শঙ্কর রায়
অনুজপ্রতিম ও প্রবীণ সাংবাদিক শুভাশিস মৈত্রের কাছ থেকে যখন জানলাম যে ডঃ অশোক মিত্রের জীবনের ইনিংসের অবসান হয়েছেন ( ক্রিকেট নিয়েও একাধিক মনোগ্রাহী লেখা লিখেছেন), তখন মনে হল যেন এই অনিবারণীয় বেদনামিশ্রিত মূহূর্তের জন্য প্রস্তুত ছিলাম। স্মৃতির তোরণ আচমকা খুলে গেল। আমার সঙ্গে সঙ্গেই ভেঙে পড়ল তাঁর সঙ্গে গড়ে ওঠা অগণিত পাঠকের সেতু।
চাঁচাছোলা কথা বলতে ভালোবাসতেন যেমন, তেমনি ওঁর লেখার তীব্র সমালোচনাতে রুষ্ট বা কাতর হতেন না। লেখার প্রতিবাদে কেউ সরব হলে বোধহয় কালেভদ্রেও প্রত্যুত্তর দিতেন না। এমন মানুষের জীবনাবসানের পরে তাঁর সমালোচনা করা হয়ত অনভিপ্রেত নয়। তবু এখন সেই সব কথা বলার বা লেখার অবকাশ নয়। ব্রিটেনে ৩০ দশকের অক্সফোর্ড কবি গোষ্ঠীর (যাঁরা ছিলেন বামপন্থী ও কমিউনিস্ট-ঘেঁষা) অন্যতম জ্যোতিস্ক লুই ম্যাকনিসের অকাল প্রয়াণে( ৩ সেপ্টেম্বর ১৯৬৩) তাঁর কাব্যসংগ্রামে সহযাত্রী উইস্টান হিউ অডেন লেখেন, “ডেথ ইজ নো অকেশ্যন টু পোস্টমর্টেম দি ওয়ার্ক্স অফ ওয়ান’স লাইফটাইম”। কিছুটা দোটানা থাকলেও সেই নীতি মানব এই লেখায়।
আরও পড়ুন, // নিষ্প্রভ মে দিবস //
আগেই বলি ডঃ মিত্রের রাজনৈতিক ভাবনার সাথে আমার অবস্থানের অনেক ব্যবধান ছিল। কিন্তু মতান্তর কখনো আমার কাছে মনান্তরের সোপান ছিল না। এ শিক্ষা পেয়েছি আমার অন্যতম রাজনৈতিক পথ প্রদর্শক সত্যেন্দ্রনারায়ণ মজুমদার- প্রায় দেড় দশক আন্দামানে সেলুলার জেলে অন্তরীণ ও ‘কাঞ্চনজঙ্ঘার ঘুম ভাঙছে’র লেখক, ১৯৫২-৫৬ রাজ্যসভায় সিপিআই-এর ডেপুটি লিডারের কাছ থেকে। তাই মিত্রের সমালোচক হলেও তাঁর লেখার প্রতি অনুরক্ত ছিলাম। এজন্যে অনেকে আমাকে ঠেস দিয়ে কথা বলতন, যাঁরা তাঁর পক্ষে লিখতে চাইত না। আমি তাঁর পি এইচ ডি থিসিস ‘শেয়ার অফ ওয়েজেস ইন ন্যাশনাল ইনকাম’ পড়ে মুগ্ধ। সেকথা তাঁকে একাধিকবার জানিয়েছি। তাঁর সুপারভাইজার ছিলেন ইয়ান টিনবার্জেন, অর্থবিজ্ঞানে প্রথম যে দুজন নোবেল পুরস্কার পান, তাঁদের একজন।
প্রথম সাক্ষাৎ ১৯৭০-এর শেষে। তিনি তখন প্রথম বামফ্রন্ট সরকারের অর্থ মন্ত্রী । ‘ইনডিয়া টু ডে’ থেকে রামন স্বামী (সেই সময়কার একজন স্পেশ্যাল করেসপন্ডেন্ট) আমার দফতরে ফোন করে বললেন , ‘শঙ্করদা, আপনাকে কাল সকাল সাড়ে ৯টায় অশোক মিত্রের ছোট্ট সাক্ষাৎকার নিতে হবে। ব্যবস্থা আমরা করছি। আপনি সময়মতো যাবেন ( আমার তো অভিধানে ‘পাংচুয়ালিটি’ শব্দটা নেই, তাই ‘সময়মতো’ কথাটার ওপর জোর)’। রাজি হলাম এক শর্তে, যে আমার নাম থাকবে না, কারণ আমি তখন অধুনালুপ্ত ‘ক্যাপিটাল’ সাপ্তাহিক-এর সিনিয়র সাব-এডিটর, অন্য পত্রিকায় লেখা নিষেধ । পৌঁছে গেলাম সাড়ে ৯টার আগেই। আমার মনে পড়ছে, আমার একটি প্রশ্নের উত্তরে দুটি শব্দবন্ধ। আমি জিজ্ঞাসা করলাম এই যে পুঁজিবাদী পথে বিকাশে ভারতের মত দেশ এগিয়ে যাবার বদলে পিছু হঠছে, এ বিষয়ে তিনি কী ভাবেন। সোজা সহজ জবাব, ‘লিখতে