দেশের অর্থনীতির যখন যায় যায় অবস্থা। বেকারি রেকর্ড ছুঁয়েছে। শিল্পের কোর সেক্টরে মন্দা। ন্যাশনাল ক্রাইম রেকর্ড ব্যুরোর তথ্য যখন বলেছে দেশে প্রতিদিন ৩১ জন কৃষক আত্মহত্যা করছেন- এই রকম পরিস্থিতিতে প্রাচীনতম অযোধ্যা মামলার রায় বেরোল।
অযোধ্যা মামলার রায়ে জয়-পরাজয় না দেখতে অনুরোধ করেছেন হিন্দুত্ববাদী নেতারা। তার মানে তো এই নয় যে এই মামলায় দু’পক্ষেরই হার হয়েছে! এমনও বলা যাবে না, দু’পক্ষেরই জিত হয়েছে।
বিজেপির দীর্ঘ দিনের স্লোগান, মন্দির ওখানেই বানাবো বা ‘মন্দির ওহি বনায়েঙ্গে’, আদালতের রায় সেই দাবি পূরণের অনুমতি দিয়েছে। এটাকে যদি জয় না বলা হয় তবে জয় আর কাকে বলে। সংখ্যালঘু নেতারা অনেকেই বলেছেন, তাঁরা খুশি নন, কিন্তু তাঁরা এই রায় মেনে নেবেন। সম্ভবত রিভিউ পিটিশনেও যাচ্ছেন না তাঁরা। যে পাঁচ একর জমি আদালতের নির্দেশে তাঁদের দেওয়া হবে, সেখানে মসজিদ না গড়ে স্কুল তৈরি করা হোক, এমন মতও বিশিষ্ট সংখ্যালঘু ব্যক্তিত্বদের কেউ কেউ দিয়েছেন। সংখ্যাগুরুর গণতন্ত্রে সংখ্যালঘুদের কী ভাবে থাকতে হবে, আপনি আপনিই তার একটা ছবি যেন স্পষ্ট হচ্ছে।
রাম মন্দির হল বিজেপির লক্ষ্মী। ১৯৮৪ তে মাত্র দু’টি লোকসভা আসন থেকে ১৯৯৬-এ একক সংখ্যা গরিষ্ঠ দলে পৌঁছতে এই আন্দোলনই বিজেপিকে সব থেকে বেশি সাহায্য করেছে। যদিও এই আন্দোলনকে ঘিরে বহু মানুষের মৃত্যু হয়েছে, বহু দাঙ্গা হয়েছে, এমনকী গুজরাট দাঙ্গার সঙ্গেও এই আন্দোলনের যোগ রয়েছে। আর এই নিহতদের ৯৯ শতাংশই সংখ্যালঘু মুসলিম।
আরও পড়ুন, অযোধ্যা মামলা: একতার রায়
মহামান্য শীর্ষ আদালতের রায়কে যথাযথ সম্মান জানিয়েই এটা বলা যায় যে রামজন্মভূমি-বাবরি মসজিদ নিয়ে শীর্ষ আদালতের ৫ সদস্যের বেঞ্চের রায়ে যা বলা হয়েছে, এই কথাটাই ৩০ বছর আগে বলেছিলেন লালকৃষ্ণ আদবানি। তখনও মসজিদ ভাঙা হয়নি, ১৯৮৯ সালে তাঁর সমাধানসূত্র ছিল মসজিদকে তুলে নিয়ে গিয়ে (রিলোকেট) নতুন জায়গায় বসিয়ে দেওয়া হোক, আর সেই জায়গায় মন্দির তৈরি হোক। সেই পুরোনো মতই যেন প্রতিষ্ঠা পেল।
