/indian-express-bangla/media/post_attachments/wp-content/uploads/2019/11/ayodhya-anyo-paksha.jpg)
রবির সকালে এসে একটু ফুরসৎ পাওয়া গেলো। শুক্কুরের রাত থেকেই সবাই উত্তেজনায় টইটুম্বুর। একদিকে অযোধ্যা রায় আর অন্যদিকে বুলবুল। পর পর দু রাত ঘুমের দফারফা, ঢকঢক করে জল আর বারেবারে চানঘর। ফণী এ রাজ্যে পুরো ফেল মেরেছিল, বুলবুল আশা জাগিয়েছে একশোর বেশি গতিতে ছুটে। একক জিজ্ঞাসা করে বিব্রত করবেন না। ভারতের আমজনতা হিসেবে কিলোমিটার/ঘন্টা কিংবা মিটার/সেকেন্ড ভাবার সময় নেই মোটে। দেশের এখন একটাই মাত্র একক, তা হল একতা।
এরকম শনিবার খুব বেশি আসে না। বুলবুলের দয়ায় ছেলেমেয়েদের ইশকুল ছুটি, কোচিং ক্লাস বন্ধ। অযোধ্যা রায়ের কথা ভেবে অন্যান্য রাজ্য আগে থেকেই একশো চুয়াল্লিশ ধারা জারি করে দিয়েছে। পশ্চিমবঙ্গ সরকার সম্ভবত বুলবুলে বেশি নজর দিতে গিয়ে অযোধ্যা ভুলে গিয়েছিল। সে রাজনীতি আপাতত থাক। নাহলে আমাদের এখানে একলাফে কার্ফুও জারি হয়ে যেতে পারত। দোকানের ঝাঁপ সামান্য ফাঁক করে লুকিয়ে কেনা সিগারেটের যে স্বাদ, তা কি আর দোকান খোলা থাকলে পাওয়া যায়? উত্তেজনা কিছুটা কম হওয়ায় সে গুড়ে বালি। তবে অযোধ্যা রায়ের সিমেন্টে গোটা দেশ অর্থনীতির গোঁত্তা ভুলে ঐক্যবদ্ধ। সেই রামে যে বাংলা শামিল হবে তা বলাই বাহুল্য, সঙ্গে সংখ্যালঘু কানাই-ও আছে। কলসির কানায় ঠোঁট ফাটতে পারে, চোখের চারপাশ হিন্দি ছবির ভিলেনের মত কালো হয়ে যেতে পারে, টাকে আলু গজাতে পারে, কিন্তু তবু এ দেশের ধর্মনিরপেক্ষতাকে লাল সেলাম জানাতেই হবে। অযোধ্যার মত ব্যস্ত জায়গায় পাঁচ একর! যেখানে চাইবে সেখানেই পাবে। শুধু অল্প একটু জমি বাদ দিয়ে। আর সেই জায়গামত সরকারের তত্ত্বাবধানে জন্মস্থান ঘিরে পাঁচিল গাঁথা হবে। তিন তালাক আর তিনশো সত্তরের পর অযোধ্যা রায়ের হ্যাট্রিক। এই প্রথম একটা সরকার এসেছে যারা কিনা প্রতিশ্রুতি রক্ষা করতে সমর্থ। এ তো সবে দেশ দখল। এরপর মধ্যযুগের ইতিহাসের মত বিশ্বজয় হবে। ব্যাবিলনের শূন্যোদান, পিসার হেলানো মিনার কিংবা চিনের প্রাচীরের তলায় খুঁড়লেও কিছু না কিছু পুরনো দিনের কাঠামো বেরোবে। তখন আর আটকায় কে? পুরাতাত্ত্বিকরা সেটা কোন ধর্মের সেই বিচার নিয়ে তর্ক করুন, আমাদের সহায় হল আদালতের রায়।
দেশের পুরনো ইতিহাস না পড়া বুদ্ধিজীবীর দল নিয়েই যত মুশকিল। এদের জন্যেই গরুর দুধে সোনা, থুড়ি চোনা। বলে কিনা বিচার তো হল, কিন্তু বাবরি মসজিদ ভাঙা নিয়ে আলোচনা বন্ধ কেন? সেটা তো আইনবিরুদ্ধ বলে ঘোষণা করল সুপ্রিম কোর্ট। তাহলে তার কি শাস্তি? অপোগণ্ডগুলো এটুকুও জানে না পাঁচশো বছরের থেকে বেশি অতীত মসজিদও গুঁড়িয়ে দেওয়া হয়েছে এর আগে। উদাহরণ দিয়ে নষ্ট করার মত সময় এখন নেই। দরকারে গুগল করে জেনে নিন। মন্দির, মসজিদ, চার্চ, সিনাগগ, যে নামেই ডাকুন না কেন, ক্ষমতার হাতবদলে এক স্থাপত্যের ওপর অন্যটা চেপে বসে। ধর্ম আছে বলেই ধর্মযুদ্ধ আছে। সে যুদ্ধেই তো লক্ষ কোটি মানুষ মরে। এই সব মারপিট কিংবা কেস-খামারি নিয়ে যদি প্রগতিশীল, সংবেদনশীল, কিংবা অন্য কোন শিলপড়া মানুষের খুব অসুবিধে হয় তাহলে দেবালয়ের মাথায় নিজেদের খরচে “ধর্মপান স্বাস্থ্যের পক্ষে ক্ষতিকর” এই বিধিসম্মত সতর্কীকরণ টাঙানোর জন্যে আদালতের কাছে আবেদন করুন। সেখানকার রায়েই আমাদের মত ধর্মনিরপেক্ষ দেশে সঠিক মতের প্রতিষ্ঠা হয়। রাজনীতির ঊর্ধ্বে উঠে আইনের পথে ছাতি ফুলিয়ে এগিয়ে চলে গণতান্ত্রিক ভারতের যুক্তরাষ্ট্রীয় কাঠামো। ভেবেছিলাম বিজয় মিছিলে হেঁটে ঘেমে-নেয়ে পেশীবহুল ছাতির ওপরের স্যান্ডো গেঞ্জি ভেজাবো। কিন্তু বিশ্বাসঘাতক বুলবুল তার আগেই ভিজিয়ে চুবড়ি করে দিয়েছে।
