লন্ডন শহর থেকে কিছু দূরে এক নির্জন পার্কের বেঞ্চে এক বৃদ্ধ বসে রোদ পোহাচ্ছিলেন। হঠাৎ সেখানে এক প্রৌঢ় ব্রিটিশ ব্যক্তি এসে সেই বৃদ্ধের দিকে আঙ্গুল তুলে ক্রুদ্ধস্বরে বললেন, "আপনি কে? কোন দেশ থেকে এসেছেন? আমার দেশে আপনি কেন?" জবাবে বৃদ্ধ মুচকি হেসে বললেন, "আমরা আসলে ক্রেডিটর। ধার দিই।" ভদ্রলোকের জন্ম ভারতে। সারা জীবন ঔপনিবেশিক কেনিয়াতে চাকরি করেন, তারপর লন্ডনে অবসর নেন। প্রশ্নের জবাবে আরও বললেন, "তোমরা আমাদের সমস্ত সম্পদ একদিন লুট করেছিলে, এমনকি আমাদের হীরে-জহরতও। এখন এসেছি সেগুলো ফেরত নিতে।"
নিউ ইয়র্ক বিশ্ববিদ্যালয়ে সাংবাদিকতার অরধ্যাপক সুকেতু মেহতার দাদামশাই ছিলেন ওই প্রবীণ ভারতীয়। সুকেতু এই গপ্প শুনিয়ে বলছেন, তিনি গুজরাতি। তাঁর ঠাকুরদা কলকাতায় চলে আসেন। সুকেতুর জন্ম কলকাতায়। তারপর গত ৪০ বছর ধরে তিনি আমেরিকায়। সুকেতু সম্প্রতি প্রকাশিত তাঁর 'দ্য ল্যান্ড ইজ আওয়ার ল্যান্ড - অ্যান ইমিগ্রান্ট’স ম্যানিফেস্টো' গ্রন্থে লিখেছেন, "ধনী দেশগুলি অপেক্ষাকৃত দরিদ্র দেশগুলি সম্পর্কে বলে, ওরা আমাদের দেশে লোক ঢোকাচ্ছে আর্থিক কারণে। কিন্তু প্রথমে ধনী দেশগুলি উপনিবেশ তৈরি করে শোষণ চালিয়েছে, আমাদের শিল্পের বিকাশে বাধা দিয়েছে, নিজেদের শ্রীবৃদ্ধিতেই তাদের মন ছিল। এরপর এখন তারাই বলছে, অবৈধ অনুপ্রবেশ বন্ধ করতে হবে। এদেশ শুধু আমাদের নাগরিকের জন্য।"
আসামে নাগরিকপঞ্জি (এনআরসি) প্রকাশিত হওয়ার পরেও দেশজুড়ে বিতর্ক শুরু হয়েছে। নাগরিকপঞ্জি থেকে আবারও বাদ পড়ল ১৯ লক্ষ নাম। সুপ্রিম কোর্টের নির্দেশেই ৩১ অগাস্টের মধ্যে এই তালিকা প্রকাশ করতে বাধ্য হয়েছে ভারত সরকার। ঘটনাচক্রে সুপ্রিম কোর্টের প্রধান বিচারপতি রঞ্জন গগৈ নিজেই অহমিয়া। এই ঘোষণার রাজনৈতিক প্রতিক্রিয়া হয়েছে তীব্র। আসামে রাজ্য সরকার বিজেপির। বিজেপির বক্তব্য, ১৯৫১ সালের পর থেকে আসামে যাঁরা অবৈধভাবে বসবাস করেছেন, তাঁদের চিহ্নিত করে তাঁদের মাতৃভূমিতে ফেরত পাঠানো হবে। তবে উদ্বাস্তু হিন্দু শরণার্থীরা থাকবেন, স্রেফ মুসলিমদের অনুপ্রবেশকারী বলে চিহ্নিত করে ফেরত পাঠানো হবে।
