Advertisment

আধ্যাত্মিক অরবিন্দের আগে রাজনীতিক অরবিন্দ

অরবিন্দের প্রগাঢ় রাজনৈতিক দর্শন সম্পর্কে গবেষকদের নিস্পৃহতায় দক্ষিণপন্থীদের সুবিধে হয়েছে তাঁকে ‘আমাদের লোক’ বলে চিহ্নিত করতে, স্পষ্ট লিখেছেন সুগত বসু।

author-image
IE Bangla Web Desk
New Update
NULL

"ধর্মাবতার, আমার চূড়ান্ত আবেদন এই, অভিযুক্তের তকমা দেওয়া এই মানুষটি আজ শুধু এই আদালতের সুবিচারের প্রত্যাশী নন, তিনি মুখাপেক্ষী ইতিহাসের ন্যায়ালয়ের। আমার আবেদন, এই মামলার বিতর্কের অভিঘাত সময়ের প্রলেপে ক্ষীণতর হয়ে পড়ার দীর্ঘদিন পরও, এই আন্দোলন স্তিমিত হয়ে যাওয়ার বহুকাল পরও, এই মানুষটির প্রয়াণের দীর্ঘদিন পরও, ওঁকে মানুষ মনে রাখবে দেশপ্রেমের কাব্যরচয়িতা হিসাবে, জাতীয়তাবাদের দিকদর্শক হিসাবে। মানবতার পূজারী হিসাবে। ওঁর বাণী দেহত্যাগের বহুদিন পরও ধ্বনিত হবে দেশদেশান্তরে।"

Advertisment

অরবিন্দ ঘোষ সম্পর্কে উপরের উদ্ধৃতিটি চিত্তরঞ্জন দাশের, আলিপুর বোমা মামলার বিচারপর্বে। যে মামলায় অভিযুক্ত অরবিন্দের আইনজীবী ছিলেন চিত্তরঞ্জন। জাতীয়তাবাদী নেতা হিসাবে অরবিন্দের বহুবর্ণ ভাবমূর্তি নিখুঁত পরিস্ফুট হয় এই উদ্ধৃতিতে।

সাধারণ মানুষের কাছে তিনি ছিলেন জাতীয়তাবাদী সংস্কৃতির এক অন্যতম পুরোধা, স্বদেশী আন্দোলনে উত্তাল বঙ্গদেশে যাঁর অগ্রণী ভূমিকা ছিল। দেশমাতৃকার জন্য ত্যাগস্বীকারে বঙ্গজ যুবসমাজকে তিনি যে ভাবে উদ্বুদ্ধ করেছিলেন, ধরা আছে ইতিহাসের পাতায়।

দ্বিমতও অবশ্য রয়েছে অরবিন্দের ব্যাপারে।কেউ কেউ প্রশ্ন তোলেন অরবিন্দের তথাকথিত বিভাজনমূলক রাজনৈতিক দর্শন নিয়ে। স্বাধীনতার একাত্তর বছর পরে, আজ কতটা প্রাসঙ্গিক অরবিন্দের রাজনৈতিক দর্শন ?

ইতিহাসবিদ সুগত বসু ‘The Spirit and Form of an Ethical Polity: A Meditation of Aurobindo’s Thought’ শীর্ষক প্রবন্ধে লিখছেন, “অরবিন্দের রাজনৈতিক ভাবনা এবং তার নৈতিক ভিত্তিস্থল বিষয়ে অনেকেরই সম্যক ধারণার অভাব রয়েছে। ভুল বোঝাবুঝি রয়েছে। তার কারণ হল, অর্ধশতক ধরে রাষ্ট্রিক ধর্মনিরপেক্ষতার একরকম প্রথাগত অধ্যয়নের প্রভাব।"

ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেসকে দেওয়া এক ই-মেল সাক্ষাৎকারে ঐতিহাসিক রাহুল গোবিন্দ বলেছেন, “এ বিষয়ে পাশ্চাত্যের গবেষণা এবং বর্তমান ভারতে যে ধর্মীয় চেতনাভিত্তিক রাজনৈতিক ভাবধারার আধিপত্য, কোথাও গিয়ে যেন আশ্চর্যভাবে এক সূত্রে মিলে যায়। যাঁদের রাজনৈতিক-ভাবনার মধ্যে ওই ধর্মীয় চেতনার স্বর খোঁজার চেষ্টা হয়, অরবিন্দ তাঁদের অন্যতম। যদিও, অরবিন্দের বিষয়ে এই ধারণাকে প্রতিষ্ঠিত করা যায়নি তেমন। বরং, শিবাজী বন্দ্যোপাধ্যায় এবং সঞ্জয় পালশিকর তাঁদের গবেষণায় দেখিয়েছেন, ‘গীতা’-র বিষয়ে অরবিন্দের বিশ্লেষণ পশ্চিমি ধারার ব্যাখ্যারই অনুগামী (‘হামবোল্ডট’-এর কথা স্বর্তব্য এখানে)। ‘শঙ্করা’-র মতো প্রাচ্য ঐতিহ্যের অনুসারী নয়।