মসজিদ ভেঙে দেওয়ার পর, আদবানি বলেছিলেন(মাই কান্ট্রি মাই লাইফ) আজ ভারতে এমন কোনও রাজনৈতিক দল বা শক্তি নেই যারা প্রকাশ্যে ঘোষণা করতে পারে যে তারা ক্ষমতায় এলে নতুন করে ওই খানেই বাবরি মসজিদ তৈরি করে দেবে।
ধর্মনিরপেক্ষ বলে যে সব রাজনৈতিক দল নিজেদের দাবি করে, তাদের ধর্মনিরপেক্ষতার চর্চায় এমন কিছু গুরুতর গলদ আছে যে ২০০৮ সালে নিজের আত্মজীবনীতে আদবানির লেখা ওই কথা ১১ বছরে সত্যি প্রমাণিত হল। রায় নিয়ে সব ক’টি রাজনৈতিক দলের প্রতিক্রিয়া এই কথাই বলে। ওই একই কারণে শত সমালোচনা করেও কংগ্রেস বা অন্য কোনও মূল ধারার রাজনৈতিক দল বলতে পারে না তারা ক্ষমতায় ফিরলে কাশ্মীরে ৩৭০ ফিরিয়ে দেবে।
অসংখ্য মৃতদেহ এবং রক্তের দাগ পেরিয়ে, এতদিনের বিতর্কিত স্থানে সরকার এবং ট্রাস্টের মাধ্যমে মন্দির গড়ার অধিকার পাওয়া মানে বলা যায় মূল ম্যাচ হিন্দুত্ববাদীরা জিতেই গিয়েছে। বিজেপির তিনটে প্রধান অ্যাজেন্ডা ছিল। ৩৭০ হয়ে গিয়েছে। তাৎক্ষণিক তিন তালাকের মধ্যে দিয়ে ইউনিফর্ম সিভিল কোডের অর্ধেকটা হয়ে রয়েছে। ‘মন্দির ওহি বানায়েঙ্গে’ স্লোগানও শীর্ষ আদালতের সিলমোহর পেয়ে গেল ৯ নভেম্বর, শনিবারের রায়ে।
একটু পিছিয়ে যাওয়া যাক। ১৯৯২ সালে অযোধ্যায় বাবরি মসজিদ দিনের আলোয় ভেঙে গুঁড়িয়ে দেওয়া হয়েছিল। তখন প্রধানমন্ত্রী নরসীমা রাও। আর উত্তরপ্রদেশে তখন বিজেপির শাসন। মুখ্যমন্ত্রী কল্যাণ সিং। কল্যাণ পরে তাঁর বক্তৃতায় বার বার বলেছেন, কোনও ঠিকাদারকে দায়িত্ব দিলে ওটা ভাঙতে ১২ মাস লেগে যেত। আর তাঁদের সমর্থকরা এক দিনে ভেঙে দিয়েছেন।
আরও পড়ুন, অযোধ্যায় রাম মন্দির: অবশেষে সঙ্ঘ পরিবারের ইচ্ছা পূরণ
ঘটনার দিন অযোধ্যায় বিশাল জমায়েত করেছিল বিজেপি, আরএসএস, বিশ্বহিন্দু পরিষদ-সহ বিভিন্ন হিন্দুত্ববাদী সংগঠনের সমর্থক’ সদস্য এবং করসেবকরা। সাংবাদিক হিসেবে আমি সেখানে উপস্থিত ছিলাম। আমরা থাকতাম অযোধ্যা থেকে ৮ কিলোমিটার দূরে ফৈজাবাদে হোটেলে। ৫ তারিখ রাতে ৮টা নাগাদ আমরা কয়েক জন সাংবাদিক হেঁটে হেঁটে অযোধ্যা গিয়েছিলাম। রাস্তায় এক মুসলিম আইনজীবীর সঙ্গে কথা হল। আগেই তাঁর সঙ্গে আমাদের পরিচয় হয়েছিল। তিনি কিছুটা বাবরি মসজিদ অ্যাকশন