Advertisment

এন আর সি ও আসামে 'বিদেশি পাকড়াও' করার নানা হাতিয়ার

রাজ্য সরকার ট্রাইব্যুনালের বিচারকদের চুক্তিভিত্তিক চাকরি দেন, আবার সরকারই ট্রাইব্যুনালে মামলা লড়েন। “কনফ্লিক্ট অফ ইন্টারেস্ট” শব্দবন্ধ সরকার বাহাদুরের অজানা।

author-image
IE Bangla Web Desk
New Update
Assam NRC, Foreigners Tribunal

ফাইল ছবি- ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেস

কয়েকদিন আগে আসামে জাতীয় নাগরিকপঞ্জি কাটছাঁট করা হল। নাগরিকপঞ্জির খসড়া বেরিয়েছিল গত বছরের জুলাই মাসে। খসড়াতে চল্লিশ লক্ষ আসামবাসী ঠাঁই পান নি। এবছরের জুনে জানানো হল, চল্লিশ নয়, আরও এক লক্ষ যোগ করতে হবে, মোট একচল্লিশ লক্ষ মানুষ বৈধতা হারাতে পারেন। চূড়ান্ত নাগরিকপঞ্জি বেরোনোর কথা চলতি মাসের ৩১ তারিখে।

Advertisment

বাড়তি এক লক্ষকে নাগরিকপঞ্জি থেকে বাদ দেওয়া হল কেন? তাহলে বিদেশি পাকড়ানোর পদ্ধতি নিয়ে দুটো কথা বলতে হয়। আসামে বিদেশি ধরার একাধিক হাতিয়ার রয়েছে। একটা হল, “ফরেনার্স ট্রাইব্যুনাল” বা বিদেশি আদালত। ট্রাইব্যুনালগুলো অনেকদিন ধরে কাজ করছে। এগুলো আধা-আদালত জাতীয় জিনিস, আক্ষরিক অর্থে আদালত নয়। ধরুন পুলিশ নালিশ করল অমুক রামচন্দ্র রায় বিদেশি (রায় দেখে বাঙালি ভাবার কারণ নেই, রাজবংশীদের রায় পদবী হয়)। এবার ট্রাইব্যুনাল রামবাবুকে সমন পাঠাবে। রামবাবু উকিল লাগিয়ে প্রমাণ করবেন উনি বিদেশি নন। না পারলে পুলিশ গ্রেফতার করে ডিটেনশন ক্যাম্পে পাচার করতে পারে। এক লক্ষেরও বেশি মানুষকে ট্রাইব্যুনাল বিদেশি ঘোষণা করেছে। এর ৬০%-এরও বেশি ক্ষেত্রে অভিযুক্তের অনুপস্থিতিতে ট্রাইব্যুনাল “এক্স পার্টে” রায় দিয়েছে, মানে অভিযুক্তের অনুপস্থিতিতে একপেশে রায়।

ডিটেনশন ক্যাম্পে অবশ্য সব “বিদেশি”কে পাঠানো হয় নি। গোটা ছয়েক ডিটেনশন ক্যাম্পে এক হাজার মানুষ বন্দি আছেন। ক্যাম্পগুলো আসলে জেলেরই একটা অংশ।

বিদেশি পাকড়াও করার দ্বিতীয় পন্থা জাতীয় নাগরিকপঞ্জি, বা এন আর সি। সমস্ত রাজ্যবাসীকে দলিল দস্তাবেজ দিয়ে নিজেদের জায়েজ নাগরিকত্ব প্রমাণ করতে হচ্ছে। এন আর সি চলছে চার-পাঁচ বছর ধরে। প্রায় তিন কোটি তিরিশ লক্ষ মানুষ আবেদন করেছিলেন, একচল্লিশ লক্ষকে নাকচ করা হয়েছে। এঁরা নাগরিকত্ব হারাতে পারেন।

আরও পড়ুন, ফরেনার্স ট্রাইবুনাল কী ভাবে কাজ করে

একই কাজের জন্য দুটো সমান্তরাল প্রক্রিয়া চললে ধন্দ জাগে কোনটা চূড়ান্ত। কেউ যদি এন আর সি’তে বৈধ থাকেন কিন্তু ট্রাইব্যুনালে অবৈধ হন, তিনি অবৈধ না বৈধ? বহু গড়িমশির পর কত্তারা ঠিক করেছেন যাঁরা ট্রাইব্যুনালে বিদেশি সাব্যস্ত হয়েছেন তাঁরা এন আর সি থেকেও বাদ পড়বেন। মানে দাঁড়াল ট্রাইব্যুনাল চূড়ান্ত। ট্রাইব্যুনালে হারলে হাই কোর্ট, সুপ্রিম কোর্ট।