অরবিন্দের জন্ম ১৮৭২ সালের ১৫ অগস্ট। কলকাতার বাঙালি কায়স্থ পরিবারে। ইংল্যান্ডের কিংস কলেজে ছাত্রাবস্থায়ই দেশপ্রেমের ব্রতে উদ্বুদ্ধ হয়েছিলেন। ইতালি এবং আয়ারল্যান্ডের জাতীয়তাবাদীদের সংস্পর্শে এসেছিলেন, ‘Cambridge Majlis’ নামের একটি ভারতীয় ছাত্র সংগঠনের সঙ্গে যুক্তও হয়েছিলেন। তবে স্বাধীনতা আন্দোলনে অরবিন্দের সক্রিয় অংশগ্রহণ দেশে ফেরার পরই। সহিংস আন্দোলনে বিশ্বাসী তরুণদের সঙ্গে জড়িয়ে পড়া, তাঁদের প্রেরণা জোগানো এবং দেশমাতৃকার জন্য ত্যাগ এবং যন্ত্রণা স্বীকারে উদ্বুদ্ধ করা।

বিপ্লবী অরবিন্দ

“রাষ্ট্রশক্তিতে বলীয়ান শাসকশ্রেনীর চরিত্রই হল তাদের অধীন জনগোষ্ঠীর কোনরূপ প্রতিবাদকে উগ্র এবং অপরাধমূলক বলে প্রতিপন্ন করা”, লিখেছিলেন অরবিন্দ ১৯০৭ সালে, “বন্দেমাতরম" পত্রিকায়। মধ্যতিরিশের অরবিন্দ তখন মনে করতেন, নিস্পৃহ প্রতিরোধ যে কোন সময় বদলে যেতে পারে সম্মুখসমরে। এবং যদি তা-ই হয়, যুদ্ধক্ষেত্র থেকে পালিয়ে আসা যাবে না। যুদ্ধের মুখোমুখি হতে যারা দ্বিধাগ্রস্ত থাবে তাদের জন্য বরাদ্দ থাকা উচিত কুরুক্ষেত্রে যুদ্ধবিমুখ অর্জুনের প্রতি কৃষ্ণের সস্নেহ তিরস্কার।

অরবিন্দের রাজনৈতিক সক্রিয়তার সুচনা হয় ১৮৯০ সালে, কংগ্রেসের নরমপন্থী মনোভাবের বিরোধিতার মাধ্যেমে। তাঁর রাজনৈতিক দর্শনের বিকাশ ঘটে স্বদেশি আন্দোলনের সময়, যখন তিনি ডাক দিয়েছিলেন ‘নিষ্পৃহ প্রতিরোধ’ বা ‘Passive Resistance’-এর। সুগত বসুর মতে, “অরবিন্দের বক্তব্য ছিল, কৌশলগতভাবে ‘নিষ্পৃহ প্রতিরোধ’ নিয়ে আপত্তির কিছু নেই, তবে প্রয়োজনে সশস্ত্র সংগ্রামের মধ্যেও কোন অনৈতিকতা নেই। আমাদের সেই সংগ্রামের রসদ নেই, এই যা।"

অরবিন্দের কাছে দেশমাতাকে স্বাধীন করাই ছিল এক এবং একমাত্র লক্ষ্য। গবেষকরা কেউ কেউ তাঁকে ‘Matrist’ (মাতৃতান্ত্রিক, মায়ের প্রতি অনুরাগ যার বাবার থেকে তুলনায় বেশি হয়) বলেও অভিহিত করে থাকেন। অরবিন্দ লিখেছিলেন, “মাতৃভূমি ছাড়া কোনও কিছুই রাজনৈতিকভাবে পূজ্য নয়। স্বাধীনতা ছাড়া আর কোনও কিছুই রাজনৈতিকভাবে অভীষ্ট নয়। এবং কোনও পন্থাই রাজনৈতিকভাবে শুভ বা অশুভ নয়, যতক্ষণ না তা জাতীয়তাবাদের উন্মেষে সহায়ক বা ক্ষতিকারক হয়ে উঠছে।”