কমিটির সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। আমরা খবর সংগ্রহের জন্য তাঁকে মাঝে মধ্যে ফোন করতাম। যখন তাঁর সঙ্গে কথা হচ্ছে, তার মধ্যেই তাঁর বৃদ্ধা মা আমাদের বললেন, খুব চিন্তায় আছি। কী হবে বুঝতে পারছি না। আপনারা ভগবানের কাছে আমাদের হয়ে একটু প্রার্থনা করবেন। যেন সব কিছু ঠিক থাকে। ৬ ডিসেম্বর বাবরি ধ্বংসের পর ৮ তারিখে আবার যখন ওই রাস্তা দিয়ে যাচ্ছিলাম দেখলাম ওই এলাকায় এখানে ওখানে পোড়া বাড়ি। তখনও সব আগুন নেভেনি। তার মধ্যে সেই উকিলের বাড়িটাও রয়েছে দেখলাম। চারি দিক জনশূন্য। কোথাও কোনও ফায়ার ব্রিগেডও চোখে পড়ল না।
ফিরে আসি ৬ তারিখের সকালের কথায়। বিরাট এলাকা। জুড়ে জমায়েত। মঞ্চে এল কে আদবানি সহ বিজেপি নেতারা। বক্তৃতা চলছে। অনেকটা দূরে পুজোর আয়োজন চলছে। আমি বক্তৃতার এলাকা ছেড়ে এসে পুজোর জায়গায় দাঁড়িয়ে এদিক ওদিক দেখছি। আদবানির বক্তৃতা চলছে। এমন সময় এক দল যুবক পাথর ছুড়তে শুরু করল বাবরি মসজিদ ঘিরে রাখা কাঁটা তারের বেড়ার সামনে দাঁড়িয়ে থাকা নিরাপত্তা কর্মীদের লক্ষ্য করে। তাঁরা সরে গেলেন। যুবকরা প্লায়ার্স দিয়ে তার কেটে ছুটতে ছুটতে গিয়ে বাবরি মসজিদের মাথায় উঠে গেরুয়া পতাকা তুলে দিল। শত শত যুবক গিয়ে বাবরি ঘিরে ফেলল। শুরু হল শাবল, গাঁইতি দিয়ে মসজিদ ভাঙা। তখন আদবানিরর মঞ্চ থেকে মাইকে বলা হচ্ছে, আপনারা পতাকা তুলেছেন, এবারে নেমে আসুন, ফিরে আসুন। সে কথায় অবশ্য কেউ কান দেননি। কিছুক্ষণ বাদে ঘটনাস্থল থেকে বাইরে এসে দেখলাম, বিভিন্ন গলিতে দাঁড়িয়ে কিছু যুবক বাঁশি বাজাচ্ছে। সেই ডাক শুনে ছুটে ছুটে আরও যুবকরা আসছে। তাঁদের সবাইকে পাঠিয়ে দেওয়া হচ্ছে মসজিদ ভাঙার কাজে।
আদবানি যখন দেখলেন, মঞ্চ থেকে বলা সত্ত্বেও মসজিদ ভাঙা আটকানো গেল না, তিনি মঞ্চ ছেড়ে চলে গেলেন। তার পর আমরা সাংবাদিকরা সেদিন আর তাঁকে পাইনি। উমা ভারতী-সহ অন্য বিজেপি নেতারা অবশ্য থেকে গেলেন। আমরা দেখলাম, মসজিদের একটা একটা করে ডোম ভেঙে পড়ছে, আর বিজেপির নেতা নেত্রীরা পরষ্পরকে আনন্দে জড়িয়ে ধরছেন।
আরও পড়ুন, সব কেন হিন্দুদের হাতে?
