একটা কোন দেশ, তার মধ্যে পুবের দিকে দুয়োরানি রাজ্য। সেখানকার কোন একটা নাম না জানা গ্রাম। সেই গ্রামে একটা ছোট্ট মেয়ে এক্কাদোক্কা খেলতেই পারে। ভাগ্যিস দেশের আইনে এখনও কোন ধারাবলে কিতকিতের ওপর নিষেধাজ্ঞা জারি করা হয় নি। বৃষ্টি হচ্ছে ছিপছিপ, মা-বাবা কাজে ব্যস্ত, মেয়ে আর ইস্কুলে যায় নি। কীই বা হবে গিয়ে? সেখানেও তো আর ধারাপাত হবে না, বরং মাথার ওপরের আধচালার ফাঁক দিয়ে উঁকি মারবে বৃষ্টির ফোঁটা। পড়াশোনা তো শিকেয়, আর ছোটবেলায় অত পড়ারই বা কী আছে?
তাই কিছুটা দূরে অন্য লোকের ক্ষেতে বাবা যখন পাটচাষে ব্যস্ত, আর মা আধকাঁচা ঘরে সংসার সামলানোয়, তখন ভিজে মাটিতে ভাঙা খুরির টুকরো দিয়ে আয়তক্ষেত্র এঁকে জ্যামিতি শেখা যায় অনেক বেশি। এক খোপ থেকে অন্য খোপে ছোট্ট ছোট্ট লাফ। এক একটা খোপ যেন এক একটা দেশ। বিশ্বনাগরিক লাফ মারছে এক দেশ থেকে অন্য দেশে, ভিসা-পাসপোর্ট ছাড়াই। আর লাফ না মেরে করবেই বা কী?
আরও পড়ুন: আসাম এনআরসি: উৎকণ্ঠার অবসান নাকি উৎকণ্ঠার সূত্রপাত?
একটু দূরে মফস্বলের নাম যদি হয় ঈশ্বরীঝাড়, পাশের শাখানদী যদি গড়িয়ে আসে ব্রহ্মপুত্র থেকে, জেলা বঙ্গাইগাঁও, রাজ্য আসাম, দেশ ভারত, তাহলে যে কোনও দিন ছোট্ট একটা মেয়ে দেশহীন হয়ে যেতেই পারে। বাবার নাম নূর হাসান, মেয়ের নাম সোফিয়া খাতুন (লোরেন নয়), বয়স আট। বাবার নাম উঠেছে নাগরিকত্বর খাতায়, মায়েরও। কিন্তু সময়টাই এমন যে হেমন্তের নয়, বর্ষাকালের পোস্টম্যান চিঠি পৌঁছে দিয়েছে বাবার হাতে। তাতে রাষ্ট্র চোখ লাল করে জানাচ্ছে যে মেয়ের নাগরিকত্বে গোলমাল আছে। ২০১৮-র জুন মাসে প্রথম চোটে যেসব নাম উঠেছিল, তাতে কিন্তু মেয়ের নাম ছিল। তারপরেও এই চিঠি।
এদিকে বৃষ্টি আসছে অধিক তীব্রতায়, নদীর জলে ভাসছে গ্রাম। ঘরবাড়ি ছেড়ে অনেক দূরের কোন একটা ইস্কুলবাড়িতে গিয়ে থাকতে হচ্ছে। এর মধ্যেও কিন্তু হাসান সাহেব হাজার তিনেক টাকা বাঁচিয়ে রেখেছেন। যে ভাবেই হোক সময়মত পৌঁছতে হবে অভয়পুরীতে।
সে অফিসে পৌঁছতে কষ্ট হলো অনেক, খরচ হলো আরও অনেক বেশি। তবে হিন্দুস্তানে গরিব মুসলিমের জন্যে যে থাকার জায়গা হচ্ছে এই না কত। অফিসার তো অবাক, “আহা রে, কী মিষ্টি মেয়ে। এ মেয়ে আমাদের দেশের নাগরিক নয় এমনটা হতেই পারে না। ছি! ছি! কোথাও একটা কেউ ভুল করেছে। তার জন্যেই এতো অশান্তি। সব ঠিক করে দিচ্ছি, আপনি বাড়ি চলে যান।” মেয়ের মাথায় হাত বুলিয়েছে অফিসার। মনটা ভরে গেল নূরের। অফিসারই তো আসল দেশসেবক। তবু কোথায় যেন গলায় বেঁধে সরু কাঁটা। নূর ভাই তাই শান্তিতে নেই আজও। কিছু একটা লিস্ট নাকি বেরিয়েছে কোন এক ইন্টারনেটে। আজকেই সেই তারিখ, ৩১ অগাস্ট। নামতা না শেখা মেয়ের নামটা খেরোর খাতায় উঠলো তো?