এবার বোঝা যাবে বাড়তি এক লক্ষ মানুষকে এন আর সি থেকে বাদ দেওয়া হল কেন। যাঁরা ট্রাইব্যুনালে বিদেশি সাব্যস্ত তাঁদের এন আর সি থেকে বাদ দেওয়ার কথা। গেল বছর এন আর সি খসড়া বানাতে গিয়ে কিছু লোককে ভুল করে বাদ দেওয়া হয় নি। এবছরের বাড়তি এক লক্ষে তাঁরা ঢুকেছেন। দ্বিতীয়ত, কেউ ট্রাইব্যুনালে বিদেশি প্রমাণিত হলে তার পরিবারের সবাইকে বিদেশ ধরে নেওয়া হচ্ছে, যদিও পরিবারের অন্য লোকেদের বিরুদ্ধে প্রমাণ নেই! রামবাবু ট্রাইব্যুনালে বিদেশি সাব্যস্ত হলেন, তক্ষুনি ধরে নেওয়া হল ওনার পরিবারের সবাই বিদেশি। এঁরা কেউ এন আর সি’তে জায়গা পাবেন না। গেল বছর জুলাইয়ে যে খসড়া এন আর সি বেরিয়েছিল তাতে পরিবারের সদস্যদের বাদ দিতে গাফিলতি হয়েছিল। বাড়তি এক লক্ষে তাঁরাও এসেছেন।

লক্ষ্যণীয়, রামবাবু ও তার পরিবার এন আর সি’র ঠিকঠাক দলিল দস্তাবেজ দিয়ে থাকতে পারেন। খতিয়ে দেখার পর তাঁদের নাম এন আর সি খসড়ায় তোলা হয়েছিল। কিন্তু সীতাকে বারবার অগ্নিপরীক্ষা দিতে হয় কিনা। ট্রাইব্যুনালে ফেল করলেই, গুষ্টিশুদ্ধু বাংলাদেশি।

আরও পড়ুন, বিদেশি খেদা আন্দোলন করে জেল খেটেও নাম নেই এনআরসি তালিকায়

কয়েকটা প্রশ্ন উঠতে পারে। প্রথম কথা, ট্রাইব্যুনালকে যদি চুড়ান্ত ধরা হয় তাহলে ১২২০ কোটি টাকা খরচ করে, রাজ্যশুদ্ধু পাবলিকের হয়রানি করে, বহু সংখ্যালঘুর মৃত্যু ঘটিয়ে এন আর সি মহাযজ্ঞ করার কারণ কী?

দ্বিতীয়, ফরেনার্স ট্রাইব্যুনাল চূড়ান্ত, অথচ ট্রাইব্যুনালের কার্যকলাপ দেখে ভরসা জাগে কই? বেশি বেশি বিদেশি রায় দিতে না পারলে ট্রাইব্যুনালগুলোর বিচারকদের চাকরি যাচ্ছে। লক্ষ্যণীয়, রাজ্য সরকার ট্রাইব্যুনালের বিচারকদের চুক্তিভিত্তিক চাকরি দেন, আবার সরকারই ট্রাইব্যুনালে মামলা লড়েন। “কনফ্লিক্ট অফ ইন্টারেস্ট” শব্দবন্ধ সরকার বাহাদুরের অজানা। ফলাফল হল, কখনও অকারণে, কখনও সামান্য অজুহাতে বিদেশি রায় দেওয়ার হিরিক পড়েছে। ক’দিন আগে সানাউল্লাহ, মধুবালা মণ্ডলের কথা খবরে এসেছিল। সানাউল্লাহ ভারতীয় সেনাবাহিনীতে ছিলেন, অবসর নিয়েছেন। ওঁকে যে দস্তাবেজের ভিত্তিতে ট্রাইব্যুনাল বিদেশি রায় দেয় তাতে সানাউল্লাহের জাল সই ছিল বলে অভিযোগ। সর্বভারতীয় মিডিয়ায় সোরগোল হওয়ার পর ডিটেনশন ক্যাম্প থেকে রেহাই পান সানাউল্লাহ। মধুবালা মণ্ডলকে আড়াই বছর বন্দি থাকতে হয় কেননা এক মধুবালা দাসকে ট্রাইব্যুনাল বিদেশি ঘোষণা করেছিল।

