স্বাধীনতার পর সাত দশক চলে গিয়েছে। এই প্রথম কেন্দ্রীয় সরকার এমন একটি প্রকল্প হাতে নিয়েছে, যার প্রভাবে ঘুম ছুটে গিয়েছে কয়েক কোটি বাঙালির। ন্যাশনাল রেজিস্টার অফ সিটিজেনস বা এনআরসির ভয়ে বহু মানুষ রাতে ঘুমোতে পারছেন না। অনেকে মারা গেছেন আতঙ্কে। আত্মহত্যার ঘটনাও ঘটে চলেছে।
আগে দেশের রাজনীতি তোলপাড় হত সকলের জন্য কাজ, সকলের জন্য জমি, সকলের জন্য বাসস্থান, স্বাস্থ্য, সকলের জন্য শিক্ষা এইসব দাবিতে। বড় বড় আন্দোলন হয়েছে খাদ্যের দাবিতে, ভাষার দাবিতে, দুর্নীতির বিরুদ্ধে, ইন্দিরা গান্ধীর পদত্যাগ চেয়ে। দাবি কিছু মিটত, কিছু মিটত না, কিন্তু এই সব দাবিতে ক্লান্তিহীন মিছিল, পথচলারও কোনও শেষ ছিল না। আজ, এই সব দাবি বহু পিছনের সারিতে। যদিও এই সব প্রধান সমস্যা মোটেই মেটেনি। কিন্তু যবে থেকে মনে করা হল, চাকরি খাবার, বাসস্থান নয়, দেশের মূল স্লোগান হওয়া উচিত, ‘এক ধাক্কা অঔর দো, বাবরি মসজিদ তোড় দো’, ভারতের রাজনীতি সেই দিন থেকেই ‘আদর্শ’ নির্ভরতা থেকে ‘বিদ্বেষ’ নির্ভরতায় পৌঁছে যায়। পিছিয়ে পড়ে মানুষের ভালো থাকার রাজনীতি। সেই ধারাবাহিকতায় এনআরসি কার্যত আর একটি ‘বাবরি মসজিদ’ উন্মাদনা। গণ পিটুনিতে যে যৌথ হিংসা কাজ করে, যে দলবদ্ধ বিকৃতির লাভাস্রোত বয়ে যায়, সেই বিদ্বেষকেই এবার ল্যাবরেটারি থেকে বের করে এনে বৃহত্তর রাজনীতির ময়দানে মডেল হিসেবে ছেড়ে দেওয়ার প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে। যারা এটা করছেন তারা দুর্বল নয়, প্রবল শক্তিশালী।
আরও পড়ুন, এনআরসি পরিসংখ্যান ও পশ্চিমবঙ্গ
এনআরসি মূলত একটি বাঙালি বিরোধী অভিযান। হিন্দু এবং মুসলিম বাঙালি। বিজেপি সভাপতি অমিত শাহ কলকাতায় এসে বলেছেন, হিন্দুদের কোনও ভয় নেই। কাদের কাদের কোনও ভয় নেই সেই তালিকায় স্বাভাবিক ভাবেই তিনি মুসলিমদের নাম রাখেননি। দেশের শীর্ষ আদালতের যে রায় আছে তাতে এই ভাবে ধর্ম বেছে বেছে নাগরিকত্ব দেওয়া যায় না এটা অনেকেরই মত। কেউ কেউ অবশ্য বলছেন, সংবিধান সংশোধন করে বিজেপি এটা করে নেবে। এটা গেল একটা দিক। অন্য দিক হল, গত ২ অক্টোবর গুয়াহাটিতে ‘অল অসম স্টুডেন্টস ইউনিয়ন'-র সাধারণ সম্পাদক লুরিনজ্যোতি গগৈ এবং কৃষক মুক্তি সংগ্রাম সমিতির নেতা অখিল গগৈ বলেছেন তাঁরা সিটিজেন্স অ্যামেন্ডমেন্ট বিলের, যেখানে হিন্দুদের নাগরিকত্ব দেওয়ার কথা বলা হয়েছে, তীব্র বিরোধিতা করছেন। অগপ-র অবস্থানও প্রায় এক। ওই বিল পাস করাতে গিয়ে আসামে বিজেপির সরকার হাতছাড়া হয়ে যেতে পারে। বিজেপি কি সেই ঝুঁকি নেবে? এনআরসির যে ফর্ম, তাতে ধর্ম লেখার কোনও জায়গা নেই। কিন্তু আসামের বিজেপি নেতাদেরই অনুমান, ১৯ লক্ষের মধ্যে ১২ লক্ষ হিন্দু বাঙালি। আসামে মুসলিমদের যে তিনটি গুরুত্বপূর্ণ মুসলিম রাজনৈতিক সংগঠন আছে তারা কিন্তু কেউ এনআরসি নিয়ে কোনও বড় আন্দোলনের ডাক দেয়নি। কেন দেয়নি? মুসলিম নেতাদের কারও কারও মত, ৭১-এর পরে আসা মুসলিমের সংখ্যা নগণ্য। তাঁরা কেউ কেউ সাংবাদিকদের কাছে এমনও বলেছেন, ওই যে দাড়ি, লুঙি দেখলেই বিদেশি বলে অপমান করা, আসামের এনআরসির প্রকৃত তথ্য প্রকাশিত হলে সেই অপবাদ ঘুচবে। তাহলে এই যে ৭ লক্ষ মুসলিমের নাম উঠেছে? তাঁদের মত, ভুলে ভরা ওই তথ্য। সংখ্যাটা বাস্তবে অনেক অনেক কমে যাবে।
