করোনাভাইরাসের বিস্তার রোধে মানুষের জীবনের কথা চিন্তা করে ঈদবাজারে খুলবে না ঢাকার বসুন্ধরা শপিং মল। সিদ্ধান্ত বসুন্ধরা গ্রুপ চেয়ারম্যান আহমেদ আকবর সোভানের। ভারতের বাঙালি সাংবাদিক কুল এই তথ্য জানতে পারল 'বাংলাদেশ প্রতিদিন'-এর সম্পাদক নঈম নিজামের ফেসবুক পোস্ট থেকে।
করোনা আক্রমণে ভারতের নাগরিক সমাজের এক বড় অংশ, মধ্যবিত্ত, পেশাদারী মানুষ এখন সামাজিক বিচ্ছিন্নতার ফরমান নিয়ে ঘরে বসে মোবাইলে বা কম্পিউটারে বাংলাদেশের খবর নিচ্ছেন, ঠিক যেমনভাবে ঢাকার মানুষ জানছেন ভারতের খবর। এই সংবাদ সংগ্রহে নঈম নিজামের ধারাবাহিক ফেসবুক পোস্টগুলি এখন এদেশে বেশ জনপ্রিয় হয়ে উঠেছে। এগুলি যেন আজকের ঢাকার দর্পণ। করোনায় আসলে আমরা দুই দেশ যে যেখানেই দাঁড়িয়ে থাকি না কেন, আমরা এখন একই নৌকায়। নদীতে বড়ঝঞ্ঝা। আমরা টলমল করতে করতে এই ডিঙিকে কূলে নিয়ে যেতে মরিয়া। জানিনা এই দুর্যোগের শেষ কবে, কিন্তু নঈম নিজামের জনপ্রিয় পোস্ট যেন অনেক কাছাকাছি আনছে দুই দেশকে।
কলকাতা, দিল্লি, আর ঢাকা, এই দুর্যোগে একজন আরেকজনের পাশে আছে। দুর্গাপুজো হওয়ার কথা অক্টোবর মাসে, কিন্তু এখনো পর্যন্ত যা পরিস্থিতি, তাতে মনে হচ্ছে না এবার আমরা দুর্গাপুজোর শপিংয়ে পরিবার নিয়ে বেরোতে পারব। দিল্লিতে পুজোর পরে পরেই দেওয়ালী, এখানকার বড় মল সিটিওয়াক-এর মালিক জানিয়েছেন, মনে হচ্ছে, এ বছরটা এই ভাবেই চলে যাবে। মে-জুন মাসের গ্রীষ্মের পর আসবে ডিসেম্বরে শীত। করোনাভাইরাস নাকি মূলত শীতপ্রধান দেশের ভাইরাস। তাই ভারতীয়দের আশা, গ্রীষ্মের আসন্ন দাবদাহে এই ভাইরাসের মৃত্যু হবে, যদিও এরকম কোনও প্রামাণ্য তথ্য এখনও নেই।
আরও পড়ুন: করোনার নিয়ম তো অনেক, মানা হবে কি?
অন্যান্য মলের মালিক, যেমন ডিএলএফ-এর কেপি সিং, প্রয়াত কেডি সিংয়ের পুত্র, তো বলেই দিলেন, এখন রমজান চলছে, ঈদ উৎসব আসন্ন। কিন্তু অর্থ রোজগারের চেয়ে এখন মানুষের জীবন বেশি গুরুত্বপূর্ণ। ঠিক এই একই প্রতিক্রিয়া দেখছি ঢাকার বসুন্ধরা গ্রুপের প্রধানেরও।
গত রবিবার নঈম নিজাম তাঁর পোস্টে লিখেছিলেন, "খারাপ খবর শুনতে শুনতে ক্লান্ত। আজ সকালের ভালো খবরগুলো বলছি, প্রথমত, ঢাকা থেকে অপহৃত সাংবাদিক কাজলকে উদ্ধার করা হয়েছে বেনাপোলে। দ্বিতীয়ত, কোভিড-১৯ চিকিৎসায় আমেরিকাতে একটি ওষুধের অনুমোদন। তৃতীয়ত, বাংলাদেশে ধানের বাম্পার ফলন। চতুর্থত, করনার চিকিৎসায় তৈরি বসুন্ধরার অস্থায়ী হাসপাতাল। সবাই ভালো থাকবেন। দুপুরের সংবাদ ব্রিফ কী খারাপ খবর নিয়ে আসবে জানি না।"
