতে পারলেই হলো। লোকসভা নির্বাচনের সময় বিভিন্ন আঞ্চলিক দলের (এক্ষত্রে নামে সর্বভারতীয় হলেও, আপ কিংবা তৃণমূলকে আঞ্চলিক ধরলেই বিশ্লেষণ স্পষ্ট হবে) জোট যেহেতু দেশবাসীর কাছে বিশ্বাসযোগ্য কোনও পরিবর্ত পেশ করতে পারবে না, তাই বিজেপির ভোট আবার কিছুটা বেড়ে যাওয়াই স্বাভাবিক।

জাতীয়তাবাদী প্রবণতা এ দেশের ভোটারদের মধ্যে যথেষ্ট। রাহুল গান্ধী তো বলেই দিয়েছেন, বিজেপি বিভিন্ন লোকসভা নির্বাচনের আগে কিভাবে লাভবান হয়। এর সঙ্গে এ কথা মানতেই হবে, হিন্দুত্ববাদকে আত্মস্থ করার ক্ষেত্রে অন্যান্য যে কোনও দলের তুলনায় বিজেপিকে বিশ্বাস করার জায়গা বেশি। সবচেয়ে বড় কথা, বিজেপির বিরুদ্ধে আর্থিক দুর্নীতির অভিযোগ খুব বেশি নেই। অর্থাৎ সততার যে মুনাফা দিল্লি নির্বাচনে অরবিন্দ কেজরিওয়াল ঘরে তুলেছেন, সারা দেশের ক্ষেত্রে সেই জায়গায় বিজেপি অবশ্যই এগিয়ে।

বিজেপির সবচেয়ে বড় শত্রু বামেরা। পশ্চিমবঙ্গ এবং ত্রিপুরায় বামেদের উৎখাত করার কৃতিত্ব বিজেপি অবশ্যই পাবে, যথাক্রমে পরোক্ষ এবং প্রত্যক্ষভাবে। বাকি শুধু কেরালা। সেখানেও প্রভাব বিস্তার করছে বিজেপি। বিজেপির দ্বিতীয় শত্রু কংগ্রেস। বিভিন্ন রাজ্যে কংগ্রেসকে দ্বিতীয় থেকে তৃতীয় বা চতুর্থ স্থানে ঠেলে অপ্রাসঙ্গিক করে দেওয়ার কৌশলে সফল বিজেপি। বড়জোর কংগ্রেস কিছু কিছু রাজ্যে শাসকদলের জোটসঙ্গী। অল্প কয়েকটি রাজ্যে, যেখানে বিজেপি আর কংগ্রেস মুখোমুখি, সেখানে বিধানসভায় হাড্ডাহাড্ডি লড়াই। কিন্তু লোকসভায় কে এগিয়ে থাকে সেই প্রবণতা গত দুটি লোকসভা নির্বাচনে একেবারে পরিষ্কার। বুঝতে অসুবিধে হয় না যে বাম এবং কংগ্রেসকে কোণঠাসা করে দিতে পারলে সর্বভারতীয় ক্ষেত্রে বিজেপি বিরোধীদের জোটের বাঁধন একেবারে আলগা।

তাহলে কি সামনের ২০২৪ লোকসভা নির্বাচন করে আর পয়সা খরচ করার দরকার নেই? রাষ্ট্রপতি বিজেপিকে ডেকে নিলেই হয়? আজকের পরিস্থিতিতে বিষয়টা একেবারেই তাই, কিন্তু ২০২৪ বেশ খানিকটা দূরে। মনে রাখতে হবে, আপ যখন হইচই করে আবির্ভূত হয়েছিল, তখন তাদের লক্ষ্য ছিল গোটা দেশ। অরবিন্দ কেজরিওয়াল সেই সময় শুধু দিল্লি নিয়ে ভাবেন নি। তবে উপর্যুপরি বেশ কয়েকটি লোকসভা নির্বাচনে ব্যর্থ হয়ে তিনি শুধু রাজ্যে নজর দিয়েছেন। এখন নরম হিন্দুত্বে সংখ্যালঘু ভোট ঝুলিতে আসার অঙ্ক বুঝতে শুরু করেছেন তিনি।

হিন্দুত্ববাদের দুটি ভাগ, এক হলো হিন্দু জাতীয়তাবাদ (উদাহরণ, পড়শি দেশের সঙ্গে যুদ্ধ) আর অন্যটা হিন্দু ধর্মবাদ (উদাহরণ, রামমন্দির)। এর মধ্যে প্রথমটি যে সংখ্যালঘু ভোটের সঙ্গেই এক ঝুড়িতে কুড়িয়ে নেওয়া যায়, তা প্রমাণ করেছেন কেজরিওয়াল। পাকিস্তানের সঙ্গে ঝামেলায় সরাসরি বিজেপি সরকারের পাশে থেকেছেন তিনি, সমর্থন করেছেন কাশ্মীর নিয়ে কেন্দ্রের সিদ্ধান্ত। অন্যদিকে নাগরিকত্ব বিল নিয়ে হিন্দু ধর্মবাদ সংক্রান্ত আলগা বিরোধিতার পুঁজি সুদ হিসেবে সংখ্যালঘু ভোট পুরোটাই জুটিয়ে দিয়েছে। নরম হিন্দুত্বের এই রাস্তায় গত দুটি লোকসভা নির্বাচনে ব্যর্থ কংগ্রেস। অরবিন্দ কেজরিওয়াল কি সেই পথে জোট বানিয়ে লোকসভায় আবার হাত পোড়ানোর ঝুঁকি নেবেন? পা বাড়ানোর আগে সম্ভবত তাঁরও নজর এখন বঙ্গভোটে হিন্দু তোষণের রাজনীতির দিকে।

(লেখক ইন্ডিয়ান স্ট্যাটিস্টিক্যাল ইন্সটিটিউটের অধ্যাপক, মতামত ব্যক্তিগত)