scorecardresearch

‘বাংলাদেশে আমার অনেক শালা’, প্রিয় পুলুদার স্মৃতিচারণে…

“পুলুর সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিই।…”

Soumitra Chatterjee

দেশ থেকে বিতাড়িত। পাইকপাড়ায় গৌরকিশোর ঘোষের ফ্ল্যাটে আশ্রিত। মা, দুই কন্যা, এক পুত্র এবং স্ত্রীকে নিয়ে তাঁর পরিবার। উটকো ঝামেলা পাকিয়েছি। মুখে কেউ কিছু বলছেন না ঠিকই, চোখে-মুখেও চিহ্ন নেই। নিজের ভিতরেই অস্বস্তি ঘোরতর। আছি মাসাধিক। পকেট শূন্য। ঢাকা থেকে মাত্র ৬০ পয়সা (ভারতীয়) নিয়ে গিয়েছি। শীলাদি (গৌরকিশোর ঘোষের স্ত্রী) প্রতিরাতে পাঁচ টাকার নোট বালিশের নিচে রাখেন, বলেন না। সকালে উঠে বিছানা, বালিশ ঠিক করার সময় আবিষ্কার করি। বলি শীলাদিকে- “বালিশের নিচে পাঁচ টাকা ছিল।” ফেরত দিই। বলেন, “তোমার হাতখরচ।” ও চাঁদ চোখের জলে লাগল জোয়ার। প্রতিরাতেই রাখেন।

গৌরদার সঙ্গে গাড়িতে আনন্দবাজারে যাই। প্রতি সপ্তাহে একটি-দুটি কলকাতার কড়চা লিখি। কড়চা বাবদ কুড়ি রুপি। নিজেকে রকফেলার মনে হয়। গৌরদা বললেন, “একদিন পায়ে হেঁটে কলকাতা শহর চিনবি। অলিগলি ঘুরবি। বইপাড়া কলেজ স্ট্রিটে এখনও যাননি। ওখানে কফি হাউস, কবিসাহিত্যিকের আড্ডা, বিকেল-সন্ধ্যায়। অনেকের সঙ্গে পরিচয়, বন্ধুত্ব হতে পারে।”

গেলুম এক সন্ধ্যায়। সব টেবিল পূর্ণ। গিজগিজ করছে কফি হাউস, কেউ তরুণ, যুবক, মধ্যবয়স্ক। তরুণী, যুবতী, মধ্যবয়স্কাও। ঢাকায় কফি হাউস নেই, ঢাকা নিউ মার্কেটে ‘মনিকা’ রেস্তরাঁয় মাঝেমধ্যে কবি, সাহিত্যিকের আড্ডা। নারীবর্জিত।

কলেজস্ট্রিটের কফিহাউসে নানা মুখ, কে কবি, কে গল্পকার, সম্পাদক গায়ে তার লেখা নেই। ইতিউতি তাকিয়ে দেখি এক টেবিলে দুজন, একটি চেয়ার ফাঁকা। বসলুম। দুজনের একজন বললেন, “মশাই, আমাদের বন্ধু আসবেন, এলে চেয়ার ছেড়ে দেবেন।” তথাস্তু। কিছু বলিনি। মিনিট দু’-তিন পরে একজন জিজ্ঞেস করেন, “মশাই কোত্থেকে এয়েছেন? নাম কী?”
বললুম, একটু চুপ থেকে, “আপনি কী…..?”
উত্তরে প্রশ্ন: “কলকাতায় বেড়াতে এয়েছেন?”
না।
– কোথায় থাকেন?
গৌরকিশোর ঘোষের ফ্ল্যাটে, আস্তানায়।
– সাংবাদিক লেখক গৌরকিশোর? রূপদর্শী?
প্রশ্নকর্তা কবি শম্ভু রক্ষিত। পরিচয় করিয়ে দিলেন, “ওঁর নাম দেবী রায়। কবি।” পরিচয় হল। দিনতারিখ মনেই নেই। ১৯৭৪ সালের মধ্য জুনের কথা বলছি। কলকাতায় আশ্রিত ২১শে মে থেকে।