এদেশেও ঠিক একইরকম উদ্বেগ। উৎকণ্ঠা। টিভি খুললেই করোনায় মৃত্যু আর হতাশার খবর। তাই এই সঙ্কটেও প্রতিদিন কিছু পজিটিভ বা ইতিবাচক খবর দেখানোর চেষ্টা হচ্ছে ভারতের নানা চ্যানেলে। যেমন খবর এসেছে আমেরিকা, ইতালি, ইজরায়েল, নানা দেশের বিজ্ঞানীরা করোনা প্রতিষেধক আবিষ্কারের চেষ্টা করছেন। একাধিক দেশ দাবি করেছে যে তারা এই গবেষণায় অনেকটাই এগিয়ে গেছে। কিন্তু ভারতের খবর হলো, বিশ্বজুড়ে যে ৯০ টি ভ্যাকসিনের ট্রায়াল, তার মধ্যে ভারতের আছে ছ'টি।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার ডিরেক্টর-জেনারেল টেড্রোস আধানম গেব্রেইয়েসুস বলেছেন, প্রতিষেধক আবিষ্কার হওয়া মানেই করোনার মোকাবিলা হয়ে যাওয়া নয়। তবু ভারতীয় বিজ্ঞানীরা নাকি অনেকটা এগিয়ে গিয়েছেন। বিজ্ঞানীদের নিয়ে এবং বৈজ্ঞানিক গবেষণা সংস্থার প্রতিনিধিদের নিয়ে একটি টাস্ক ফোর্স গঠন করেছে ভারত সরকার। আবার আয়ুর্বেদ বিভাগের সঙ্গে মিলিতভাবে কেন্দ্রীয় স্বাস্থ্যমন্ত্রক এই রোগ মোকাবিলার চেষ্টায় কিছু প্রাকৃতিক ঔষধির উপর কাজ করছেন। মুলেঠী, গিলোয়, অশ্বগন্ধা, ও তুলসী, এই চারটি আয়ুর্বেদ ঔষধির ওপর গবেষণা নাকি অনেকটা এগিয়েছে।
আরও পড়ুন: প্রশ্ন একটাই: বন্ধ তালা খুলবে কবে?
এইসব 'ফিল গুড' খবর শুনতে শুনতে আবার খবর এল মর্মান্তিক মৃত্যুর। ভারতে মারা গেলেন রেললাইনের ওপর ঘুমিয়ে পড়া ১৬ জন ক্লান্ত পরিযায়ী শ্রমিক, তাঁদের শরীর পিষে দিয়ে গেল চলন্ত মালগাড়ি।
ভারতের সংবাদমাধ্যমে প্রকাশিত, করোনা কান্ডের সময় বাড়িতে বাড়িতে হিংসা, অর্থাৎ স্ত্রীর প্রতি স্বামীর হিংসা বা যে কোনও ধরনের গার্হস্থ্য হিংসা, অনেক বেড়ে গেছে। অপরাধ প্রথমে কমছিল, এখন ফের বাড়ছে চুরি, ছিনতাই, ডাকাতি, বিশেষতঃ গ্রামাঞ্চলে। সমাজতাত্ত্বিকরা বলছেন, মানুষের আর্থিক দুর্দশা যত বাড়বে, ক্রয় ক্ষমতা ধাক্কা খাবে, ততই বাড়বে সামাজিক অপরাধ।
নঈম নিজামের পোস্ট বলছে, "দুই দিনে ১০ জেলায় ১১ খুন। তৎপর মাদকের সকল চক্র। বেড়েছে সামাজিক অপরাধ। করোনায় মারা গেলে কেউ যায় না লাশ আনতে। আক্রান্ত হলে প্রিয়জনরা ত্যাগ করে। তবুও পরিবর্তন নেই মানুষের মাঝে। খারাপ কাজ সবাই করবেই। পুলিশ আক্রান্তদের হাসপাতালে নেবে, মারা গেলে দাফন করবে, না ব্যস্ত থাকবে অপরাধ দমনে?" মন্তব্য নিষ্প্রয়োজন।
প্রধানমন্ত্রীর ত্রাণ তহবিলে অর্থসাহায্যের জন্য ভারতেও অনেকে অনুরোধ করেছেন। রতন টাটা, মুকেশ আম্বানি সহ ভারতের বিশিষ্ট শিল্পপতিরা অনেকেই অর্থ দিয়েছেন। নঈম বলেছেন, "ক্ষমতাকে ব্যবহার করে গত ১১ বছর ধরে যাঁরা অর্থ বিত্ত গড়েছেন, এখন সিন্দুক খুলুন। গরীব অসহায় মানুষের পাশে দাঁড়ান। ঘর ,থেকে বের হয়ে দেখুন মানুষের কষ্ট। অনেক তো করেছেন, ক্ষমতাও দেখিয়েছেন, এবার মানুষের জন্য কাজ করুন। আর ব্যাংক লুট করে যাঁরা বিদেশে হোটেল, শপিং মল, অফিস ভবন সহ বড় বড় ভবন কিনেছেন, তাঁদের সেই টাকা ফেরৎ আনা হোক। নেওয়া হোক প্রধানমন্ত্রীর ত্রাণ তহবিলে। আগামী দিনের অর্থনৈতিক সঙ্কট মোকাবিলা করা যাবে খুব সহজে। কোন সমস্যা থাকবে না সরকার চালাতে।"
আরও পড়ুন: পাকিস্তানের করোনা নীতি নির্ধারণ করছেন ধর্মযাজক, চিকিৎসক নন