কলকাতায় বসে যে নেতারা দু’কোটি বিদেশির কথা বলছেন, তাঁরাও আসলে হিন্দু, বিশেষ করে তথাকথিত নিম্নবর্গীয় হিন্দুদের ধরে কথাটা বলছেন। কিন্তু তাঁরা যেটাতে সফল হয়েছেন, সেটা হল একটা উন্মাদনা জাগিয়ে তুলতে। একটা সামাজিক বিশৃঙ্খলার জন্ম দিতে। কারণ, আগামী বিধানসভা ভোটে এই এনআরসি-রাজনীতি দিয়ে মেরুকরণ ঘটিয়েই পশ্চিমবঙ্গে ভোট করতে চায় বিজেপি। কিন্তু ইতিমধ্যেই হিন্দুদের মধ্যেও এই ভয় তৈরি হয়েছে, অসমে যদি ১৯ লাখের ১২ লাখ হিন্দু হয়, এখানেও তার ব্যতিক্রম হবে না। অমিত শাহ বলছেন, হিন্দুদের ভয় নেই। কিন্তু অমিত শাহরা অতীতে দেওয়া, কালো টাকা, চাকরি-বাকরি, গণপিটুনি রোধ, মেক ইন ইন্ডিয়া, স্মার্ট সিটি এমন গুচ্ছ গুচ্ছ প্রতিশ্রতি দিয়েছেন, যা তাঁরা যে রাখতে পারেননি, সে তো সবার জানা। ফলে হিন্দুদের একাংশের প্রশ্ন, এই প্রতিশ্রুতি যে পূরণ করা হবে তার প্রমাণ কী? নিশ্চয়তা কী? ইতিহাস তো এমন দাবি সমর্থন করছে না।
আরও পড়ুন, বিশ্লেষণ: সারা দেশে এনআরসি চালুর আগে কেন নাগরিকত্ব সংশোধনী বিল পাশ করাতে চান অমিত শাহ
দিল্লিতে গত ২ অক্টোবর প্রাক্তন সিপিএম নেতা হর কিষেন সিং সুরজিৎ ভবনের উদ্বোধনে মার্ক্স, মাওয়ের ছবি ছিল না। ছিল সুরজিতের ছবি, কারণ তাঁর নামে ভবনের উদ্বোধন। আর ছিল মহাত্মা গান্ধীর ছবি। এমন ঘটনা অতীতে কখনও ঘটেনি। কলকাতাতেও সিপিএম রাজ্য সম্পাদক সূর্যকান্ত মিশ্র, বামফ্রন্টের চেয়ারম্যান বিমান বসু এবং অন্যান্য বাম নেতারা কংগ্রেসের বিধান ভবনে গিয়েছিলেন গান্ধীর প্রদর্শনী দেখতে। এমন ঘটনাও অতীতে কখনও ঘটেনি। গত লোকসভা ভোটে মূলত কংগ্রেস আর বামেদের ঘর-ছুট ভোটে পুষ্ট হয়ে বিজেপির ভোট দাঁড়িয়েছিল ৪০ শতাংশ। তৃণমূল ৪৪ শতাংশ। ওই ঘর-ছুট ভোটের ৫-১০ শতাংশও যদি বাম-কংগ্রেসের সম্ভাব্য জোট ফিরিয়ে আনতে পারে ২০২১-এর বিধানসভা ভোটে, তাহলে বিজেপি কিন্তু আরও অনেকটা পিছিয়ে পড়বে। লোকসভার পর বিজেপির ভোট যে বাড়ছে না, কোথাও কোথাও কমছে, যেমন ত্রিপুরা, তার ইঙ্গিত কিন্তু মিলেছে গত সপ্তাহের কয়েকটি রাজ্যের বিধানসভা উপনির্বাচনের ফলাফলে। গত লোকসভা ভোটে ত্রিপুরায় লোকসভায় বামেরা যে নির্মম ফল করেছিল, তার অনেকটাই (একটি আসন হলেও) তারা উদ্ধার করতে পেরেছে এই উপনির্বাচনে। কেরলেও প্রায় অর্ধ শতাব্দী বেহাত থাকা একটি আসন তারা দখল করেছে।
এমন এক রাজনৈতিক পরিবেশে এ কথা বলাই যায়, হয়তো ভারতে ভবিষ্যতের ক্ষমতা দখলের লড়াইটা হয়ে উঠতে চলেছে গডসে বনাম গান্ধীর। গান্ধী কি দ্বিতীয় বার খুন হবেন? নাকি তাঁর পুনর্জন্ম হবে? সে কথা অবশ্য ভবিষ্যতই বলবে।
(শুভাশিস মৈত্র প্রবীণ সাংবাদিক, মতামত ব্যক্তিগত)