আমার পরে অনেক বার একটা কথা মনে হয়েছে। আদবানি কি জানতেন এমন ঘটবে? কখনও মনে হয়েছে হ্যাঁ। কখনও মনে হয়েছে না। কিন্তু বার বার মনে হয়েছে, অত বড় মাপের নেতা, তিনি, তাহলে তিনি নিজে হেঁটে মসজিদের কাছে গিয়ে ওই যুবকদের নিরস্ত করলেন না। তাঁর যে ধরনের ব্যক্তিত্ব, তিনি এক বার চেষ্টা তো করে দেখতে পারতেন! তিনি কিন্তু তা করেননি। মুমূর্ষু রোগীকে দেখেও যদি কোনও ডাক্তার চিকিৎসা না করে রোগীকে ছেড়ে চলে যান, এবং যদি রোগী মারা যায়, সে ক্ষেত্রে যেমন ডাক্তারকে নির্দোষ বলা যায় না। এ ক্ষেত্রেও, আমার মনে হয় ওই একই কারণে বাবরি মসজিদ ভাঙায় তাঁর দায় থেকেই যায়। কারণ তিনি শেষ চেষ্টা না করে ঘটনাস্থল ছেড়ে চলে গিয়েছিলেন। এর ফলে দেশে যে দাঙ্গা হয়েছিল, তাতে বহু নির্দোষ মানুষের মৃত্যু হয়। যদিও তিনি তাঁর আত্মজীবনীতে লিখেছেন, ওই দিনটি তাঁর জীবনের সব থেকে দুঃখের দিন।
৯ নভেম্বরের রায়ে যে তিনটি বিষয় বিজেপির বিরুদ্ধে গেল, তা নিয়ে বিজেপির আপাতত কোনও মাথা ব্যথা না থাকলেও, ইতিহাসে থেকে যাবে সেই তথ্যও। সেগুলি হল-
আদালত বলেছে, মন্দির ভেঙে যে মসজিদ তৈরি করা হয়েছিল, তার প্রমাণ মেলেনি।
১৯৪৯ সালে ফৈজাবাদের জেলাশাসক কে ডি নায়ার এক দল লোক নিয়ে গিয়ে মসজিদে রামলালার মূর্তি ঢুকিয়ে দিয়েছিলেন। ১৯৫২ সালের নির্বাচনে সেই কে ডি নায়ার উত্তরপ্রদেশ থেকে জনসঙ্ঘের প্রার্থীও হন। সেই কাজ বেআইনি হয়েছিল, শীর্ষ আদালত বলেছে।
১৯৯২ সালে বাবরি মসজিদ যারা ভেঙেছিল, তারা বেআইনি কাজ করেছিল, অপরাধমূলক কাজ ছিল সেটা। প্রসঙ্গত আদবানি, মুরলিমনোহর যোশী, উমাভারতী সহ এক দল বিজেপি নেতা নেত্রীর বিরুদ্ধে সেই মামলা এখনও চলছে।
এই তিনটে বিষয় বাদ দিলে, এই মামলার রায়ে বিজেপি জয়ই দেখবে। কিন্তু প্রশ্ন থেকেই যায়, শেষের তিনটে কাজ যদি বেআইনি হয়, তাহলে সেখানে ফের মন্দির কেন? তথ্য-প্রমাণের থেকেও কি এই ক্ষত্রে ‘হিন্দুত্ব কা ভাওনা’ বেশি গুরুত্ব পেল’?
এই প্রসঙ্গে গতকাল রাতে এক সাংবাদিক বন্ধু একটা গল্প বললেন। ধরা যাক এক গৃহস্থের একটা পোষা বাদুড় ছিল। কোনও এক দিন সেই বাদুড়টাকে নিয়ে একজন পালিয়ে যায়। থানা, পুলিশ আদালত হল। প্রচুর শুনানি-টুনানি হল। এখানে ওখানে প্রো-বাদুড় এবং অ্যান্টি-বাদুড় দলের মধ্যে অনেক মারামারি, খুনোখুনি হল। অবশেষে উদ্ধার হল বাদুড়। রায় হল, যে লোকটা বাদুড় নিয়ে পালিয়েছিল সেও তো বাদুড় খুব ভালোবাসে, বাদুড় ছাড়া সে-ই বা বাঁচবে কী করে! তাই ওই বাদুড় ওর কাছেই থাক, তোমাকে বরং সরকার থেকে আরও বড় সাইজের একটা বাদুড় কিনে দেওয়া হবে।
আমি মনে মনে ভাবলাম, এ কেমন বিচার! বাদুড়টা এখন গেয়ে উঠতেই পারে, ‘বাদুড় বলে ওরে ও ভাই শজারু, আজকে রাতে দেখবি একটা মজারু’। তবে হযবরল-এর জজ সাহেব অবশ্য খুব সুবিধের ছিল না। বসে বসে ঝিমোতো। তার চোখের ব্যারাম ছিল। লেখা এখানেই শেষ হয়ে গেল।
কারণ, কানে এলো হিজবিজবিজের সেই হাসি। চোখে দেখতে পাচ্ছি না, কিন্তু হাসিটা শুনতে পাচ্ছি।
(শুভাশিস মৈত্র বরিষ্ঠ সাংবাদিক, মতামত ব্যক্তিগত)