ইতিবাচক খবর দেখা গেল, তিন সপ্তাহে তৈরি হলো বাংলাদেশের বৃহত্তম কোভিড হাসপাতাল। বেসরকারি উদ্যোক্তা গোষ্ঠী বসুন্ধরার দেওয়া জায়গায় সরকার এই হাসপাতালে নির্মাণ করেছে। এই খবরটি পরিবেশন করেছে বিবিসি। লন্ডনের এক্সেল এক্সিবিশন সেন্টারের নাইটিঙ্গেল হাসপাতাল ও মাদ্রিদের আইএফইএমএ কনভেনশন সেন্টারের আদলে কনভেনশন সেন্টারকে রূপান্তরিত করে বাংলাদেশে তৈরি হচ্ছে এই হাসপাতাল।
করোনার সময় চাষের ক্ষেতে গিয়ে রাজনৈতিক নেতারা ছবি তুলছেন, সেসব ছবির প্রচার হচ্ছে ঢাকায়। ঠিক যেমনটা হয় ভারতবর্ষে। কিন্তু বাংলাদেশের রাজনৈতিক নেতাদের এহেন আচরণের তীব্র নিন্দা করেছেন নঈম নিজাম। তিনি লিখেছেন, "মাননীয় মন্ত্রী এমপিরা, ধান আপনাদের না কাটলে কি চলে না? ছাত্রলীগ করেছে, প্রশংসিত হয়েছে। কিন্তু আপনারা কেন ঝামেলা করছেন? কৃষককে সহায়তা অনেক ভাবেই করা যায়। তাদের পাকা কাঁচা ধান নষ্ট করে নয়। মানুষ আপনাদের ধান কাটা দেখে কী বলছে, তা কান পেতে শুনুন। লজ্জা থাকলে বন্ধ করুন নাটকীয় সব লোক দেখানো কান্ড।"
আসল কথা হলো, মানুষ কী চাইছে? আমজনতার দুঃখ যন্ত্রণা দূর করার অঙ্গীকার নিয়েই শেখ হাসিনা তাঁর পিতা বঙ্গবন্ধু মুজিবুর রহমানের হত্যার পর দেশের প্রধানমন্ত্রী হন, বিপুল জনপ্রিয়তা নিয়ে। আজ এত বছর পর অনেক অভিজ্ঞতা, অনেক সুখদুঃখের মধ্যে দিয়ে তিনি তুখোড় রাজনীতিবিদ হয়ে উঠেছেন।
বাংলাদেশের সম্পাদক মশাইয়ের শেখ হাসিনার এক সাক্ষাৎকার নেওয়ার কাহিনী বড় আকর্ষণীয়। তিনি তখন 'ভোরের কাগজ' পত্রিকায় কাজ করতেন। 'নেশন টুডে' নামে একটি ইংরেজী ম্যাগাজিন বের করতেন জিল্লুর রহিম দুলাল। তিনি বললেন, শেখ হাসিনার একটি সাক্ষাৎকার নিতে হবে বড় পরিসরে। তখন এত পত্রিকা, এত সাংবাদিক ছিল না। অবাধে যাতায়াত করা যেত। হাসিনা তখন বিরোধী দলীয় নেত্রী। সংসদ ভবনে বিরোধী দলের নেত্রীর অফিসে দেখা করলেন। সম্পাদক জিজ্ঞেস করেছিলেন, "আপনি ক্ষমতায় এলে দেশটাকে কিভাবে সাজাবেন?" অর্থাৎ ছায়া প্রধানমন্ত্রীর পরিকল্পনা। কথা বলতে বলতে নমাজ পড়ার সময় এলো। দুজনে নেত্রীর সরকারি আবাসন, ২৯ মিন্টো রোডে এলেন। আবার সেখানে অনেক কথা। হাসিনা আব্দুল মতিন সাহেবের বই উপহার দিলে সম্পাদক তাঁর অটগ্রাফ নেন। 'পিএম ইন ওয়েটিং’ শিরোনামে সাক্ষাৎকার প্রকাশিত হয় 'নেশন টুডে' কাগজে।
জানিনা 'পিএম ইন ওয়েটিং' সাক্ষাৎকারটি আজ করোনা সঙ্কটের দিনে পাওয়া যাবে কিনা! এই হতাশ সময়ে শেখ হাসিনা যেভাবে পরিস্থিতির মোকাবিলা করছেন, তাতে মনে হচ্ছে, সেদিনের বাংলাদেশটা আজ নেই। সঙ্কটও অনেক। তবু ভারতে মোদী যেমন সুদক্ষ হাতে মোকাবিলা করছেন করোনার, বাংলাদেশের 'আপা'ও তাই করছেন। শেষ পর্যন্ত তিনি পারবেন।
ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেস বাংলা এখন টেলিগ্রামে, পড়তে থাকুন