‘বন্দেমাতরম’ পত্রিকায় “The Morality of Boycott” শীর্ষক আরেকটি নিবন্ধে অরবিন্দ কাব্যিক ভঙ্গিতে লিখেছিলেন “দেশের স্বাধীনতার জন্য রক্ত ঝরানোর তৃপ্তি”-র কথা। ইতিহাসবিদ এম. কে. হালদার অরবিন্দের রাজনৈতিক চেতনার বিষয়ে লিখেছেন, “সহিংসা বা অহিংসা তাঁর কাছে দেশের স্বাধীনতার জন্য দুটি বিকল্প পন্থার বেশি কিছু ছিল না।”

১৯০৭-এ কংগ্রেসের সুরাট অধিবেশনে দলের নরমপন্থী অংশের সঙ্গে অরবিন্দ সহ অন্যান্য চরমপন্থী নেতাদের মতবিরোধ তুঙ্গে ওঠে। কংগ্রেস বিভক্ত হয়ে যায় এর কিছুদিন পরেই। অরবিন্দ অবশ্য ততদিনে কলকাতায় ‘অনুশীলন সমিতি'-র মতো সহিংস সংগ্রামে বিশ্বাসী গুপ্ত সংগঠনগুলির নেতৃত্ব দিতে শুরু করেছেন। ১৯০৮ সালে অরবিন্দ এবং সমিতির আরও অনেকে গ্রেফতার হন আলিপুর বোমা মামলায়। এ মামলায় অরবিন্দ বেকসুর খালাস পান। কিন্তু এক বছর জেলে কাটানোর পর্বে তাঁর রাজনৈতিক ভাবাদর্শে ছোঁয়া লাগে আধ্যাত্মিক চিন্তার। অরবিন্দ তাঁর আত্মজীবনীতে লিখেছিলেন, “জেলে থাকার সময় আমি অবিরাম শুনতে পেতাম স্বামী বিবেকানন্দের বাণী। যখন আমি এক পক্ষকাল ধ্যানমগ্ন ছিলাম একা একটি কুঠুরিতে, বিবেকানন্দ যেন রোজ আমার সঙ্গে কথা বলতেন।" জেল থেকে ছাড়া পাওয়ার পর অরবিন্দ নিজেকে সঁপে দিয়েছিলেন আধ্যাত্মিকতায়।

আধ্যাত্মিক অরবিন্দ

ইতিহাসবিদদের মতে, রাজনীতির সঙ্গে ধর্মের যোগসূত্র স্থাপন করেছিলেন যে সব দেশনেতারা, অরবিন্দ তাঁদের মধ্যে অগ্রগণ্য। বঙ্কিমচন্দ্রই প্রথম ধর্মীয় অনুষঙ্গ যোগ করেছিলেন রাজনীতিতে, তার পরে বিবেকানন্দও। ইতিহাসবিদ এম কে হালদারের মতে, “অরবিন্দের হাত ধরেই ভারতীয় রাজনীতি ধর্মের লক্ষণরেখা অতিক্রম করেছিল। সেই থেকেই ধর্ম ভারতীয় রাজনীতির অঙ্গাঙ্গী উপকরণ হয়ে দাঁড়ায়।"

একটি লেখায় অরবিন্দ বলেছিলেন,তাঁর রাজনৈতিক দর্শন প্রথমে উপনিষদ, এবং তারপর ‘গীতা’ দ্বারা প্রভাবিত। ডেভি অবশ্য মানেন না যে অরবিন্দের রাজনীতি কোন নির্দিষ্ট ধর্মের অনুসারী ছিল। ডেভির মতে, “অরবিন্দ দার্শনিক ছিলেন। উপনিষদ তো বেদেরই নির্যাস, এবং বেদ কোন নির্দিষ্ট ধর্মের কথা বলে না। বেদ মূলত দর্শনগ্রন্থ। ধর্ম তার সঙ্গে যোগ হয়েছে অনেক পরে, পরোক্ষভাবে।" ডেভি আমাদের আরও মনে করিয়ে দেন, "হোমার সহ অন্যান্য ইউরোপিয় দার্শনিকদের কাজ মনোযোগ দিয়ে পড়েছিলেন অরবিন্দ। পড়েছিলেন বৌদ্ধদর্শনও। তিনি ছিলেন এমন এক দার্শনিক, সব ধর্মই যাঁর কৌতূহলের বিষয় ছিল।"