সংবাদমাধ্যম থেকে অণুগল্প তো টোকা হল। এবার একটু ফিরে তাকান আধারের দিকে। সেই খাতায় নম্বর তুলতে গিয়ে শহরের মধ্যবিত্ত বাঙালি পর্যন্ত কেঁদে ভাসিয়েছে। লম্বা লাইন, আঙুলের ছাপ আর চোখের ছবি তুলেও বারবার ব্যর্থ হওয়া। আজকের দিনেও সেই হয়রানি চলছে। যদি কোনও একটা ভুল থেকে থাকে, তাহলে ভোর চারটেতে গিয়ে লাইন দিতে হচ্ছে কোনও রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাঙ্কের সামনে। সেখানে দিনে মাত্র কুড়ি জনের তথ্য ঠিক করা হবে, তার বেশি নয়। একটা পাসপোর্ট বানাতে গেলে গেলে এখনও এ দেশে মানুষের বুক ধুকপুক করে। সেই পরিস্থিতিতে যদি বারবার যদি নাগরিকত্বের প্রমাণ দিতে হয় তাহলে কিন্তু মহা বিপদ।
আরও ভয়ঙ্কর অবস্থা গরীব মানুষের। মধ্যবিত্ত শেষমেশ তিন চারবার ধর্না দিয়ে, বাংলার বদলে ইংরিজি বলে, রেশন কার্ড থেকে ভায়া আধার, পাসপোর্ট পর্যন্ত বানিয়ে ফেলে। কিন্তু দেশের বেশির ভাগ মানুষ তো আর মধ্যবিত্ত নন। তাঁদের সামনে কিন্তু যে কোনও রকমের প্রমাণপত্র জোগাড় করা ভীষণ শক্ত। আর একবার যোগাড় করেও লাভ নেই খুব। ভাবুন তো, আধারের পাতায় বড় বড় অক্ষরে লেখা আছে 'আধার পরিচয়ের প্রমাণ, নাগরিকত্বের প্রমাণ নয়'।
এমন একটা জিনিস বানাব কেন যাতে আমার পরিচয়ের মধ্যে দেশটাই না থাকে? এ তো চরম আন্তর্জাতিকতাবাদ - ভারত নামক রাষ্ট্র আধার নামক এক ব্যবস্থার মাধ্যমে কোনও ব্যক্তির পরিচয় ঠিক করে দেয়, কিন্তু নাগরিকত্বের দায় নেয় না। তাই বোধহয় আধার আমাদের বিশ্বপরিচয়। ব্যঙ্গ ছেড়ে যুক্তির কথা ভাবলে মাথা খারাপ হয়ে যাবে, কারণ এই আধার কার্ড আবার কাজে লাগে পাসপোর্ট বানানোর সময়। তবে এই সমস্ত পরিচয়পত্র বা নাগরিকত্বের প্রমাণ যখন তখন বদলে যেতে পারে। খুব শক্তিশালী একজন মানুষ ঠিক করে দেয়, বাকি দুর্বলদের পরিচয় কী হবে।
আরও পড়ুন: অসম এনআরসি: কীভাবে দেখবেন নামের তালিকা? জেনে নিন
একসময় কংগ্রেস আর তাদের নেতানেত্রীরা ছিলেন বিশেষ শক্তিশালী। সেই সময় তাঁরা ঠিক করেছিলেন যে নাগরিকত্বের একটা খাতা বানাতে হবে। কংগ্রেস আবার সব কিছু মনে রাখতে পারে না। ফলে একসময় খাতা বানাবে বলে তারা সুবিধেমত তা ভুলে গিয়েছিল। কিন্তু বিজেপি তো আর বিশেষ কয়েকজন নেতানেত্রীর ফ্যান ক্লাব নয়। তাদের পেছনে আছে রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সংঘ এবং তাদের চিন্তনদল। ফলে কংগ্রেসের প্রবর্তিত আধার কার্ড তারা জোড়া লাগিয়েছে জীবনের প্রতিটি ওঠাপড়ার সঙ্গে। সেই রকমই জাতীয় নাগরিকপঞ্জী। কংগ্রেসের ভাবনা, বিজেপির রূপায়ণ।
