বখতিয়ার খিলজির বঙ্গবিজয়ের পরে বাংলাদেশে তৎকালীন প্রচলিত শকাব্দের পাশাপাশি প্রশাসনিক কর্মকাণ্ডে হিজরি সনের প্রচলন শুরু হয়। এই হিজরি সন মোতাবেক চাষিরা জমির খাজনা দিতেন ফসল ওঠার অব্যবহিত পরে। কিন্তু এই সন চান্দ্রমাস অনুযায়ী হওয়ার ফলে, ফসল তোলার সময়ের সঙ্গে রাজস্ব ব্যবস্থার সামঞ্জস্য রাখা ক্রমেই অসম্ভব হয়ে উঠছিল। এ দিকে, অসময়ে খাজনা দিতে গিয়ে চাষিরা পড়ছিলেন চরম সমস্যার মুখে। সম্রাট আকবরের শাসনকালের ২৯ বছর পরে এই সমস্যা সমাধানের পন্হা নিয়ে কথা ওঠে।
আবুল ফজল রীতিমতো হিসেব কষে বুঝিয়ে দেন যে, ৩২টি সৌরবর্ষ ৩৩টি চান্দ্রবর্ষের সমান হওয়ায় চাষিরা অতিরিক্ত এক বছরের খাজনা দিতে বাধ্য হবেন। খাজনা আদায় যাতে বছরের একটি নির্দিষ্ট সময়ে হয় এবং চাষিদের যাতে কোনও ভাবেই অতিরিক্ত খাজনা না দিতে হয়, সে কথা মাথায় রেখে সম্রাটের নির্দেশ অনুযায়ী রাজজ্যোতিষী ফতেহউল্লাহ সিরাজি এক নতুন ক্যালেন্ডার তৈরি করেন।
বাংলার পথচলা: আই সি এস রমেশচন্দ্র দত্ত এবং ইকনমিক হিস্ট্রি অফ ইন্ডিয়া
আকবর সিংহাসনে আরোহণ করেছিলেন ১৫৫৬ খ্রিস্টাব্দ বা ৯৬৩ হিজরিতে। তাই যদিও এই নতুন ক্যালেন্ডার ১৫৮৪ সালে চালু হয়, কিন্তু সম্রাট আকবরের সিংহাসন আরোহণের স্মৃতিকে চিরভাস্বর করে রাখতে ফতেহউল্লাহ ১৫৫৬ খ্রিস্টাব্দ বা ৯৬৩ হিজরি সনকে মূল ধরে নতুন সাল ‘তারিখ-ই-ইলাহি’ প্রণয়ন করেন।
এখানে অবশ্যই মনে রাখতে হবে যে, ফতেউল্লাহ সিরাজি কিন্তু নতুন ক্যালেন্ডারটি চালু করার সময় চান্দ্রমাসের আরবীয় মডেল ব্যবহার করেননি,করেছিলেন পারস্য মডেল। যা শকাব্দের মতোই সৌরমাসভিত্তিক ছিল। ১৫৮৫ খ্রিস্টাব্দ থেকে ফতেহউল্লাহ সিরাজি প্রবর্তিত এই নতুন সাল ‘ফসলি সন’ নামে ভারতীয় উপমহাদেশে ব্যাপক ভাবে প্রসিদ্ধি লাভ করে।
পরবর্তী সময়ে এই ফসলি সনই বাংলা সাল বা ‘বঙ্গাব্দ’ নাম ধারণ করে। আদিতে তারিখ-ই-ইলাহির মাসগুলো ছিল যথাক্রমে ফরওরদিন, অর্দিবিহিষ্ট, খুরর্দাদ, তির, অমুরদাদ, শারেবার, মিহ্র, আবান, আজর, দয়, বহ্মন এবং ইস্ফন্দারমজ্। যদিও পরবর্তী ঠিক কোন সময়ে মাসগুলোর নাম বৈশাখ, জ্যৈষ্ঠ ইত্যাদিতে পরিবর্তিত হয়ে যায়, সে ব্যাপারে ঐতিহাসিকেরা নির্দিষ্ট ভাবে কিছু বলতে পারেন নি।
নওলাখা-তেলতুম্বে: অন্যায় ও নির্মমতার আরেকটি উদাহরণ
মজার কথা, যেহেতু ৯৬৩ হিজরিতে হিজরি ক্যালেন্ডারের প্রথম মাস ‘মহরম’ বৈশাখ মাসে শুরু হয়, সে কারণে তদানীন্তন বাংলায় প্রচলিত শকাব্দের প্রথম মাস চৈত্রের বদলে নতুন বঙ্গাব্দের প্রথম মাস হয় বৈশাখ। এর পরে ১৯৬৬ সালে তৎকালীন পূর্ববঙ্গের বাংলা অ্যাকাডেমির তত্ত্বাবধানে ও মহম্মদ শহীদুল্লাহ-র নেতৃত্বে প্রচলিত বাংলা ক্যালেন্ডারের সংস্কার হয়। ড.শহীদুল্লাহ বৈশাখ থেকে ভাদ্র মাস ৩১ দিনে এবং আশ্বিন থেকে চৈত্র ৩০ দিনে গোনার সুপারিশ করেন। পাশাপাশি তিনি শুধুমাত্র লিপ ইয়ার বা অধিবর্ষের অতিরিক্ত দিনটি ফাল্গুন মাসে জুড়ে দেওয়ার কথা বলেন এবং লিপ ইয়ার গ্রেগরিয়ান ক্যালেন্ডার অনুযায়ী বিবেচনা করতে বলেন। বাংলাদেশ সরকার শহীদুল্লাহ-র প্রস্তাবগুলি মেনে নিয়ে ১৯৮৭ থেকে তা সরকারি ভাবে চালু করে দেয়।