সুগত বসু অবশ্য মনে করেন, অরবিন্দের ধর্মীয় চিন্তাকে নৈতিকতার কষ্টিপাথরে যাচাই করা উচিত, “তাঁর ‘ধর্ম’ বিষয়ে ধারণার অবিচ্ছেদ্য যোগ ছিল আধ্যাত্মিকতার সঙ্গে, নৈতিকতার সঙ্গে। তিনি বলতেন, ‘রাজনীতি থেকে ধর্মকে সরিয়ে নেওয়ার নামে রাজনীতি থেকে নৈতিকতাকে সরিয়ে নিও না’।"

তাঁর রাজনৈতিক আদর্শ ছিল তৎকালীন বিশ্বের অন্যান্য রাজনৈতিক ভাবধারার তুলনায় সবচেয়ে বেশি উদারমনা এবং উন্মুক্ত, এমনটাই ডেভির মত।

জেল থেকে বেরিয়ে আসার পর রাজনীতি থেকে নিজেকে গুটিয়ে নেন অরবিন্দ। প্রথমে আত্মগোপন করেন চন্দননগরে। তারপর চলে যান পন্ডিচেরীতে (তখন যা ছিল ফরাসী উপনিবেশ) এবং
দর্শন এবং আধ্যাত্মিকতায় নিজেকে ডুবিয়ে দেন। তাঁর প্রতিষ্ঠিত দর্শনবিষয়ক পত্রিকার নাম ছিল ‘Arya’।

পন্ডিচেরীতে থাকাকালীন অবশ্য অরবিন্দ রাজনৈতিক নিবন্ধও লিখেছিলেন। সুগত বসুর মতে, "The Sprit and Form of an Indian Polity” শীর্ষক নিবন্ধে তিনি মুঘল সাম্রাজ্যের মূল্যায়ন করেছিলেন। এবং বলেছিলেন, মুঘল সাম্রাজ্য তৎকালীন বিশ্বের অন্যান্য রাজশক্তিদের তুলনায় অনেক বেশি প্রগতিশীল ও সহিষ্ণু ছিল। মুঘলদের সম্পর্কে অরবিন্দের ধারণা একেবারেই মেলে না আজকের হিন্দুত্ববাদীদের সঙ্গে।

অরবিন্দ, উপেক্ষিত নায়ক

অরবিন্দের রাজনৈতিক দর্শন তাঁর প্রাপ্য মর্যাদা পায়নি, এমনটা বললে অত্যুক্তি হয় না। সুগত বোস থেকে ডেভি, অনেকেরই মত হল, অরবিন্দের দর্শনকে সম্যকভাবে অধ্যয়ন না করার ফলেই তাঁর সম্পর্কে কিছু ভ্রান্ত ধারণা তৈরি হয়েছে। ফলে তাঁর রাজনৈতিক দর্শনের প্রজ্ঞা সেভাবে বন্দিত হয়নি আধুনিক ভারতে। পন্ডিচেরী চলে যাওয়ার পর তাঁকে অনেকাংশে আধ্যাত্মিক সাধক হিসাবেই দেখা হয়েছে, উপেক্ষিত হয়েছে সাধকজীবনে রচিত রাজনৈতিক দর্শনমূলক লেখালেখি।

অরবিন্দের প্রগাঢ় রাজনৈতিক দর্শন সম্পর্কে গবেষকদের এই নিষ্পৃহতায় দক্ষিণপন্থীদের সুবিধে হয়েছে তাঁকে ‘আমাদের লোক’ বলে চিহ্নিত করতে, স্পষ্ট লিখেছেন সুগত বসু। তাঁর দ্ব্যর্থহীন মত, “যে লেখাগুলিতে অরবিন্দ বা বিবেকানন্দ ধর্মীয় গোঁড়ামির বিরুদ্ধে সোচ্চার হয়েছেন, সেগুলো না পড়ে যদি স্রেফ ধর্মীয় ব্যাক্তিত্ব হিসাবেই তাঁদের দেখা হয়, ধর্ম তো তাঁদের গ্রাস করতে চাইবেই।"

Aurobindo Rishi Aurobindo
Advertisment