আসামের ক্ষেত্রে নাগরিকত্বের শর্ত পরিষ্কার। প্রত্যেকটি মানুষকে প্রমাণ করতে হবে যে তিনি বা তাঁর পুর্বপুরুষ (বাবা বা মা যে কোনও একদিক দিয়ে রাস্তা বেরোলেই হবে) ১৯৭১ সালের ২৪ মার্চের মধ্যরাতের আগে (বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ শুরুর দিন) ভারতে থাকতেন। শর্তটি আপাতদৃষ্টিতে পরিষ্কার হলেও জটিলতা আছে অন্য জায়গায়। সেটা হলো এই নিয়মটি কিন্তু ভারতের অন্যান্য জায়গার থেকে আলাদা। ভারতের নাগরিকত্বের যে বিধান, তাতে ১৯৫০ খ্রিষ্টাব্দের ২৬ জানুয়ারি থেকে ১৯৮৭ সালের ১ জুলাই-এর মধ্যে দেশের মাটিতে জন্মালেই সাতখুন মাফ, সরাসরি ভারতবর্ষের নাগরিক।
কিন্তু আসামের ক্ষেত্রে বিষয়টা এরকম নয়। বরং ১৯৭১ থেকে ২০০৪-এর মধ্যে জন্মানো এই রাজ্যের লোকজনকে ১৯৭১ এর আগে ভারতে থাকা পূর্বপুরুষ খুঁজে বার করতে হবে। ২০০৪ এর ৩ ডিসেম্বরের পর আসামে জন্মালে আরও বখেড়া। তখন দেখাতে হবে যে বাবা এবং মা, এই দুদিক থেকেই ১৯৭১-এর আগে পূর্বপুরুষ আবিষ্কার করা যাচ্ছে। বুঝতেই পারছেন যে দেশটা ভারতবর্ষ। এই খাতা লেখার কাজ করতে হয়েছে ৩ কোটির বেশি মানুষের জন্য। আর ২০ লক্ষের কাছাকাছি মানুষ ঠিকঠাক কাগজ জোগাড় করে উঠতে পারেন নি নিজেদের নাগরিকত্বের প্রমাণের। এর মধ্যে অনেকেই যে হতদরিদ্র এবং সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ভুক্ত, সেটা বলতে পারার জন্যে কোনও পুরষ্কার নেই।
তবে নিয়মগুলো কেন এমন হলো, এর পেছনে কংগ্রেস, বিজেপি বা তৃণমূলের রাজনীতি কী, এসব আলোচনা করে আর লেখা বাড়িয়ে লাভ নেই। ২০১৯ সালের ৩১ অগাস্ট যে এই ভারতের কয়েক কোটি মানুষের নাগরিকত্ব নতুন করে প্রমাণ হলো, একথা অস্বীকার করা যায় না। যে ২০ লক্ষের মত মানুষ এই পরীক্ষায় অকৃতকার্য হলেন, তাঁদের আর দেশ রইল না। একবার ভাবুন তো, পায়ের নিচের মাটিটা হঠাৎ করে নিজের দেশ নয় জানলে কী অনুভূতি হয়? তবে আসামের মত একটা আর্থিকভাবে পিছিয়ে থাকা রাজ্যের হতদরিদ্র মানুষ তো, রাষ্ট্রের কাছে তাদের অনুভূতির দাম কিছুটা কম। আপাতত তাই তাঁদের থাকার জায়গা গাদাগাদি করে, আর দেশের মুখ চেয়ে। সেই অসহায় মানুষগুলো আর কিছু না পান, ভয় তাঁদের পেতেই হবে।