কফি হাউসে প্রায়-নিত্যদিন যাই, সন্ধ্যায়। অনেকের সঙ্গে সাখ্যসম্পর্ক। বন্ধুত্বও। সেপ্টেম্বরের শেষ বা অক্টোবরের প্রথম সপ্তাহে একদিন সন্ধ্যায়, এক টেবিলে চার-পাঁচজন গল্পে মশগুল। হাসাহাসি। কণ্ঠ অনুচ্চ। একজনকে দেখে বিস্মিত। সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়। কফি হাউসে আড্ডা দেন? বাকি কারা? জিজ্ঞেস করতেও ভয়।
মার্চের (১৯৭৫) এক সন্ধ্যায় (দিনতারিখ ভুলে গেছি ) দেখি কফি হাউসে সৌমিত্র-সহ আরও দু’জন। কৌতূহল তুঙ্গে।

কবি সুব্রত রুদ্র জানান “একজন ‘এক্ষন’ সম্পাদক নির্মাল্য আচার্য, আরেকজন অভিনেতা রবি ঘোষ।”
স্বীকার করি, রবি ঘোষের নাটক, সিনেমা তখনও দেখিনি। অপরিচিত। ‘এক্ষন’ সম্পাদক নির্মাল্য আচার্যের নাম বাংলাদেশে থাকাকালীনই জানা। চেহারা-সুরতেও গম্ভীর। পণ্ডিতি দেমাক। সাহস হয় না কথা কই। (পরে অবশ্য, তাও কয়েক বছর পরে, সাংবাদিক কল্যাণ চৌধুরী, ওঁর স্ত্রী, নাট্য অভিনেত্রী কাজল চৌধুরীর আস্তানায় আলাপ, সম্পর্ক অগ্রজ-অনুজের)।

সাধ জাগে সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়ের সঙ্গে আলাপের, সুযোগ হয় না। কফি হাউসে দুই-তিন মাস পরে হঠাৎ হাজির, নির্বাচিত বন্ধুদের সঙ্গে আড্ডা।
কপাল খুললো। কবি অমিতাভ দাশগুপ্ত কফি হাউসে। আড্ডা দিচ্ছি। নির্মাল্য, সৌমিত্র এলেন। অমিতাভ বললেন, “পুলুর সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিই।” পুলু? সে কে? সৌমিত্রকে পুলু বলছিলেন অমিতাভ দাশগুপ্ত।