এই ক্ষেত্রে হিন্দু-মুসলমান এই ভেদনীতিকে ভারতের বিরোধী নেতারা বলেছেন সাম্প্রদায়িকতা। ভোটের রাজনীতির ফলে আসামে হিন্দু-মুসলমান সম্পর্কের আরও অবনতি হবে, এবং সেই মেরুকরণের রাজনৈতিক ফায়দা নেবে বিজেপি। বিজেপির বক্তব্য ভিন্ন। বিজেপির বক্তব্য হলো, বাংলাদেশের মত রাষ্ট্রে মুসলমানরা সংখ্যাগরিষ্ঠ, হিন্দুরা সংখ্যালঘু। সুতরাং সংখ্যাগরিষ্ঠ মুসলমানদের কোনও নিরাপত্তার অভাববোধ নেই, তাঁরা জীবিকার সন্ধানে ভারতে আসছেন। কিন্তু হিন্দুরা বাধ্য হয়ে নিরাপত্তার অভাবে এসেছেন। যেভাবে শ্রীনগর থেকে একদা কাশ্মীরের হিন্দু পণ্ডিতরা চলে আসতে বাধ্য হন।
আমি জানি, এই দৃষ্টিভঙ্গিতে হাসিনা সরকার খুবই ক্ষুব্ধ। হাসিনা সরকার ভারতের প্রধানমন্ত্রীর কাছেও সেই বার্তা জানিয়ে দিয়েছে। বাংলাদেশের আরও অভিযোগ যে, ভারত সরকার ঢাকাকে এ ব্যাপারে তাদের ভবিষ্যত কর্মসূচী জানায় নি। একে রোহিঙ্গা সমস্যা নিয়ে ঢাকা চাপের মধ্যে, সেখানে আসামের কোনও বাসিন্দাকে বাংলাদেশী বলে চিহ্নিত করাটা বাংলাদেশের কাছে আদৌ কাঙ্খিত ঘটনা নয়। এই অ-নাগরিক বলে চিহ্নিত ব্যক্তিদের কোথায় রাখা হবে? আসামে না অন্যত্র? ডিটেনশন শিবিরে কতদিন তাঁরা থাকবেন? এছাড়া বাংলাদেশে হাসিনা-সরকার-বিরোধী জামাত-খালেদার বিএনপি এবং মোল্লাতন্ত্র ইতিমধ্যেই ভারতের এই অভ্যন্তরীণ রাজনীতির আগুনে রাজনীতির রুটি সেঁকতে শুরু করে দিয়েছেন। এর ফলে ঢাকাতেও উঠেছে উগ্র সাম্প্রদায়িকতার ঝড়।
আবার মনে রাখতে হবে, অসাম মানে শুধু হিন্দু বনাম মুসলমান নয়। বিষয়টি বাঙালি বনাম অবাঙালিও হয়ে উঠেছে। অতীতে 'বাঙালি খেদাও' আন্দোলন হয়েছে এই আসামেই। ১৯৮৫ সালে প্রধানমন্ত্রী রাজীব গান্ধী প্রফুল্ল মোহান্তর আসাম গণ পরিষদের (অগপ) সঙ্গে চুক্তিবদ্ধ হন। তখন অগপ-র বক্তব্য ছিল, ১৯৭১ সালের পর যাঁরা আসামে এসেছেন, সেইসব বাঙালিদের চলে যেতে হবে। এখন নাগরিকপঞ্জির মূল বিষয় হলো, ১৯৫১ সালের পর যাঁরা আসামে বেআইনিভাবে বসবাস করছেন, তাঁদের চিহ্নিত করা হচ্ছে। আনুষ্ঠানিকভাবে এটি বলা হলেও এই বিতর্কের সুযোগে ইউনাইটেড লিবারেশন ফ্রন্ট অফ আসাম (আলফা) এবং অগপ-ও ফের 'বাঙালি খেদাও'-য়ের রাজনীতি করতে সক্রিয় হয়ে উঠেছে। অহমিয়া-বাঙালি বিরোধিতার শিকড় ছিলই। সেই ছাইচাপা আগুনের ফুলকি দেখা যাচ্ছে।