কিছু ক্ষেত্রে হাই কোর্টে বা সুপ্রিম কোর্টে আপিল করে ট্রাইব্যুনালের রায় পালটানো গেছে। গরিব খেটে খাওয়া মানুষের আদালতের চক্কর কেটে, জুতোর সুকতলা ক্ষইয়ে, উকিল ভাড়া করে লড়ার ক্ষমতা কই। ট্রাইব্যুনালের শিকার বা এন আর সি’র উদ্বেগে আত্মহত্যা করা লোকগুলোর সিংহভাগ দিন আনি দিন খাই হতদরিদ্র সংখ্যালঘু মানুষ। বেশিরভাগ পূর্ববঙ্গ মূলের মুসলমান ও নিম্নবর্ণ হিন্দু। রাজবংশী, চা-জনজাতি, নেপালি, বিহারিও পাওয়া যাবে। বাঙালি জাতীয়বাদীদের প্রচারে কথা কান দেওয়ার দরকার নেই।

বস্তুত, শুদ্ধ নাগরিক নির্মাণের মহান প্রকল্পে যাঁদের বিস্তর ক্ষতি হচ্ছে তাঁরা নিজেদের বাঙালি বলে পরিচয় দেন না। উনিশ শতকের শেষপ্রান্ত থেকে বিশ শতকের অনেকখানি জুড়ে পুববাংলা থেকে বিপুল পরিমাণে মুসলমান চাষি আসামে বসতি স্থাপন করেন। ব্রহ্মপুত্র উপত্যকার পশ্চিম ও মধ্য অংশের জনসংখ্যার বড় ভাগ এই সম্প্রদায়ের। জমির টানে এঁরা এসেছিলেন। বলা ভাল আনা হয়েছিল। উপনিবেশি রাষ্ট্রযন্ত্র ব্রহ্মপুত্রের চর ও পারের নাবাল জমি বাঙালি চাষিদের লাগিয়ে চাষ ও রাজস্বের আওতায় আনছিল। গোয়ালপাড়ার জমিদাররাও উৎসাহ যোগাচ্ছিলেন। মৈমনসিংহ, উত্তরবাংলার সেই মুসলমান চাষিদের উত্তরপুরুষেরা আজ নিজেদের অসমিয়া হিসেবে পরিচয় দেন, অসমিয়া স্কুলে বাচ্চাদের পাঠান। ভূমিপুত্র রাজনীতির ধ্বজাধারী উগ্র জাতীয়তাবাদীদের চোখে অবশ্য ওঁদের অসমিয়াত্ব শুন্য। আট দশকের আন্দোলনের হত্যাকাণ্ডগুলোর অন্যতম শিকার এই তথাকথিত “মিঞা”রাই (উর্দুতে মিঞা মানে ভদ্রলোক, কিন্তু আসামে শব্দটা বঙ্গমূলের মুসলমানদের জন্য তাচ্ছিল্যার্থে ব্যবহার হয়)। বিদেশি পাকড়াও প্রকল্পের মার মিঞা বা “ন-অসমীয়া”দের (নয়া অসমিয়া) উপর যথেচ্ছ পড়ছে।

অসমিয়া উগ্র জাতীয়তাবাদীদের দাবি থেকে একদা বিদেশি পাকড়াও করার সরকারি কার্যক্রম প্রস্তুত হয়। সংখ্যাগুরু রাজনীতির ফায়দা তোলার লক্ষ্যে কংগ্রেস তাতে ইন্ধন জুগিয়েছে। তারপর বিজেপি এন আর সি, ডিটেনশন ক্যাম্পগুলোকে আপন করে নিয়েছে।

এবার ওরা গোটা দেশে “আসাম মডেল” ছড়িয়ে দেবে। জাতীয়তাবাদীদের মধ্যে মিল থাকা জায়েজ।

(দেবর্ষি দাস গুয়াহাটি আইআইটি-র অধ্যাপক)

Assam nrc
Advertisment