যাই হোক, ইতিহাসের কথায় ফিরে আসা যাক। ১২৩৪ সালে ইলতুৎমিস ভেঙে দিলেন উজ্জয়িনীর মহাকালেশ্বর শিব মন্দির। কিন্তু তার পাঁচশো বছর পর আবার যখন মারাঠার উত্থান হল, ছবিটা বদলে গেলো একেবারে। ১৭৩৪ সালে রানোজি রাও সিন্ধে মসজিদ ভেঙে দিয়ে পুনরায় স্থাপন করলেন শিবমন্দির। মারাঠিরা ব্যাপক লড়াই দিয়েছিল সেই সময়। আর একটু হলেই কাশী, অযোধ্যা, মথুরা সব কিছুই উদ্ধার হয়ে যেত। কিন্তু তৃতীয় পানিপথের যুদ্ধে হেরে যাওয়ায় বিষয়টা আবার ঘেঁটে যায়। এইখানে একটা মজার গল্প আছে। ১৭৪২ সালে মারাঠা সৈন্যাধ্যক্ষ মালহার রাও হোলকার প্রায় চল্লিশ হাজার সৈন্য সামন্ত নিয়ে বারাণসী পৌঁছন। কাশী বিশ্বনাথ মন্দির ভেঙে মুঘলেরা নাকি তার ওপর মসজিদ বানিয়েছিল। সেই মসজিদ আবার উপড়ে দিয়ে মন্দির বানানোর পরিকল্পনা করছিলেন মালহার। কিন্তু বারাণসীর ব্রাহ্মণ হিন্দু পণ্ডিতেরাই নাকি আপত্তি জানিয়েছিলেন মসজিদ ভাঙার বিষয়ে। তার কারণ মারাঠি সেনা চলে যাওয়ার পর আবার মুঘলদের অত্যাচার বেড়ে যেতে পারে, এবং সেক্ষেত্রে হিন্দুদেরই অসুবিধে আরও বেড়ে যাওয়ার সম্ভাবনা ছিল সেই সময়ে। অর্থাৎ ইতিহাসে দু ধরনের উদাহরণই আছে। আজ থেকে প্রায় তিনশো বছর আগে এক জায়গায় ফিরিয়ে আনা হয়েছিল দেবালয়, অন্য জায়গায় রাজনৈতিক কারণে সেই পদক্ষেপ নেওয়া হয় নি। পাঠ্যবইতে সেই দিনগুলোতেও আইন আদালতের কথা শোনা যায়। তবে সে আইনের মালিক ছিলেন দাপুটে মুঘল সম্রাটেরা। আজকে মালিকপক্ষ বদলেছে। তাই বাবরি মসজিদ ভাঙাকে কোর্ট বেআইনি বললেও বিষয়টায় কিন্তু সীলমোহর পড়েই গেলো।
যারা জিতলেন তারা এখন অল্প সময়ের জন্যে সংযম দেখাচ্ছেন। সময় হলেই আবার ধমক দিতে শুরু করবেন শাসককুল। যারা হারলেন তারা বোঝার চেষ্টা করছেন ঠিক কতটা হারালেন। এর মধ্যেই প্রতিবাদের দু-একটা চলচ্ছবি বোকা বাক্সে দেখা যাচ্ছে। পরিকল্পিত ভাবনাতেই একেবারে চুপচাপ এই রাজ্যের শাসকদল। ক্ষয়িষ্ণু বামেদের বক্তব্য কেউ খুব মন দিয়ে শুনছেন বলে মনে হয় না। বুঝতে হবে আইনের কচকচি নিয়ে জনগণ খুব একটা চিন্তিত নয়। বরং ধর্ম আর রাজনীতির প্রেক্ষিতেই এই রায়ের দিকনির্দেশ নিয়ে এতো আলোচনা। বাস্তবে কিন্তু ভারতের একশো তিরিশ কোটি মানুষের একটুকরো সমস্যাকেও ছুঁয়ে যাবে না এই ঘটনাপ্রবাহ। তবে কতজন সংখ্যাগুরু এই রায় শুনে তৃপ্ত হলেন আর কতজন সংখ্যাগুরু (লঘু নয়) এই রায়ে বিরক্ত, তার ওপর নির্ভর করবে আগামী দিনের ভোটফল। আপাতত অ্যাডভান্টেজ বিজেপি, যদিও রামমন্দির কিন্তু আর ঝুলে থাকল না। অদূর ভবিষ্যতে বিজেপির ডিভিডেন্ট ঊর্ধ্বমুখী থাকার সম্ভাবনাই বেশি। তবে অযোধ্যা রায় যদি সত্যিই এই সমস্যায় ইতি টানে, তাহলে বছরখানেক পরে পড়শি দেশের সঙ্গে টানাপোড়েন ছাড়া হাতে বিশেষ কিছু থাকবে না। তখন আবার নতুন করে মসজিদ খুঁজতে হবে!
(লেখক ইন্ডিয়ান স্ট্যাটিস্টিক্যাল ইন্সটিটিউটের অধ্যাপক, মতামত ব্যক্তিগত।)