এটা ঠিক যে ভিসা ছাড়া পৃথিবীর কোনও দেশেই থাকা যায় না। সুকেতু মেহতা লিখেছেন যে একদা আমেরিকার থ্রেট ছিল জাপান, সোভিয়েত ইউনিয়ন, তারপর আল-কায়দা। আর ট্রাম্প প্রেসিডেন্ট হওয়ার পর এখন সবচেয়ে বড় থ্রেট হল দেশের ভেতরেই নিউ ইয়র্ক-এর 'কুইন্স' নামক এলাকা, যেখানে বাংলাদেশের বহু মানুষ বসবাস করেন। বর্তমানে বিপর্যস্ত মার্কিনি অর্থনীতিতে প্রভাব সৃষ্টিকারী এই অনুপ্রবেশকারীদের তাড়াতে ব্যস্ত ট্রাম্প।
কিন্তু ভারত-পাকিস্তান-বাংলাদেশ, এই তিনটি দেশের মানুষের থাকা না থাকার বিষয়টি কিন্তু আলাদা। ব্রিটিশ সাহেব সিরিল র্যাডক্লিফ ফিতে দিয়ে তাড়াহুড়ো করে সীমানা নির্ধারণ করেন। সেই তাড়াহুড়োয় মানুষ নিজে ঠিক করার সুযোগই পান নি, কোন দিকে থাকবেন। রাষ্ট্র তাঁদের উপর বাসস্থান চাপিয়ে দিয়েছিল। এমনও তো হয় যে ভারত-বাংলাদেশ সীমান্তে কারোর উঠোন একদিকে, আর শোওয়ার ঘরটা অন্য দেশে। দেশভাগের যন্ত্রণার মানবিক দিক থাকে। তাকে অগ্রাহ্য করা যায় না।
তবে নরেন্দ্র মোদীর কাছেও আসামের নাগরিকপঞ্জির বাস্তব প্রয়োগের চেয়ে বাংলাদেশের মতো বন্ধু রাষ্ট্রকে সঙ্গে রাখাটা বেশি জরুরি। বিশেষত চীন এবং পাকিস্তানের সঙ্গে ভারতের সাম্প্রতিক কূটনীতির যা অবস্থা, তাতে বাংলাদেশকে আজ ভারতের বিশেষভাবে প্রয়োজন। বাংলাদেশের জিওস্ট্র্যাটেজিক গুরুত্ব মোদী-অমিত শাহ জানেন না, এটা তো হতে পারে না। তাছাড়া সমস্ত আইনি প্রক্রিয়া শেষ না হওয়া পর্যন্ত কাউকে বিদেশী বলা যাবে না। ১২০ কুড়ি দিনের মধ্যে তাঁরা ফরেনার্স ট্রাইব্যুনালে আবেদন করতে পারবেন। সেখানে ব্যর্থ হলে হাইকোর্ট, সুপ্রিমকোর্ট। ১০০ টি ট্রাইব্যুনাল কাজ করছে। সেপ্টেম্বরের প্রথম সপ্তাহ থেকে আসামে আরো ২০০টি ট্রাইব্যুনাল কাজ করতে শুরু করবে। মোট ১,০০০ টি ট্রাইব্যুনাল স্থাপনের লক্ষ্য রয়েছে।
গরিব মানুষ আইনের খরচ যোগাবেনই বা কোথা থেকে? এ ব্যাপারে কেন্দ্র ও রাজ্য সরকার আইনি সহযোগিতা দেবে। তাই খুব শিগগিরি কিছুই হচ্ছে না। তবে বিজেপি দেশের ভিতরে এটিকে রাজনৈতিক প্রচার অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করছে। মোদী–শাহ বলেছেন শুধু আসাম নয়, গোটা দেশেই নাগরিকপঞ্জি হবে। সংসদে বিল পাস হবে। এবং আধার কার্ড নয়, সেই নাগরিক পরিচয়পত্রটি হবে ফুলপ্রুফ, শেষ কথা।
ঈশ্বর-আল্লাহর কাছে প্রার্থনা করি, দেশে শান্তি বিঘ্নিত যেন না হয়। কোন সন্দেহ নেই, কাশ্মীরের ৩৭০ ধারা অবলুপ্তির পর মোদী অসমের নাগরিকপঞ্জি প্রকাশ করেও এক মস্ত বড় ঝুঁকি নিয়েছেন।