সৌমিত্রর প্রশ্ন: ‘বাংলাদেশে বাড়়ি কোথায়?’
-পাবনায়।
শহরে?
-জী (‘জী’ শুনে চোখের দিকে তাকান। মৃদু হাসি। ‘আজ্ঞে’ বলিনি। বাংলাদেশে ‘আজ্ঞে’ বলে না। ‘জী’ যদিও হিন্দি-উর্দুতে প্রচলিত)।
পাবনার কোথায়
– দোহার পাড়ায়?
কালাচাঁদ পাড়ার নাম শুনেছ?
– আমাদের পাশের পাড়া?
সুচিত্রা সেনের বাড়ি কোথায় জানো?
– দিলালপুরে। কালাচাঁদ পাড়ার পাশেই। দোহারপাড়া থেকে দূরে নয়, কাছেই।
সুচিত্রা সেনের সঙ্গে আমাদের বড়ো আপা (অর্থাৎ দিদি) একই স্কুলে, একই ক্লাসে পড়তেন। কালাচাঁদ পাড়ায় হামেশাই যাতায়াত। কালাচাঁদ আর রাধানগরের দুর্গাপুজোয়, অন্যান্য পুজোয় আমরাই পাণ্ডা।
দীপার বাড়ি কালাচাঁদ পাড়ায়। তাহলে তুমি পাড়াতুতো শালা।
– অ্যাঁ! শালা?
অমিতাভ দাশগুপ্তের প্রশ্ন, ‘শ্যালক নয়?’
সৌমিত্রর উত্তর, “শ্যালক দূরের, শালা কাছের।”
হাসাহাসি। (সবই যে হুবহু বয়ান, নয় হয়তো। অনেকটাই। কানে যতটা সেধে আছে। যাচাই মুশকিল। অমিতাভ, সৌমিত্র পরলোকে)।
দেখা হলে বলতেন, ‘শালা!’ সম্বোধন করতুম ‘পুলুদা’।
যেহেতু শালা, এই আবদারে প্রায়ই হাজির হতাম ওঁর বাড়িতে। একবার বিপদ, বাড়িতে অ্যালসেসিয়ান কুকুর। প্রায় আক্রমণ, হামলে পড়ে। ছুটে এসে রক্ষা করেন।
গিয়েছিলুম (১৯৭৮), বাংলাদেশের কবিতা সন্ধ্যা অনুষ্ঠান উপলক্ষে। সেই প্রথম (কলকাতায়) বাংলাদেশের কবিতাপাঠের একক অনুষ্ঠান। আয়োজন রবীন্দ্র সদনে। স্ক্রিপ্ট লেখেন প্রণবেশ সেন। সঞ্চালক দেবদুলাল বন্দ্যোপাধ্যায়। নামীদামি আবৃত্তিকার (আদকের দিনে ‘বাচিকশিল্পী’)। শম্ভু মিত্র রাজি হয়েও শেষ মুহূর্তে অপারগ। অপর্ণা সেন শুটিংয়ের ব্যস্ততায় অনুপস্থিত। কাজি সব্যসাচীকে রাজি করিয়েছেন আবৃত্তিকার প্রদীপ ঘোষ (অনুষ্ঠানের নেপথ্যে মূলত তিনিই)। অনুষ্ঠানে আবৃত্তিকার গৌরকিশোর ঘোষ, নীরেন্দ্রনাথ চক্রবর্তী, শক্তি চট্টোপাধ্যায়, সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়, সমরেন্দ্র সেনগুপ্ত, পার্থ ঘোষ, গৌরী ঘোষ, জগন্নাথ বসু, উর্মিমালা বসু। প্রদীপ ঘোষ প্রমুখ। সৌমিত্র পোস্টকার্ডে চিঠিতে জানান, “আল মাহমুদের ২টি কবিতা পড়ব।” সবিতাব্রত দত্তর চিঠিতে “জসীমউদ্দিনের ‘উড়ানার চর’ কবিতা বাছাই করেছি।”
– হায়! চিঠিগুলো সংগ্রহে নেই। থাকবেই বা কী করে? হুটহাট জার্মানিতে প্রস্থান।
‘বাংলাদেশের কবিতা’র অনুষ্ঠান বিজ্ঞাপিত আনন্দবাজার, যুগান্তরে। সকাল ১১টার মধ্যে টিকিট নিঃশেষ। ব্ল্যাকেও বিক্রি। কবিতা পাঠের অনুষ্ঠান উপলক্ষেই সৌমিত্রর সঙ্গে নৈকট্য। প্রায়ই ওঁর আস্তানায় হানা। ব্যস্ত থাকলে, কিংবা শুটিংয়ের তাড়া থাকলে বলতেন, ‘এখন নয়, ফোন করে এসো।’

একবার টেলিফোন: “আল মাহমুদ কলকাতায় এলে জানিও। দেখা করব।” আশির গোড়ায় (১৯৮০) আল মাহমুদ এলেন। টেলিফোন করে, সময় নিয়ে আল মাহমুদকে নিয়ে গেলাম। অনেকক্ষণ গল্প। আল মাহমুদকে নিজের কাব্যগ্রন্থ উপহার দিয়ে বললেন, “আমার স্ত্রীর পাড়াতুতো এই…. শালা।” মজা করলুম।

সহপাঠী বন্ধু সৌমেন মন্ডলের ফ্ল্যাট (গলফগ্রিনে) সৌমিত্রের বাড়ি সংলগ্ন। এক সকালে ব্রেকফাস্টের জন্য গিয়েছি। সৌমেনের ফ্ল্যাটে যাওয়ার আগে সৌমিত্রর বাড়িতে। তিনবার কলিংবেল টিপলাম। কেউ খোলে না। চলে আসবো। হঠাৎ দরজা খোলা। সৌমিত্রর পরনে তোয়ালে। স্নানের আগে। দেখে বিস্মিত। “কবে এসেছ” জেনে, “শুটিংয়ে যাব। পরে ফোন করো। এসো।” গিয়েছিলুম। ‘জলপ্রপাতের ধারে দাঁড়াব বলে’ কাব্যগ্রন্থ উপহার দেন। ওঁর জন্মদিনে, গত কয়েক বছরে, শুভেচ্ছা জানিয়ে ফোন করতুম। বছর তিনেক আগে ঢাকায় আগে কী অভিজ্ঞতা, জানান (ফোনে)। “শুধু তুমি নও, বাংলাদেশে আমার অনেক শালা।” বলেই হো-হো হাসি।

Stay updated with the latest news headlines and all the latest Opinion news download Indian Express Bengali App.

Web Title: Bangladeshi writer on soumitra chatterjees demise