আরও পড়ুন: আসাম এনআরসি: তালিকায় থাকবে না বহু শিশুর নাম
সবশেষে একটু রাশিবিজ্ঞানের কথায় আসা যাক। যে কোনও প্রক্রিয়ার ফলাফল বিশ্লেষণ করলে কয়েকটি বিষয় অনুধাবন করা যায়, নাগরিকত্বের ক্ষেত্রেও তাই। ধরা যাক কিছু নিয়মের ভিত্তিতে একজন সত্যি নাগরিক। তাঁকে নাগরিক বলেই চিহ্নিত করা হল। এতে কোনও ভুল নেই। কিন্তু ধরুন কোনও একটা গোলমালে বলা হলো, তিনি নাগরিক নন। এটা এক রকমের ভুল, নাম দেওয়া যাক 'পয়লা নম্বরের ভুল'। সেই নিয়মগুলোর ভিত্তিতেই মানা যাক, কেউ সত্যিই এদেশের নাগরিক নন। টুক করে তারকাঁটা পেরিয়ে ঢুকে পড়েছেন মহান ভারতবর্ষে। তাঁকে খুঁজে পেয়ে বলা হলো, ইনি নাগরিক নন মোটেই। সেটাও ঠিক।
কিন্তু তিনি যদি নেতা ধরে কিংবা কিছু খরচা করে নিজেকে নাগরিক বলে চালাতে পারেন, তাহলে সেটাও একটা ভুল। এর নামকরণ হোক 'দু'নম্বরি ভুল'। সরকারের দায়িত্ব, এই দু'ধরনের ভুলকেই যথাসম্ভব কমানো। কিন্তু একটু ভাবলে বুঝতে পারবেন যে কোনও এক ধরনের ভুলকে ভীষণ কমাতে গেলে অন্য ধরনের ভুল অনেকটা বেড়ে যেতে পারে। অর্থাৎ সরকার যদি দৃঢ়প্রতিজ্ঞ হয় যে অনুপ্রবেশকারীদের যতটা সম্ভব বেশি খুঁজে বের করে ক্যাম্পে পাঠাবে, তাহলে কিন্তু অনেক সঠিক নাগরিকও সেই চক্করে বিপদে পড়বেন। কারণ আর্থিকভাবে পিছিয়ে থাকা মানুষের পক্ষে ঠিকঠাক নথি যোগাড় করা বেশ শক্ত। যে পদ্ধতিতে সেনাবাহিনীর কর্মী থেকে প্রাক্তন স্বাধীনতা সংগ্রামী এবং সেইসঙ্গে শিক্ষিত, স্বচ্ছল মানুষের নাম নাগরিকপঞ্জীতে ওঠে না, সেখানে পয়লা নম্বরের ভুলটা যে কত মারাত্মক, তা বলাই বাহুল্য।
অর্থাৎ এ বিষয়ে কোন সন্দেহই নেই যে আমাদের দেশের বেশ কিছু নাগরিক এই মুহূর্তে দেশ হারিয়েছেন পদ্ধতির ভুলে। অমিত পরাক্রমশালী দেশনেতা এরপর সারা দেশে পঞ্জিকা বানাবেন বলেছেন। এই সরকার ক্ষমতায় থাকলে মানুষের নাগরিকীকরণ হয়তো বেশ কয়েকটি দশকের মধ্যেই সম্পন্ন হবে। তারপর? এখনও জন্মান নি এমন বাছুরেরা সাবধানে থাকবেন। মানুষের সমস্যা মিটলে তখন আপনারাই পরবর্তী লক্ষ্যবস্তু। বেঁচে থাকা গোকুল তাই বংশধরদের সুবিধার্থে ২০১৯ খ্রিস্টাব্দের ৩১ অগাস্টের আগে এদেশে থাকার প্রমাণপত্র তৈরি রাখুন। যে বাঁশের খুঁটিতে আপনি বাঁধা, সেখানেই ঝুলিয়ে রাখুন আপনার নাগরিক পরিচিতি - সরকারের নাকের ডগায়।
(লেখক ইন্ডিয়ান স্ট্যাটিস্টিক্যাল ইন্সটিটিউটের অধ্যাপক, মতামত ব্যক্তিগত)