পারেন, ‘ডেভলপমেন্ট অফ আন্ডারডেভলপমেন্ট’। তার অনেক পরে পড়েছি লাতিন আমেরিকার অর্থনীতির বিশ্ববিশ্রুত অর্থ শাস্ত্রবিদ অধ্যাপক গুন্দার ফ্র্যাঙ্কের তত্ত্ব ‘ডেভলপমেন্ট অফ আন্ডারডেভলপমেন্ট’। তাঁর থিসিস পড়ে মুগ্ধ হবার বিরল অবকাশ পেলেও লিখিত সমালোচনা করেছি তাঁর মুখবন্ধের একাংশ। তিনি বলেছিলেন, ১৯৫৫ সালে তাঁর সিদ্ধান্ত থেকে সরে আসছেন না। তিনি বলেছিলেন যে মার্ক্স-এর সূত্রায়ন (‘রেলেটিভ ইমপভারিশমেন্ট অফ প্রলেটারিয়েট’) আর প্রযোজ্য নয়। এ এল বাউলি ও অন্যান্যদের লেখা উদ্ধৃত করে তাঁর এই সিদ্ধান্ত। আমি মার্ক্সবাদী অর্থবিজ্ঞানী ইয়ান কুকজিনস্কির লেথা থেকে দেখাতে চেষ্টা করেছি যে প্রকৃত মজুরিবৃদ্ধির সূচকের চেয়ে বেশি উৎপাদনবৃদ্ধির সূচক। অর্থাৎ মার্ক্সের সিদ্ধান্ত ভ্রান্ত প্রমাণিত হয়নি।
আরও পড়ুন, নিঃসঙ্গতার একশ বছর
অসাধারণ মেধা ছিল, প্রবেশিকা পরীক্ষা থেকে স্নাতকোত্তর পরীক্ষা অব্দি ক্রমান্বয়ে সর্বোচ্চ স্থান বিচার করেই সেই মেধার পরিমাপ। মেধার জন্যেই তিনি ধূর্জটিপ্রসাদ মুখোপাধ্যায়ের মত কিংবদন্তিপ্রতিম প্রজ্ঞাবান চিন্তাবিদের সমীপবর্তী হয়েছিলেন। তাঁর মনন ও চিন্তনের সোপান গড়ে তোলায় অনুঘটক ছিলেন ধূর্জটিপ্রসাদ, সেই সময় ডঃ মিত্র লখনউ বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থবিজ্ঞানের অধ্যাপক।
তাঁর যেমন ছিল তীক্ষ্ন অম্ল জিহ্বা ( ইংরেজিতে যাকে বলে ‘অ্যাসিড টাংগ’), তেমনি বুদ্ধিদীপ্ত তির্যকতা। একবার রাজ্যের বাজেট পেশ করার পরে প্রথামত সাংবাদিক সম্মেলনে এক সাংবাদিক (যিনি ছিলেন কমিউনিস্ট-বিদ্বেষী, মাঝে মাঝে ডঃ মিত্রের বক্তব্য বিকৃত করতেন) প্রশ্ন করলে সহাস্যে বললেন, ‘ যা খুশি, যেমন খুশি লিখুন। রূপকথা পড়তেও ভালো লাগে’। কিন্তু সেই টিপ্পনি সে সাংবাদিকদের মাথার ওপর দিয়ে গেল।
অসাধারণ আত্মকথা ‘আপিলা চাপিলা’য় শ্লেষাত্মক ভাষায় সিপি আই(এম) ও বামফ্রন্টকে তুলোধোনা করে লিখলেন – ‘বশ্যতা বনাম দক্ষতা’ অর্থাৎ যাঁরা উঁচু পদে বা বড় দায়িত্বে উঠে আসছে, তাঁদের আগে প্রমাণ করতে হবে বশ্যতা, দক্ষতা নয়। বিষবৃক্ষ যে রোপিত হচ্ছে, তা আঁচ করতে পাচ্ছিলেন।
জীবনের প্রান্তে এসে এক সাময়িকীতে সাক্ষাৎকারে বলেছিলেন , “জীবনে এ-পাড়া, ও-পাড়া, বে-পাড়া, সৌভাগ্যের চুড়োয় উঠে যাওয়া দেশ, উচ্ছন্নে যাওয়া দেশ, সাদামাটা ম্যাড়মেড়ে দেশ অনেক ঘোরা হয়েছে। কিন্তু কোথাও আর সেই ঝাঁকা-মুটের রান্নার সম্ভারের গন্ধের তুলনা পাইনি। পাইনি স্টিমারের রান্না মুরগির মাংসের সেই পরমাশ্চর্য গন্ধ – এই যুগ্ম গন্ধের স্মৃতি আমাকে হঠাৎ আবার জীবনের চরিতার্থতা কী, তা নিয়ে নতুন করে ভাবতে শেখায়।“
আরও পড়ুন, নন্দীগ্রামে দ্বিধাবিভক্ত হয়েছিলেন লেখক-শিল্পীরাও
একটা খেদ রয়ে গেল। তাঁর সম্পাদিত ‘আরেকরকম’ পাক্ষিকে ‘স্মৃতি-বিস্মৃতি’তে উঠে আসছিল ‘আপিলা চাপিলা’র অসমাপ্ত কথামালা। সেসব অসমাপ্তই রয়ে গেল।