যাঁরা বঙ্গাব্দ প্রবর্তনের কৃতিত্ব আকবরের বদলে শশাঙ্ককে দিতে আগ্রহী, তাঁদের জন্য ঐতিহাসিক ব্রতীন্দ্রনাথ মুখোপাধ্যায় ‘বঙ্গ, বাঙ্গালা ও ভারত’ গ্রন্থে স্পষ্ট ভাষায় লিখেছেন, “এই মতের সপক্ষে কিছু বলতে গেলে প্রথমেই প্রমাণ করতে হবে যে শশাঙ্ক ৫৯৪ খ্রীষ্টাব্দে এক স্বাধীন রাজ্যের প্রতিষ্ঠা করেছিলেন বা অন্তত ঐ সময়ে স্বাধীনভাবে রাজত্ব করেছিলেন। এর কোনও নিশ্চিত প্রমাণ নেই, যদিও খ্রিষ্টীয় ৭ম শতাব্দীর প্রথমভাগে তাঁর রাজত্ব সম্পর্কে যথেষ্ট তথ্য আমাদের আছে। ... শশাঙ্কের রাজ্যের সর্বাপেক্ষা বিস্তৃত সীমানার মধ্যে তাঁর পরবর্তীকালীন এক হাজার বৎসরের মধ্যে তারিখ যুক্ত যে বিরাট সংখ্যক লেখ আবিষ্কৃত হয়েছে সেগুলিতে বঙ্গাব্দ ব্যবহারের চিহ্নই নেই (পৃ. ১৫১-৫২)।”
সব দিক বিবেচনা করে এ কথা নিঃসন্দেহে বলা যায় যে, বঙ্গাব্দের ইতিহাসের সঙ্গে জড়িয়ে আছে প্রাচীন শকাব্দ, ইসলামি হিজরি এবং খ্রিস্টান গ্রেগরিয়ান ক্যালেন্ডার। অথচ দুঃখ এই যে, এ পারের শহুরে বাঙালি তাঁর এই নিজস্ব ঐতিহ্য সম্পর্কে হয় চরম উদাসীন নতুবা নিছক ব্যবসায়ীদের হালখাতার দিন হিসেবে গণ্য করার তুচ্ছ-তাচ্ছিল্যে ওস্তাদ!
কিন্তু শহুরে বাঙালি বাংলা সন-তারিখ নিয়ে তাচ্ছিল্য করলেও, এখনও পর্যন্ত গ্রামবাংলার অধিকাংশ মানুষই তাঁদের দৈনন্দিন কাজকর্ম এই বাংলা ক্যালেন্ডার মেনেই করে থাকেন। সাম্প্রতিক করোনা-উদ্ভূত পরিস্থিতিতে তাঁরাই পড়েছেন সবচেয়ে আতান্তরে। আজ (গ্রেগরিয়ান ক্যালেন্ডার মতে ১৪ এপ্রিল, ২০২০) বাংলা নববর্ষ, দোকানে দোকানে হালখাতা হওয়ার কথা। অথচ রাজ্যজুড়ে লকডাউন চলতে থাকায় এই বছরে এত দিনের পুরনো প্রথাপালন এক কঠিন চ্যালেঞ্জের মুখে।
অন্যান্য বছরের মতো এ বারে চাহিদা না থাকায় কুমোররা লক্ষ্মী-গণেশের মূর্তি গড়েছেন হাতে গুণে, মিষ্টির দোকানগুলোতে ভিড়ভাট্টা আদৌ নেই, হালখাতা বলতে গেলে অমিল। সর্বোপরি স্থানীয় মন্দিরগুলোতে হালখাতায় প্রসাদী ফুল ছুঁইয়ে নিয়ে আসার প্রাচীন প্রথাও বন্ধ হওয়ার উপক্রম। এই পরিস্থিতিতে পুরোহিতরা পুজো করতে অনিচ্ছুক আর সারা বছরের পরিচিত খরিদ্দারদের ইচ্ছে থাকলেও লকডাউনের ঠ্যালায় রাস্তায় বেরনোর উপায় নেই।
আর সাধারণ শ্রমজীবী মানুষ দু-বেলা আহার জোটানোর চিন্তায় উদ্বিগ্ন উদ্ভ্রান্ত। নতুন পোশাক কেনা এখন তাঁদের চিন্তারও বাইরে। সব মিলিয়ে এক অভূতপূর্ব পরিস্থিতি। তবুও এত বিঘ্ন অতিক্রম করেও হয়তো বাড়িতে বাড়িতে নববর্ষ পালনের চিরাচরিত প্রথা পালিত হবে। ব্যবসাদারেরাও হয়তো তাঁদের নিজের নিজের বাড়িতেই কোনও ক্রমে নমো নমো করে হালখাতা পুজো সারবেন। আর প্রার্থনা করবেন যেন পুনরায় এই পরিস্থিতির সম্মুখীন না হতে হয় পরবর্তী বছরগুলোতে।
সব মিলিয়ে জাঁকজমকহীন জৌলুসহীন ভিড়ভাট্টাহীনভাবেই কেটে যাবে নতুন বছরের প্রথম দিনটি। আধুনিক নগরসভ্যতা-সঞ্জাত এই অতিমারী এই ভাবেই থাবা বসাবে গ্রামীণ বাংলার প্রাচীন প্রথায়।
ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেস বাংলা এখন টেলিগ্রামে, পড়তে থাকুন